শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রার ইতিহাস


"আবির রঙে রাঙাবো আজ তোমাকে রাধে রাধাকৃষ্ণ রঙে রঙিন এই নিধিবনে"।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বৃন্দাবনের মাখনচোর।রাধার কানাই আর ভক্তের ভগবান।অদ্ভুত আর অপার তার লীলামাহাত্ম্য।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাজারো লীলার মধ্যে দোল বা হোলি উৎসবও রয়েছে।

     দোলপূর্ণিমা বা দোলযাত্রা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব।বাংলা ও ওড়িশা ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থানে দোল উৎসব মহা সমারহে পালিত হয়।ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে দোলযাত্রা হোলি নামে পরিচিত।দোল উৎসবের অপর নাম বসন্ত উৎসব।ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।দোল বা হোলি একই রকম মনে হলেও এই দুটি মূলত আলাদা অনুষ্ঠান।দোল ও হোলি কখনোই একই দিনে পালিত হয় না।দোল উৎসব একান্তই বাঙালিদের আর হোলি অবাঙালিদের উৎসব।বাঙালি সমাজে দোলযাত্রাকে বসন্তের আগমনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

    বৈষ্ণবীয় মত অনুসারে দোলযাত্রার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির ও রং নিয়ে শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সাথে রংখেলায় মেতেছিলেন।সেখান থেকেই দোলযাত্রার উৎপত্তি।১৪৮৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী দোলপূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তাই এই তিথিকে গৌরপূর্ণিমা বলা হয়।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি গোপীরা দোলযাত্রা উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু।ভগবানের এই লীলাবিলাশ কবে শুরুহয়েছিলো তা জানা না গেলেও বিভিন্ন আখ্যান বা পদে সেই মধুর কাহিনী বর্ণিত রয়েছে।


    হিন্দুপুরাণে প্রায় ২০০০ বছর আগে রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য কর্তৃক গোকুলে হোলি খেলা প্রচলনের উল্লেখ পাওয়া যায় যায়।তবে ইতিহাসে একাধিক ইন্দ্রদুম্ন্যের নাম পাওয়া যায়।ফলে এই ইন্দ্রদুম্ন্য কে ছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়না।জৈমিনীর পূর্ব মীমাংসা সূত্রতে দোলযাত্রা কথার উল্লেখ আছে।এছাড়া মালতীমাধব নামক নাটকেও বসন্তউৎসবের কথা আছে।

খ্রীষ্টের সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট হর্ষবর্ধন কর্তৃক লিখিত রত্নাবলী নাটকে হোলি খেলার বর্ণনা রয়েছে।মহাকবি কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যে বসন্ত বর্ণনায় দেখা যায় যুবতী ও রমণীরা কৃষ্ণচন্দন, কুসুমরস এবং কুমকুম মিশ্রিত রঙে নিজেদের রাঙাচ্ছে।

    দক্ষিনভারতের বিজয়নগরের হাম্পিতে একটি মন্দিরের দেওয়ালে এক রাজকুমার ও রাজকুমারীর হোলি খেলার দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে।কৃষ্ণের বাল্যলীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন ও মথুরাতে হোলি চলে ১৬ দিনব্যাপী।প্রাচীন ভারতের এই উৎসবকে হোলিকা উৎসব নামেও অভিহিত করা হয়।

    ভবিষ্যপুরাণ, বেদ ও নারদপুরানে হোলিকা উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলে প্রাপ্ত লিপি থেকে অনুমান করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ আব্দেও হোলি উৎসবের প্রচলন ছিল।

    বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদের পিতা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু পুত্রের এই বিষ্ণু ভক্তি পছন্দ করতেন না।হিরণ্যকশিপু বিভিন্ন উপায়ে পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যা করার চেষ্টা করেন।বিভিন্ন উপায়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি তার বোন হোলিকাকে নির্দেশ দেন তার পুত্রকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করতে।হোলিকার ওপর দৈব আশীর্বাদ ছিল।অগ্নি কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।কিন্তু প্রহ্লাদকে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করা মাত্র হোলিকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় ভক্ত প্রহ্লাদ অক্ষত ছিলেন।হোলিকার এই ঘটনাকে উৎযাপনের জন্য হোলি উৎসবের সূচনা বলে ধারণা করা হয়।


    আবার মনে করা হয় বাল্যকালে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক পুতনা রাক্ষসীর বোধকে ঘিরে হোলি উৎসবের জন্ম।বাংলা অঞ্চলে দোল উৎসবের সূচনা হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা।

    ভারতের বাইরে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাকো, সুরিনাম, ফিজি, ঘানা, মালয়েশিয়া তে দোল উৎসবের প্রচলন রয়েছে।ঘানা তে হোলিকে ফাগুয়া বলা হয়।আধুনিক কালে বাংলায় দোল যাত্রার সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


    ১৯২০ সালে রবিঠাকুর শান্তিনিকেতনে দোল উৎসবের সূচনা করেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ