বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের অলৌকিক কাহিনী


 বৃন্দাবনের আদি অবস্থান কোথায় ছিল তা ১৬০০ শতাব্দীর আগে মানুষ ভুলেই গিয়েছিলেন। ১৫১৫ সালে শ্রীকৃষ্ণের সেই সব লীলা ক্ষেত্রগুলি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে চৈতন্যদেব মহাপ্রভু বৃন্দাবনে এসেছিলেন।তিনি তাঁর ঐশ্বরিক শক্তির মাধ্যমে সেই স্থানগুনি ছয় গোস্বামীসহ উদ্ধার করেন।তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড।
    এই গ্রামের নাম ছিল আড়িত।আরিষ্ট অসুরকে বধ করার কারণেই এই স্থানের নাম আড়িত।সেই সময় চৈতন্য মহাপ্রভু এখানে এসেছিলেন।এখানে এসে গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই স্থানের নাম কি ? উত্তরে গ্রামবাসীরা বলে এখানে দুটি খেত।একটি গরিখেত ও অপরটি কালিখেত।সেই সময় এখানে খুব অল্প জল ছিল।তখন মহাপ্রভু বলেন এটা গরিখেত, কালিখেত নয় এটা স্বয়ং শ্যামকুণ্ড ও রাধাকুণ্ড।তার পর থেকেই মানুষের মুখে প্রচার হতে লাগলো এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের নাম।এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড মহিমাকে শ্রীরূপ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন যে বৈকুন্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠ এই মথুরা।কারণ মথুরাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।বৈকুন্ঠে ভগবান জন্মগ্রহণ করেননি।বৈকুন্ঠে ভগবানের পিতা-মাতা নেই।মথুরা থেকে শ্রেষ্ঠ বৃন্দাবন কারণ সেখানে ভগবান রাসলীলা করেছিলেন।বৃন্দাবন থেকে শ্রেষ্ঠ শ্রীমান গোবর্দ্ধন, কারণ এখানে তিনি যে লীলাগুলো করেছিলেন তা তিনি ত্রিভুবনে কোথাও করেননি।এখানেই প্রথম এখানেই শেষ।গোবর্দ্ধন থেকেও শ্রেষ্ঠ এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড, কারণ এই রাধাকুণ্ড স্বয়ং রাধারাণীর স্বরূপ এবং এই শ্যামকুণ্ড স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ।তাই যত গোস্বামীগণ ছিলেন সকলেই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের তটে থেকে ভজন করছিলেন। এখানে গেলে দেখা যায় এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের চারপাশে গোস্বামী, গুরুবরদের সমাধি ও ভজন কুটির রয়েছে।এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড থেকেই রঘুনাথদাস গোস্বামী ভজন করছিলেন।এখানেই রঘুনাথদাস গোস্বামীর সমাধিস্থ মন্দিরও রয়েছে।
    সেই সময় দিল্লিতে মোঘল সাম্রাজ্যের শাসনকালে একদিন আকবর বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এইস্থান দিয়েই যাচ্ছিলেন।সৈন্যবাহিনীর মধ্যে হাতি-ঘোড়ার সাথে পায়ে হাত সৈন্যরাও ছিল।সেই সময় এই সৈন্যদের প্রচন্ড জল পিপাসা পায়।তখন আকবর জিজ্ঞাসা করে এইস্থানে এমন কোনো জলাশয় আছে যার জল সৈন্যরা পান করতে পারে ? গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞাসা করতে তারা উত্তরে বলে ঐস্থানে একজন গোস্বামী থাকেন, রধুনাথদাস গোস্বামী।তিনিই পারবেন এই সমস্যার সমাধান করতে।আকবর তখন রঘুনাথদাস গোস্বামীর সাথে দেখা করেন এবং বলেন আমার সৈন্যদের খুব জল পিপাসা পেয়েছে। আপনি কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? তখন তিনি শ্যামকুণ্ডকে দেখিয়ে বলেন আপনারা এই জলাশয় থেকে জলপান করতে পারেন।সেইসময় শ্যামকুণ্ড একটি জলাশয়ের মতোই ছিল।আকবর শুনে বললেন, "আমার অনেক সৈন্য ও হাতি-ঘোড়া রয়েছে।এই সামান্য পরিমান জলে এতো মানুষের পিপাসা কিভাবে নিবারণ হবে।এই জল শেষ হয়ে যাবে তবুও ওদের জল পিপাসা নিবারণ হবে না।"
    রঘুনাথদাস গোস্বামী মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, "আপনি সবাইকে নিয়ে আসুন। কোনো অসুবিধা হবে না।"
এই কথা শুনে আকবর তার সৈন্যদের ওই কুণ্ডের জল পান করালেন।কিন্তু এতো মানুষ জলপান করার পরেও ওই ছোট কুণ্ডের জল একটুও কমলো না।তখন আকবর বুঝতে পারেন এটা কোনো সাধারণ জলাশয় নয়।কোনো দৈবীক শক্তি এখানে রয়েছে।
    একদিন ওই কুণ্ডের পশে বসে যখন রঘুনাথদাস গোস্বামী ভজন-কীর্তন করছিলেন তখন তিনি ওই কুণ্ডদ্বয়কে পুনঃনির্মাণের কথা ভাবেন।সাথে সাথে দুশ্চিন্তাও করেন এই কাজ করা কি ঠিক হবে? কারণ এই দুই কুণ্ড রাধা-কৃষ্ণের স্বরূপ।এইকথা যখন তিনি ভাবছিলেন ঠিক তখন সেইস্থানে এক সওদাগর প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে আসেন।সেই সওদাগর রঘুনাথদাস গোস্বামীকে বললেন এই ধনসম্পদ তিনি বদ্রীনাথজীর মন্দির নির্মাণের জন্য রেখেছিলেন।কিন্তু হটাৎ বদ্রীনাথজী স্বপ্নাদেশ দেন এবং বলেন এই ধনসম্পদ আপনাকে দিতে।এই ধনসম্পদ দিয়ে আপনি এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুন্ড পুনর্নির্মাণ করবেন।


    রঘুনাথদাস গোস্বামী বুঝতে পারলেন ভগবানেরও ইচ্ছে আছে এই কুণ্ড দুটি পুনর্নির্মাণ হয় যেন।তারপরেই তিনি এই কুণ্ডদ্বয় পুনর্নির্মাণের কাজে লেগে পড়েন।যখন তিনি শ্যামকুণ্ড পুনর্নির্মাণ করতে যাচ্ছিলেন তখন দক্ষিণ দিশায় পাঁচটি গাছ একই সরলরেখায় অবস্থান করেছিল।এই পাঁচটি গাছ না কাটলে কুণ্ড নির্মাণে অসুবিধা হবে।রঘুনাথদাস গোস্বামী এই পাঁচটি গাছ কাটার চিন্তা করতেই স্বপ্নে সেই পাঁচটি গাছ রঘুনাথদাস গোস্বামীকে বললেন, "আমরা এই পাঁচটি গাছ পঞ্চপান্ডব।আপনি কুণ্ডটি একটু বাঁকিয়ে নির্মাণ করুন।আমাদের কাটবেন না।আমরা ব্রজভাব প্রাপ্তির জন্য এখানে তপস্যা করছি"। তখন রঘুনাথদাস গোস্বামী বাঁকা করেই শ্যামকুণ্ড নির্মাণ করেন।
    রঘুনাথদাস গোস্বামী সেই সময় এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের জল যাতে নোংরা না হয় তার জণ্য কাছে কুঁয়ো ছিল সেই কুঁয়োর জলে স্নান করতেন তারপর কুণ্ডদুটিতে স্নান করতেন।একদিন কুয়ো থেকে জল তুলতে গিয়ে বিকট শব্দ হয় এবং কুয়োর জল লাল হয়ে যায়।পরে তিনি স্বপ্নে জানতে পারেন এখানে গোবর্দ্ধনের জিহ্বা রয়েছে।জল তুলতে গিয়ে সেই জিহ্বাতে আঘাত লাগে ও রক্তপাত হয় যার কারণে কুয়োর জল লাল হয়ে যায়।অনেকে মনে করেন কুঁয়ো সংস্কারের সময় ওই জিহ্বাতে আঘাত লাগে।যা রঘুনাথদাস গোস্বামী পরে স্বপ্নে জানতে পারেন।এই রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড হলো দুটি চোখ ও কুঁয়োটি হলো জিহ্বা আর সম্পূর্ণ দেহটি হলো শ্রীগোবর্ধন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ