সতীপীঠ প্রয়াগের ললীতাদেবীর মন্দিরের ইতিহাস

 


তীর্থরাজ প্রয়াগ।মোঘল আমলে এর নামকরণ হয় ইলাহাবাদ।ব্রিটিশ শাসনের সময় সেই নামই অপভ্ৰংশ হয়ে দাঁড়ায় এলাহাবাদ।বর্তমানে উত্তর ভারতের অন্যতম বড় শহর।বর্তমান এলাহাবাদ শহরের তিনদিক গঙ্গা ও যমুনা দ্বারা পরিবেষ্টিত।শহরের আয়তন ৮২ বর্গকিলোমিটার।জনসংখ্যা ১১লক্ষের কিছু বেশি।এই শহর ধরে রেখেছে ভারতের প্রমান সময়।

    গঙ্গা, যমুনা ও অধুনালুপ্ত সরস্বতী, এই তিন নদীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণী সঙ্গম।বলা হয় ব্রহ্মা এই জগৎ সৃষ্টি করার পর এখানেই প্রথম যজ্ঞ করে আহুতি দিয়েছিলেন।

    মহাভারতের বন পর্বে তীর্থ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী সঙ্গমে স্নান করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়।এই সঙ্গম পুণ্যজনক, পবিত্র, পাপনাশক ও উত্তম তীর্থ।দেবতাদের যজ্ঞভূমি।প্রয়াগের নাম শুনলে, নামকীর্তন করলে, মাটি স্পর্শ করলে মানুষ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়।

    প্রয়াগের মূল আকর্ষণ এই ত্রিবেণী সঙ্গম হলেও এখানের সতীপীঠের মাহাত্ম্য বিশাল।প্রয়াগের রয়েছে সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম পীঠ।এখানে মা ললীতাদেবী নামে পূজিতা।পুরাণমতে যযাতি প্রয়াগ ত্যাগ করে সপ্তসিন্ধু জয় করতে যান।তাঁর পঞ্চ পুত্রই ঋকবেদের প্রধান পাঁচ জাতী।যেযুগে বেদ লেখা হয়েছিল সেইসময় মূল আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল পাঞ্জাব।সেখানেও প্রয়াগকে পবিত্র স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।ঋকবেদে সরস্বতী নদীরও উল্লেখ রয়েছে।বৈদিক যুগের পরে আকর্ষণের কেন্দ্র সরে এলো পাঞ্জাব থেকে দোয়াবে।এই অঞ্চল আর্যাবর্ত বলে পরিচিত হলো।মহাভারতেও একাধিক জায়গায় প্রয়াগের উল্লেখ আছে।কুরু বংশ হস্তিনাপুর শাসন করতো।একবার প্লাবনে রাজধানী ডুবে গেলে রাজা তার প্রজাদের নিয়ে চলে আসেন প্রয়াগের পাশে কৌশাম্বীতে।কৌশাম্বী ও প্রয়াগের গুরুত্ব সমান ভাবে বাড়তে থাকে।উত্তর বৈদিক যুগে আধুনিক হিন্দু ধর্মের উৎসস্থল হয়ে উঠলো প্রয়াগ।কোশাম্বীর রাজা উদয়ন বুদ্ধের শরণাগত হওয়ার পরে প্রয়াগ অঞ্চলে বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকে।রামায়ণের যুগেও বহু ঋষির আশ্রয়স্থল ছিল এই প্রয়াগ অঞ্চল।রামচন্দ্র চিত্রকূট পর্বত যাওয়ার পথে এখানে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে কিছুদিন ছিলেন।মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাদের অধীনে ছিল প্রয়াগ।প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে দেখা গেছে খ্রীষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে এখানে কুষাণের রাজত্বকাল ছিল।তবে প্রাচীন এই জনপদে খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০০-১২০০ বছরের মধ্যে লোহার ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।হর্ষবর্ধনের আমলে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতে আসেন।তার লেখাতেও পাওয়া যায় ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রয়াগে আসেন।এরপর মোঘল যুগেও এই শহরের পরিধি আরও বৃদ্ধি পায়।হিউয়েন সাঙ এসে যা দেখেছিলেন পরবর্তীকালে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।আকবরনামায় এই শহর সম্রাট আকবরের আবিষ্কার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।১৬৭৪-১৫৮৩ এর মধ্যে এখানে দুর্গ তৈরী হয়।আকবর নাম রাখেন "ইলাহাবাস" অর্থাৎ ভগবানের আবাসস্থল।পরে শাহজাহান এর নাম রাখেন "ইলাহাবাদ"।দুই নদীর মধ্যবর্তী অবস্থান দেখে আকবর অবিভুত হয়েছিলেন।আকবর চেয়েছিলেন এই শহর তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠুক।


    প্রয়াগের মূল আকর্ষণ সঙ্গম।যুগ যুগ ধরে পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন ত্রিবেণী সঙ্গমে কুম্ভ মেলায় স্নান করে ত্রিকালের পাপস্খলন করতে।

    কিন্তু কেন এই কুম্ভ মেলার আয়োজন ? 

ক্ষীরসাগর থেকে অমৃতকুম্ভ তুলে আনা দেবতাদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না।তাই তারা কৌশল করে সমুদ্রমন্থনে অসুরদের সঙ্গী করলেন।চুক্তি হলো সমুদ্র থেকে অমৃতের অর্ধেক অধিকার পাবেন অসুরেরা।অবশেষে ধন্বন্তরী উঠে এলেন অমৃত কুম্ভ হাতে।দেবতারা প্রমাদ গুনলেন।এই অমৃতভাণ্ড অসুরদের হাতে গেলে তারা আমার হবে।তাই দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত কৌশলে অমৃতভাণ্ড নিয়ে পালালেন।কিন্তু অসুরদের কাছে তা ধরা পড়ে গেলো।১২দিন অসুরেরা তাকে ধাওয়া করলো।এই অমৃতভাণ্ড নিয়ে পালানোর সময় জয়ন্ত চার জায়গায় সেই কলস নামিয়ে রাখেন।সেই চার জায়গায় হয় কুম্ভমেলা।গোদাবরী তীরে নাসিক, শিপ্রা তীরে উজ্জয়নী, গঙ্গা তীরে হরিদ্বার এবং ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রয়াগ।দেবতাদের একদিন-একরাত মর্ত্যলোকে একবছরের সমান।তাই ১২দিন ১২বছরের সমান।প্রতি ১২ বছর অন্তর এই চার জায়গায় ঘুরে ঘুরে হয় কুম্ভের আয়োজন।এরমধ্যে প্রয়াগ এবং হরিদ্বারে কয়েকফোঁটা অমৃত ছড়িয়ে পড়ায় এই দুই জায়গায় হয় মহা কুম্ভের স্নান।এই কারণে প্রয়াগ ও হরিদ্বার হলো মহাকুম্ভস্থল।


    এলাহাবাদ জং থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্বে ও প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গম থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে অন্যতম সতীপীঠ ললীতাদেবীর মন্দির।রাস্তার ওপর ললীতাদেবীর নামাঙ্কিত তোরণ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় মূল মন্দিরের সামনে।মন্দিরের বাইরে গোটা কয়েক ফুল ও পূজা সামগ্রীর দোকান, আছে কয়েকটা খাবারের দোকানও।রাস্তা থেকে খানিকটা উঁচুতে মূল মন্দির চত্বর।৫১ সতীপীঠের অন্যতম স্থান, ললীতাদেবীর মন্দির।

    ললিতাদেবীর প্রাচীন মন্দির ছিল ছোট টিলার ওপরে শ্রীযন্ত্রের আকারে।কিছু বছর আগে সেই মন্দিরকে ভেঙে ফেলে নতুন করে মন্দির নির্মাণ হচ্ছে এবং সেই নির্মাণ কাজ এখনো চলছে।গর্ভগৃহে বেদির ওপর অবস্থান করছেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী।রুপোর ধ্যানমূর্তির আড়ালে রয়েছে দেবীর প্রস্তরীভূত শিলামূর্তি।রুপোর সিংহাসনে তিনি আসীন শ্রীযন্ত্রের ওপর তাঁর অবস্থান।তবে এই মন্দিরের প্রচুর শ্রীযন্ত্র রয়েছে।যাতে নিত্য পুজো করা হয়।



    ললীতাদেবী শ্রীযন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।তাই এখানে শ্রীযন্ত্রের পুজো করা হয়।বিভিন্ন আকারের ১০৮ টি শ্রীযন্ত্র পুজো করা হয়।মূল মন্দিরের ওপরের অংশ শ্রীযন্ত্রের আদলে তৈরী।মন্দিরের একপাশে রয়েছে রাম-লক্ষণ-সীতা ও রাধাকৃষ্ণ।অন্যদিকে রয়েছেন সঙ্কটমোচন।

    মন্দির চত্তরে উঠে এসেই বামদিকে রয়েছে শিবের মন্দির।এই মন্দিরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো পারদের শিবলিঙ্গ।৫১কেজি ওজনের পারদের শিবলিঙ্গ।এই পীঠে ললীতাদেবীর মন্দিরে যেখানে লঙ্কেশ্বর মহাদেব রয়েছেন সেখানেই পারদেশ্বর মহাদেবও রয়েছেন।এই শিবলিঙ্গ সর্বশ্রেষ্ঠ মানা হয়।এতো বড় শিবলিঙ্গ প্রয়াগে অথবা হরিদ্বারে রয়েছে।এই লিঙ্গের দর্শনে কোটি কোটি বছরের পাপ নাশ হয়।

    ললীতাদেবীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে ভব ভৈরব।এনি ললীতাদেবীর পীঠ ভৈরব।

এই মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বহু কাহিনী।মহাভারতের যুগেও এই মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।দুর্যোধন পাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য চতুগৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন।যে সময় লাক্ষাগৃহ দহন চলছে সেইসময় পাণ্ডবরা সুড়ঙ্গ পথে নদী পেরিয়ে চলে এসেছিলেন ললীতাদেবীর মন্দিরে।

    দুর্যোধন  প্রচেষ্টা করে পাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য।কিন্তু সফল হতে পারেনি।তখন দুর্যোধন এই মন্দির থেকে প্রায় ৩০কিমি দূরে লাক্ষাগৃহ নামক স্থানে একটি প্রাসাদ তৈরী করে এবং সেখানে পাণ্ডবদের আমন্ত্রিত করে।সেখানে পাণ্ডবদের আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে দুর্যোধন।কিন্তু পাণ্ডবরা সুড়ঙ্গপথে সুস্থভাবে ললীতাদেবীর মন্দিরে এসে পুজো দেয়।তাঁরা মায়ের কাছে জানায় যদি তারা যুদ্ধ জয় করে তবে তারা এসে মায়ের মন্দিরে পুজো দেবে।

    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পর পাণ্ডবরা এই মন্দিরে এসে দেবী ললীতার পুজো করেছিলেন।সেই ঘটনার স্মরণে আজও প্রতি বৈশাখের অষ্টমী তিথিতে বিশেষ মেলা বসে এখানে এবং মায়ের বিশেষ পুজো হয়।

    ভব ভৈরব মন্দির থেকে একটু এগোলেই জায়গাটার নাম পাণ্ডব কূপ।প্রাচীনকালে এইখানে জঙ্গল ছিল।সেইসময় এখানে জলের সমস্যা ছিল।বলা হয়, অর্জুন এখানে এসে বাণ মেরে জল নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই জলেই ললীতাদেবীর অভিষেক করা হয়েছিল।

    পুরাণমতে, এখানে সতীর হাতের তিন আঙ্গুল পড়েছিল।আদি গুরু শঙ্করাচার্য এই পীঠ আবিষ্কার করেন।তার মতে, যে হাত স্বয়ং শিবের সেবা করতো তার মাহাত্ম্যই আলাদা।ললীতাদেবীকে তিনি ত্রিপুরসুন্দরী বলে উল্লেখ করেছেন।

    সন্ধ্যা নামলেই স্থানীয় মহিলারা এসে জড়ো হয় মন্দির চত্বরে।শুরু হয় দেবীর নাম সংকীর্তন।রাট বাড়লে একে একে মন্দিরে আরতি হয়।সবশেষে হয় ললিতাদেবীর আরতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ