সতীপীঠ নয়না দেবীর মন্দির (হিমাচল প্রদেশ)

 


কে জানবে কালী কেমন, সর দর্শনে না পায় দর্শন।মূলাধারে, স্রহস্রারে সরোজগী কৰ্মহং।এদেশের আকাশ বাতাস সারাবছর মাতৃ আরাধনায় মুখরিত।সেই আদিম অবস্থা থেকে প্রকৃতি রহস্যের মধ্যে মানুষ এক বিরাট শক্তির নীরব অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিলো।দুই অক্ষরের কালী নামের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই অনন্ত শক্তি ও অপার রহস্য।

    হিমাচল প্রদেশ এমন এক রাজ্য যার শুরু থেকে শেষ শুধু পাহাড় র পাহাড়।অপূর্ব নিসর্গ শোভায় মোড়া গার্জাল হিমালয়ের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য তীর্থ।তাদের মধ্যে প্রাচীন ও ঐতিহ্য মন্ডিত সতীপীঠ হলো নয়না মাতার মন্দির।তিয়াস নদীর দুই পাড়ে একদিকে পাঞ্জাব অন্যদিকে হিমাচল প্রদেশ আর পিছনে পাহাড় শিখরে মাতা নয়না দেবীর মন্দির।

    চন্ডিগড় থেকে ১০৮ কিমি দূরে বিলাসপুর জেলায় পার্বত্য হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নয়না দেবীর মন্দির।২১ নং জাতীয় সড়ক ধরে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা।রাষ্ট্র পরে সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরে পৌঁছতে হয়।আধুনিকতার যুগে রোপওয়ের মাধ্যমেও মন্দিরে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।


    ৫১ পীঠের এক পীঠ এই নয়না দেবীর মন্দির।এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনী।নয়না নামকরণের পেছনে ২টি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।প্রথমটি হলো সতীকথা।এখানে দেবীর নেত্র পড়েছিল বলে মনে করা হয়।দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় রয়েছে দৈত্যরাজ মহিষাসুরের কথা।পুরাণমতে ঠিক এখানেই মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন মাতা দূর্গা।জনশ্রুতি মহাভারতের কালেও এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসা অমৃতের ভান্ড দেবতারা এখানেই লুকিয়ে রেখেছিলেন।স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস নয়না মাতার মন্দিরে এখনো সেই অমৃত ভান্ড রাখা আছে।

    পাহাড়ের মাথায় বিছানো চাতাল জুড়ে এই মন্দির অপরূপ সাজে সাজানো।মন্দিরে প্রবেশের পর যে মূর্তিটি চোখে পড়বে সেটি পিঞ্জি মাতা।ভেতরে সোনায় বাঁধানো গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন স্বয়ং নয়না সুন্দরী।তপোভূমি ভারতে ভগবানের যত আদর ভক্তের কদর তার থেকে কোনো অংশে কম নয়।মৃত্যুর আগে মহিষাসুর দেবীর কাছে দেবীর স্বরূপ উপলব্ধি করেন।মহিষাসুরের প্রার্থনা ছিল তিনি যেন সময়ে সময়ে দেবীর চরণতলে থাকতে পারেন।

    বিনাশের পর মহিষাসুরের দুই চোখ উপরে নিয়ে যে জায়গায়তে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন মা দূর্গা ঠিক সেখানেই তৈরী হয়েছে এক পবিত্র জলকুন্ড।পাহাড় চূড়ায় মূল মন্দির থেকে ৪-৫ কিলোমিটার নিচে রয়েছে একটি ছোট্ট ঝর্ণা।তার অবিরাম জলধারা এস পড়ছে একটি কুন্ডে।এখানেই নাকি পড়েছিল দৈত্যরাজ মহিষাসুরের দুই চোখ।

    এই পবিত্র জলকুন্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাহাড়ের ওপরে মাতা নয়না দেবীর মন্দিরে জল নিয়ে যান মন্দিরের পূজারীরা।সেই জলেই স্নান করানো হয় মা কে এবং তার পাশাপাশি হয় ভোগ রান্না থেকে শুরু করে মায়ের যাবতীয় আচারের কাজ।যারা কুন্ডের জল নয়না মাতার মন্দিরে পৌঁছে দেন তারা যাত্রাপথে মৌন ব্রত পালন করেন।কাউকে স্পর্শ করেন না।মহিষাসুর কুন্ডের জল নয়না দেবীর মন্দিরে পৌঁছানোর পর সেই জলেই চলে অঙ্গরাগের প্রস্তুতি।স্নানের পর মন্দির খোলা হয়।স্থানীয়দের বিশ্বাস মৃত্যুর পর এইভাবেই দেবীর সেবা করে চলেছেন মহিষাসুর।

    মহিষাসুরের রাজধানী ছিল মাখোয়াল।মাখোয়ালের নাম বদলে রাখা হয়েছিল আনন্দপুর।কিন্তু মহিষাসুরের যতজন সেনাপতি হয়েছিলেন ওদের নামেই ওই গ্রাম আজও সেইভাবেই চলছে।

    হিমাচলপ্রদেশেই রয়েছে দেশের অন্যতম সতীপীঠ জ্বালামুখী মাতার মন্দির।বিলাসপুরের নয়না দেবী কাংড়ার জ্বালামাতার বোন এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে।স্থানীয়দের দাবী বছরের ২-৪ বার বোন নয়নার সাথে দেখা করতে আসেন জ্বালা দেবী।তখন এক চরম পরিস্তিতি তৈরী হয়।যখন জ্বালা মাতা এখানে আসেন তখন সাক্ষাৎ দর্শন হয়।অসংখ্য জ্যোতি জ্বলতে দেখা যায়, বিশেষ বৃষ্টি হয়, বিশেষ ঝড় হয়, ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যায়।এখানে মায়ের এক ত্রিশূল রয়েছে।এর ওপরে সবার প্রথম ৩টি জ্যোতি দেখা যায়।স্থানীয়দের দাবী খুব কমসময়ের জন্য স্থায়ী হয় এই জ্যোতি দর্শন।জনশ্রুতি জ্বালামা যেদিন বোন নয়নার সাথে দেখা করতে আসে সেদিন জ্বালামুখী মন্দিরের শিখা শান্ত হয়ে বিন্দুর চেহারা নেয়।

    মন্দিরের সামনের অশ্বথ গাছের পাতায় জ্যোতি দেখা যায়।অনেকের দাবী এই মন্দির থেকে কয়েকশো কিমি দূরে জ্বালামাতার মন্দির থেকে নীল অগ্নিশিখা এস উপস্থিত হয় এই গাছের পাতার ওপরে এবং সেই সময় জ্বালামাতা দেখা করতে আসেন নয়নাদেবীর সঙ্গে।সতীপীঠ নয়নাদেবীর মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে এমন নানা কাহিনী।



    নয়না মাতার মন্দিরের যজ্ঞকুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে ওপর রহস্য।যজ্ঞকুণ্ডের ওপর প্রতিদিন যে ছাই-ভস্ম জমে তা আজ পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়নি।এই ছাই-ভস্ম যুগযুগান্তর ধরে এখানে জমছে এবং আপনা থেকেই যজ্ঞকুণ্ডের নিচে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

    শিব ছাড়া শক্তি থাকেন না।শক্তি ব্যাতিত শিব বিরাজ করেন না।তাই প্রতিটি শক্তিপীঠে পৃথক দেবীর মতো পৃথক ভৈরবও পূজিত হন।নয়না মাতার মন্দিরেও তার ব্যতিক্রম নেই।গাড়োয়াল হিমালয়ের অমোঘ হাতছানি তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে দেবী মাহাত্ম্য।অগাধ ভক্তি ও অপার বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন বহুমানুষ ছুটে আসেন শক্তিপীঠ নয়নাদেবীর মন্দিরে।

    নয়নাদেবীর মন্দিরের ওপর থেকে দেখা যায় ভাকরা নাকাল প্রকল্পের জলাধার যার নাম গুরু গোবিন্দসাগর ড্যাম।শিকদের দশম গুরু ছিলেন গোবিন্দ সিং।হিন্দুদের রক্ষার জন্য আজীবন লড়ে গিয়েছেন মুঘলদের সঙ্গে।ইতিহাস বলে ঔরঙ্গজেবের বিশাল ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে নয়নামাটার মন্দিরে যজ্ঞ করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিং।দেবীর প্রতি তার এতটাই বিশ্বাস ছিল।পৌরাণিক কাহিনীর সাথে ইতিহাস এভাবেই জড়িয়ে রয়েছে এই নয়না মাতার মন্দিরে।


রয়েছে আরো এক ডাকাতের কাহিনী।পাহাড়ের কোলে রয়েছে জোনামোর মন্দির।এটি পাঞ্জাবিদের কাছে খুব পবিত্র স্থান।মন্দিরে দেবতার আসনে পাতা ডাকাত সর্দারের মূর্তি।স্থানীয়দের বক্তব্য দেবী ভক্ত এই ডাকাত ধোনির কাছ থেকে সম্পদ কেড়ে গর্বিদের বিলতেন।পুলিশি অভিযানের সময় দেবী নয়না তাকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।দেবীর সতর্কবার্তা ছিল ডাকাত সর্দার যেন কোনোভাবে পেছনে ফিরে না তাকায়।অনেকদূর পালানোর পর দেবীর নির্দেশ ভুলে পিছনে তাকান সর্দার।কথিত আছে ঠিক সেই সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় তার।তার পর থেকেই এই স্থান পবিত্র হয়ে রয়েছে।তার নাম তৈরী হয়েছে মন্দির।নোয়াদেবীর মন্দিরের সাথে এই মন্দির এখানে এক দর্শনীয় স্থান।

    এইভাবেই ধর্ম-ইতিহাস-জনশ্রুতি সব একাকার হয়ে গেছে নয়না মাতার মন্দিরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ