নদীয়া জেলার এক প্রান্তে কালীগঞ্জ এলাকায় হুগলী নদীর তীরে জুরানপুর।প্রাচীনকালে কালীপীঠ বা কালীঘাট নামেও এর পরিচিতি ছিল।সড়কপথে কৃষ্ণনগর হয়ে এখানে আসতে হয়।বর্ধমানের কাটোয়ার ঘাট পেরোলেও পৌঁছনো যায় জুরানপুর।প্রাচীন পঞ্জিকার মতে এই দিক নির্দেশ রয়েছে।বর্ধমান হলো বাংলার শস্য ভান্ডার।ইতিহাস থেকেও তাই জানা যায়।এখানে সব জমি তিন ফসলি হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় মাঠের রং থাকে সবুজ বা সোনালী।কাটোয়ার ঘাট থেকে ছোট নৌকা বা ভুটভুটিতে নদিয়ার বল্লবপুর ঘাট সেখান থেকে জুরানপুর শ্রী শ্রী জয়দুর্গা সতীপীঠ পৌঁছতে হয়।
ভারতের নানা জায়গার সতীপীঠের সঙ্গে এই জায়গার ছবি মেলানো যায় না।গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের বসবাস।বিশাল বাঁধের ধারে এক বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝে পঞ্চবটি মূলে শিলাবতী দেবীর অধিষ্ঠান।খোলা আকাশের নিচে সতীপীঠ সত্যি দুর্লভ।পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুসারে কালীপীঠে দেবীর মুণ্ড পড়েছিল।তন্ত্রবাক্যে বলা আছে কালীঘাটে মুণ্ড পাতহ ক্রোধীশ ভৈরবস্থতা দেবতা জয়দুর্গা নানা ভোগ প্রদায়িনী।এখানে দেবী জয়দুর্গা নামে পরিচিত।পঞ্চবটির সামনেই পীঠ ভৈরব ক্রোধীশের ছোট্ট মন্দির।বাহুল্য বর্জিত এই পীঠে কোনো ডলার দোকান নেই।নেই পাণ্ডাদের টানাটানি।একজনই পুরোহিত যিনি নিত্য পুজো করেন।
ক্রোধীশ ভৈরব মন্দিরের পাশেই রয়েছে গর্ভগৃহ।আদতে এটি একটি সুড়ঙ্গ।যা নাকি আগে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।দীর্ঘদিন থেকে মায়ের যে মুণ্ড আছে যেখানে নিত্য পুজো হয় তার ঠিক সামনেই রয়েছে এই গর্ভ গৃহটি।বর্তমানে প্রশাসনিক নির্দেশে সুড়ঙ্গটির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য এবং বিভিন্ন বিপদ থেকে যাতে রক্ষা পাওয়া যায় তার জন্য এই সুড়ঙ্গটি কিছুদূর যাওয়ার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একদা এই জুরানপুর ছিল জঙ্গলাবৃত।বহু সাধকের সাধনস্থল।তারাপীঠ যাওয়ার আগে সাধক বামাখ্যাপাও এখানে তপস্যা করেছিলেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন।শুধু তাই নয় শিবনাথ শাস্ত্রী, তারাখ্যাপা, সীতারাম দাস, ওঙ্কারনাথ প্রমুখ ব্যক্তিরাও এখানে তপস্যা করেছিলেন।এই মন্দিরের পশে এখনো শিবনাথ শাস্ত্রীর মন্দির এবং তাঁর সাধিত শিব রয়েছে।
ক্রোধীশ ভৈরবের কাছে শ্রাবন মাসে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়।এখানে শ্রাবন মাসের একটা সোমবার প্রায় দশ হাজার ভক্ত এসে বাবার মাথায় জলাভিষেক করেন।এই সময় প্রচুর লোক সমাগম হয়, মেলা বসে, মহোৎসব হয়, পুণ্যাথীরা আসেন।
ত্রিভুবন মোহিনী জগৎজননী এখানে প্রকৃতি রূপে বিরাজ করছেন।আকাশ এখানে দেবীর আনন।বাতাস দেবীর শ্বাস আর মাটি হলো দেবীর কোল।ভক্তরা এখানে গাছের ছায়ায় বসে দেবীর পুজো দেন।গাছের ডালে বেঁধে দেন মনোস্কামনার ঢিল।
জুরানপুরের দেবীকে নিয়ে একটি কাহিনী দীর্ঘদিন ধরে লোক মুখে প্রচারিত।সাধক রাজারাম এখানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।দেবী কালীকা তার সাধনায় তৃপ্ত হলে সাধক রাজারাম তাকে ঘরণী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন।দেবীর স্বপ্নাদেশেই একজনের সঙ্গে বিয়ে হয় রাজারামের।
বৌভাতের দিন নতুন বৌ যখন পরমান্ন পরিবেশন করেছে ঠিক সেই সময় তার মাথা থেকে ঘোমটাটি খুলে পরে যায় এবং সেখানে উপস্থিত কিছুলোক অবাক বিস্ময়ে দেখেন একটি অদৃশ্য হাত যেন নতুন বৌয়ের মাথায় ঘোমটাটা তুলে দিচ্ছে।নতুন বৌকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় হৈ চৈ।তখন দেবী সেখান থেকে পালিয়ে যান।দেবীর ভক্তের স্ত্রী হওয়াও হলো আবার লীলা প্রকাশও হলো।
হটাৎ করে সেই বৌ অদৃশ্য ভাবে জুরানপুর কালীবাড়ির সামনে যে গঙ্গা ছিল সেই গঙ্গার কাছে চলে এসেছিলো।তখন পাশের বাড়ির সমস্ত লোক তাকে খোঁজ শুরু করে এবং দেখে সেই বৌটি গঙ্গার পাড়ে বসে মাছ ধরছে।কোনো এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করছেন- তুমি এখানে বসে আছো কেন? বৌটি উত্তরে বলেন- আমি এই জুরানপুর কালীবাড়ির মা।
আজও এই পীঠস্থানে কালীপুজো শুরুর পর সেই ভট্টাচার্য্য বাড়িতে পুজো শুরু হয়।এমনকি সেই পরিবারের কোনো বৌ আজ এই পীঠস্থানে পুজো দিতে আসেন না।এলাকার জনশ্রুতি, মনীশ চক্রবর্তী নামের এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশে দীঘি থেকে একটি অষ্টধাতুর জয়দূর্গার মূর্তি পেয়েছিলেন।প্রতিদিন সকালে সেই মূর্তিকে শিলা রূপে দেবীর পাশে বসিয়ে পুজো করা হয়।আবার সন্ধ্যায় শীতল ভোগের পর মূর্তিটিকে ভেতরের একটি ঘরে রেখে আসা হয়।এই রকম নানান কাহিনী রয়েছে এই জুরানপুরে।
দিনের বেলাতেও পঞ্চবটির ছায়া বেশ নিবিড়।সারাদিন ভক্তদের ঢল না থাকায় এই নির্জন স্থান আজও ঈশ্বর চিন্তার চারণভূমি।ঢাক-ঢোল-কাঁসরের বাহুল্য বর্জিত প্রকৃতির কোলে দেবীর নিরাড়ম্বর আরতি দেখে শিহরিত হতে হয়।মন ছুটে যায় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে।
0 মন্তব্যসমূহ