মাদপুর মহিষা গ্রামের মনসা মন্দিরের কাহিনী


    পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার, খড়গপুর লোকাল থানার তিন নম্বর লজমাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের, গোবিন্দ নগর মৌজার মইষ্যা গ্রামে অবস্থিত বিখ্যাত মা মনসা দেবীর মন্দির। লোকমুখে যা মাদপুরের মা মনসা৷ খড়্গপুর থেকে হাওড়ামুখী রেললাইনের পাশে মাদপুর জকপুরের মাঝামাঝি জায়গায় ফাঁকা মাঠের মাঝে মায়ের অধিষ্ঠান। মাদপুরের মনসা মায়ের নানা মহিমা বহুল প্রচলিত৷ শোনা যায় কেউ কোন কিছু মনস্কমনা করলে সেইচ্ছে মা পূরন করেন৷ সে সন্তান লাভ হোক, কিংবা বেকারত্ব, সাংসারিক কষ্ট, অসুস্থতা থেকে মুক্তি সবকিছুই৷ অনেক সময় বাড়ির গরু, ছাগল হারিয়ে গেলে তাদের ব্যবহার করা গলার দড়ির টুকরো নিয়ে মায়ের কাছে খুঁজে দেওয়ার মনোবাঞ্ছা জানালেও তা পূর্ণ হয়৷ বহুদূর থেকে বহু ভক্ত মায়ের কাছে ছুটে আসেন মানত করতে, কেউ আসেন মানত পূরন করতে। এমনকি পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রেনগুলিও অনেক সময় গতি কমিয়ে দেয়, কখন কখন ট্রেনের চালক ভক্তিভরে মাকে প্রনাম জানিয়ে নিজের পথে চলা শুরু করে৷

    সনাতন ধর্মে মনসা একজন পৌরাণিক দেবী, বঙ্গদেশে যিনি লৌকিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন। তিনি সর্পদেবী। সর্পদংশন থেকে রক্ষা পেতে বা সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে তাঁর পূজা করা হয়। সর্পরাজ বাসুকীর ভগিনী এবং ঋষি জরৎকারুর পত্নী মনসা দেবী বিষহরি, বিষহরা, নিত্যা, পদ্মাবতী ইত্যাদি নামেও পরিচিতা। শ্রাবণ মাসের নাগপঞ্চমী তিথি, শ্রাবণ সংক্রান্তি, ডাক সংক্রান্তি ইত্যাদি বিশেষ দিন ছাড়াও পুরো শ্রাবণ মাস ব্যাপী মনসা দেবীর পূজা প্রচলিত। মধ্যযুগে বিভিন্ন কবির রচিত 'মনসামঙ্গল কাব্য' মনসা দেবী এবং বাংলা সাহিত্য উভয়কেই পরিপুষ্ট করেছে।

    জকপুরের কাছে এই অঞ্চলটি আগে জঙ্গল ছিল, যা মনসার জঙ্গল বলে পরিচিত ছিল। মাদপুরের মহিষা গ্রামের এই মনসা মন্দির প্রায় চারশত বছরের প্রাচীন। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলটি জমিদার যোগেশ্বর রায়ের জবপুর'এর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে একদিন ভোররাতে জমিদার যোগেশ্বর রায় চতুর্ভুজা মাতা মনসার স্বপ্নাদেশ পেয়ে মহিষা গ্রামের ঘনজঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একটি উই'এর ঢিবিতে অবস্থানকারী দেবীকে খুঁজে বের করেন এবং সেই উই'এর ঢিবিতে দেবীর অবস্থান জ্ঞান করে সেখানেই তাঁর পূজার ব্যবস্থা করেন। জমিদার জঙ্গল পরিষ্কার করে ওইখানে মনসা মায়ের নিয়মিত পূজার ব্যবস্থা করেন। মা মনসার থান বলে জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পূজা করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি ছিল। শোনা যায় তার নীচে প্রচুর সাপ থাকত।


    আজ পুরনো গাছগুলি নেই তবে ঐ উইঢিপিটিকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কংক্রিটের লাল পদ্ম এবং উইঢিপি বানানো হয়েছে৷ এই পদ্মফুল দেবী মনসার প্রতীক। উইঢিপির ওপরেই দুধ ঢেলে সিঁদুর মাখিয়ে পূজা করা হয়৷ কথিত আছে এই দুধ কোথায় যায় তা কেউ জানেনা, কারন দুধের নির্গমন দেখা যায় না৷ পূজা প্রতিদিন হলেও, প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার পূজার জন্য মন্দিরে ভিড় হয়৷ নিজের হাতে মায়ের পূজা দেওয়া হয়। কোন পুরোহিতের সাহায্য লাগে না৷ কোন পন্ডার উপদ্রব নেই৷ মন্দির চত্বরেই পূজার সামগ্রীর প্রচুর দোকান আছে৷ ফল, ফুল, দুধ, সিঁদুর, আলতা, ধূপ, মোমবাতি কিনে পূজা দেওয়া যায়৷ মন্দির সংলগ্ন পুকুরে অনেকে স্নান করে দন্ডী মাপেন৷ অনেকে মা মনসার মূর্তি মানত করেন সেই মূর্তি মন্দিরের কাছাকাছি কিনতে পাওয়া যায়৷ মন্দির চত্বরের মধ্যে এরকম মা মনসার প্রচুর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়৷


     জমিদার যোগেশ্বর রায়ের প্রতি দেবী মনসার স্বপ্নাদেশ অনুসারে এখানে পূজা শুরু হয় খোলা আকাশের নিচে। খোলা আকাশের নিচে পুরনো রীতি মেনে আজও মায়ের আরাধনা হয়৷ এটাই নাকি মায়ের আদেশ৷ মা বদ্ধ জায়গায় থাকতে চান না৷ শোনা যায় যতবার মন্দির আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে ততবারই ভেঙ্গে পড়েছে৷ তাই মন্দির চত্বর উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ পাঁচিলের দেওয়ালে মা মনসার নানা কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে৷ মন্দির চত্বরে প্রবেশের প্রধান দরজার সম্মুখে পূজা পরিচালনা কমিটির কার্যালয়৷
    প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক প্রধান অনুষ্ঠান। পূজা উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ ভক্ত জমায়েত হয় মায়ের কাছে। এই সময় মেলা হয় যা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বলে মনে করা হয়। ভিড়ের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গাসাগর মেলার পরেই মাদপুরের এই মেলার স্থান এবং এক দিনের মেলা হিসেবে প্রথম স্থান। এই বিশেষ দিনে গ্রামে অরন্ধন থাকে৷ চক্রবর্তী পদবিধারী ব্রাহ্মণরা পুজা করেন কোন মন্ত্র উচ্চারিত না করে৷ কেবল উনারা উৎসর্গ করেন।এই বিশেষ দিনের বিশেষত্ব হল, সেইদিন এই মন্দিরে প্রায় ৩০,০০০ ছাগল বলি দেওয়া হয় আর মনসা মায়ের মন্ত্রপূতঃ জলে স্নান করিয়ে হলুদ মাখিয়ে প্রচুর পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার রীতি এখানে রয়েছে আর হাঁস সামনের পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ মেলা ও মহাপূজার দিন নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়৷ মন্দির তত্বাবধান ও পরিচালনার জন্য পূজা কমিটি বর্তমান। তবে জমির মালিকানা আজও চাঙ্গুয়াল গ্রামস্থিত চক্রবর্ত্তী ব্রাম্ভনদের বংশধরদের৷ ইনাদের পূর্বপুরুষরা মাদপুরের বাসিন্দা ছিলেন৷



    আজ থেকে ৩০ বছর আগে বিষয়টা অন্যরকম ছিল৷ মায়ের পূজা ও মেলাতে জাঁকজমক থাকলেও এত লোকসমাগম হতো না৷ আশে পাশের অঞ্চলের মানুষদের মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিল৷ সময়ের সঙ্গে মায়ের মাহাত্ম্যের গল্প যত ছড়িয়েছে ভক্তের সংখ্যা ততই বেড়েছে৷ আজ পাশাপাশি জেলা, রাজ্য (উড়িশা, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি) থেকে ভক্তরা আসেন৷ জায়গাটির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে৷ খড়্গপুর থেকে হাওড়ামুখী ট্রেনে মাদপুর স্টেশন মাত্র ১২ কিমি৷ আর জাতীয় সড়ক -৬০ খুব একটা দূরে নয়৷
  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ