দুর্গাষষ্ঠীর ব্রতকথা

   

 
ব্রতের নিয়মবিধি:- অশ্বিন মাসের শুক্লপক্কের ষষ্ঠীর দিনে সন্তানের মায়েরা এবং যে সকল রমণীরা সন্তান প্রাপ্তির আশা করেন তারাও দিনের বেলা উপোস করে মা ষষ্ঠীর পুজো করেন এবং ব্রতকথা সম্পূর্ণ করে শেষে প্রসাদ গ্রহণ করেন।এই ব্রত পালন করলে ভাত খাওয়া মানা।ভাতের পরিবর্তে ফল-মূল খেয়ে থাকতে হবে।অবশ্যই আহার করার আগে ব্রতকথা শুনতে হবে।

    ব্রতের উপকরণ:- ফুল, দূর্বা, ধুপ, দীপ, আতপচালের নৈবেদ্য, ফল, মিষ্টান্ন, প্রভৃতি।
    
ব্রতের ফল:- 
এই ব্রত বাংলার হিন্দু সমাজে অশাস্ত্রীয় মহিলা ব্রত।মূলত মায়েরা সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত পালন করেন।আবার রমণীরা সন্তান প্রাপ্তির আসতেও এই ব্রত পালন করে থাকেন।আমাদের এই বাংলায় বাঙালি মহিলারা সাংসারিক মঙ্গল কামনাতেও এই ব্রত পালন করেন।এটি অশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দূর্গা পূজার বোধনের দিনে অর্থাৎ মহাষষ্ঠীর দিনে পালন হয়ে থাকে।
    দেবীর বোধন মন্ত্র:- রাবনস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ। অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যাস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।অহমপ্যাশ্বিনে তদ্ববোধয়ামি সুরেশ্বরীম। শক্রেনাশি চ সংবোধ্য প্রাপ্তং রাজ্যং সুরালয়ে।। তস্মাদহং ত্বাং প্রতিবোধয়ামি বিভূতি রাজ্য প্রতিপত্তি হেতোঃ। যথৈব রামেন হতো দশাস্যস্তথৈব শত্রুন বিনিপাতায়ামি।। তস্মাৎ তিষ্ঠ মহাভাগে যাবৎ পূজাং করোম্যহম। মূলে সমাগতে শুক্লসপ্তম্যামাগমিস্যসি।।দেবী চন্ডাত্মিকে চন্ডি চন্ডবিগ্রহকারিনি। বিল্বশাখাং সমাশ্রিতা তিষ্ঠ দেবী যথাসুখম।।     
    ব্রতকথা:- একদেশে এক ব্রাহ্মণ ও এক ব্রাহ্মণী ছিলেন।সংসারে তাদের ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে।মেয়েদের সব বিয়ে হয়ে গেছে।বড় ছেলেরও বিয়ে হয়ে গেছে।ছোট ছেলের তখনও বিয়ে হয়নি।দূর্গা ষষ্ঠীর আগের দিন ব্রাহ্মণ তার পরিবারের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো তোমাদের কার কি জামাকাপড় লাগবে তার তালিকা আমাকে দাও।আমি সেই মতো তোমাদের পুজোর জামাকাপড় নিয়ে আসবো।সকলে নিজের নিজের কথা বললো কিন্তু বড় বৌ কিছুই বললো না।সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ব্রাহ্মণ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, "বৌমা, তোমাকে যে বার বার জিজ্ঞাসা করছি তা কি তুমি শুনতে পাচ্ছ না?"
    এবার বড় বৌ তাঁর শাশুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়ে শশুরকে বললো, "মা, বাবাকে বলুন আমার জন্য ধুলোমুঠি শাড়ি আনতে "।
ব্রাহ্মণ তখন বাজারে গিয়ে সবার তালিকা মত জিনিস কিনলো।কিন্তু বড় বৌমার ধুলোমুঠি শাড়ি আর কোনো দোকানে পাওয়া যায় না।শেষে বাজারের অনেক পুরোনো এক দোকানে গিয়ে দোকানিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।দোকানির খুব বয়স হয়ে গিয়েছে।তিনি হেসে বললেন, "দাদাঠাকুরণ ও শাড়ি কে চেয়েছে?"
    তখন ব্রাহ্মন বললেন, "আমার বড় বৌমা।"
তখন দোকানি বললেন, "তার বুঝি কোনো ছেলে নেই?"
    ব্রাহ্মণ বললেন, "না !"
দোকানি বললেন, "বুঝেছি। তাই সে ধুলোমুঠি শাড়ি চেয়েছে।" তিনি আরও বললেন ,"ও কি কোথাও পাওয়া যায় ঠাকুর! ও তো মা ভগবতীর দয়া হলে পাওয়া যায়।মা ষষ্ঠীর কৃপা পেলে তবেই সে পাবে।দেখুন থাকুর কাল ষষ্ঠী।আপনি আপনার বৌমাকে বলবেন কাল যেন সে মা ষষ্ঠীর পুজো করে।তবেই মায়ের দোয়ায় তার মনোস্কামনা পূর্ণ হবে।"
    ব্রাহ্মণ বললেন, "আচ্ছা বেশ! কিন্তু ধুলোমুঠি শাড়ি কোথায় পাবো ?"
দোকানি হেসে উত্তর দিলো, "লালপাড় ধপধপে কাপড় হবে আর দামাল ছেলে ধুলো মেখে ঝাঁপিয়ে পড়বে মায়ের কোলে।তার হাতের পায়ের ধুলোর দাগ সব কাপড়ে লাগবে তাকেই বলা হয় ধুলোমুঠি শাড়ি।"
    ব্রাহ্মণ এবার বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে তাদের জামাকাপড় দিলেন আর বড় বৌমাকে বললেন, "মা, তোমার কাপড় বাজারে পাওয়া যায় না।কাল ষষ্ঠী, কাল থেকে বছর বছর শুক্লা ষষ্ঠিতে মায়ের পুজো করো।তাহলে তোমার কাপড় পাওয়া যাবে।"
ব্রাহ্মণের কথা শুনে বড় বৌ সেদিন মানত করলো এবং সেইদিন নিরামিষ খেলো।পরেরদিন ঘটা করে শুদ্ধাচারে মা ষষ্ঠীর পূজা করলো, ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করলো ও মায়ের কাছে ধুলোমুঠি শাড়ি চাইলো।দেখতে দেখতে বড় বৌ গর্ভবতী হলো।বাড়ির সবার খুব আনন্দ।পাঁচমাসে পঞ্চামৃত, সাতমাসে ভাজা ও নয়মাসে পাকা সাধ হলো।এরপর সূর্যের মতো তেজদ্বীপ্ত এক ছেলে হলো।ছেলেকে দেখে কেউ চোখ ফেরাতে পারে না।সেই থেকে ব্রাহ্মণের আর সুখ ধরে না।পরের বছর বড় বৌ শাশুড়ি আর ননদদের নিয়ে ষষ্ঠী পুজো করলো।মা ষষ্ঠীর দয়ায় ননদরাও গর্ভবতী হলো।ছোট ছেলেরও বিয়ে হলো খুব বড় লোকের ঘরে।একদিন বড় বৌ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেই সময় তার ছেলে হামাগুড়ি দিয়ে গা মাখা ধুলো নিয়ে আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো।বড় বৌ তখনি ছেলেকে বুকে তুলে নিলো।ধপধপে শাড়িতে ধুলোর দাগ লেগে গেলো।ব্রাহ্মণ লুকিয়ে ব্রাহ্মণীকে এইসব দেখালো।ব্রাহ্মণ এইসব দেখে ভেতরে এসে বললেন, "এতদিনে মা ষষ্ঠীর কৃপায় বড় বৌমার ধুলোমুঠি শাড়ি পরা সার্থক হলো।" বড় বৌ লজ্জায় আস্তে আস্তে ছেলে নিয়ে চলে গেলো।দেখতে দেখতে এই ব্রতের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো।সেই থেকে নারীগণ ভক্তিভরে মা ষষ্ঠীর পুজো করতে লাগলো।এই ব্রতফল এবং ব্রতকথা সর্বত্র প্রচারিত হলো।

    কিন্তু পূর্ববঙ্গে এর একটু বিপরীত হয়।পূর্ববঙ্গের লোকেরা বলেন ষষ্ঠীর দিন কৈলাশে মা দুর্গার ধুলোমুঠি শাড়ি পড়ার সাধ হয়েছিল।সেইকথা তিনি মহাদেবকে বলেছিলেন।এদিকে বাপের বাড়ি যেতে হবে বলে দুর্গাকে জয়া-বিজয়া তেল-হলুদ মাখাচ্ছিলেন এবং গায়ের ময়লা তুলে দিচ্ছিলেন।সেইকালে মা দুর্গার গায়ের ময়লাগুলি একসঙ্গে করে তা দিয়ে একটি পুতুল গড়লেন।সেই পুতুলটি দেখতে ঠিক ছোট একটি শিশুর মতো।সেই সময় নারায়ণ সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন।তিনি তখন সেই পুতুলের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং পুতুলটি মা মা বলে কেঁদে ওঠে।তখন মা দূর্গা তাকে কোলে তুলে নিয়ে স্তন পান করলো।মহাদেব এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে খবর দিলেন।খবর পেয়ে সবাই এসে ছেলেকে দেখে অনেক যৌতুক ও আশীর্বাদ দিলেন।দেবতাদের মধ্যে শনিদেব ও  ছিলেন।তিনি ভাবলেন আমি তো ওর মামা। যদি ভাগ্নের মুখ না দেখি তাহলে সবাই খারাপ মনে করতে পারে।এই ভেবে তিনি যখন ত্বকের বাঁধন খুললেন তখনই সেই শিশুর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেলো।রক্তে মা দুর্গার দেহ ভিজে গেলো।দেবী কেঁদে উঠলেন এবং শনিদেবকে হত্যাস করতে উদ্যত হলেন।অমনি দেবতারা সব বলে উঠলেন, "আপনি তো শনিকে ঐরকম বর প্রদান করেছিলেন।ওর কি দোষ ! "
    তখন দূর্গা রাগ সামলে মহাদেবকে পুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেন।মহাদেব তখন নন্দীকে বললেন, "উত্তরদিকে মাথা করে যে শুয়ে আছে তার মাথা নিয়ে এস।"
 নন্দী ত্রিভূবন ঘুরে এসে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি সাদা হাতির  মাথা কেটে এনে মহাদেবকে দেন।মহাদেব সেই মাথা জুড়ে দিয়ে ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে আনলো।মা দূর্গা দূর্গা তখন মহাদেবকে বলেন ছেলের এইরূপের কারণে সবাই একে নিয়ে হাসি মজা করবে।
    তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা , মহাদেব ও অন্যান্য দেবতারা তাকে বর দেয় যে গণেশের পুজো না হলে কোনো পুজো শুরু হবে না।গণেশ পুজো ছাড়া কোনো পুজো সম্পূর্ণ হবে না। এরপর মা দূর্গা তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি গেলেন।

এইভাবে শেষ হলো দূর্গা ষষ্ঠীর ব্রতকথা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ