মহাতীর্থ পীঠাপুরম সতীপীঠ

 


অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্ব গোদাবরীর তীরেই গড়ে উঠেছে মহাতীর্থ পীঠাপুরম।পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুসারে ৫১ পিঠের অন্যতম এই পীঠাপুরম।সতীর পিঠের খণ্ডাংস পড়েছিল এইস্থানে।সেই থেকেই এই পীঠের নাম পীঠাপুরম।

    অন্ধ্রের মানুষের সমাজজীবন ধর্মীয় জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে রয়েছে গোদাবরী নদী।এই গোদাবরী তীর বরাবর দেখা যায় একাধিক শৈব তীর্থ।তবে সেখানে সমোজ্জল মা পুরোহিতিকা।শোনা যায় এই গোদাবরী ঘাটেই স্নান করতে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।১২ বছর অন্তর পুস্করম মেলা এই গোদাবরী তীরের সংস্কৃতির পরিযায়ক।

বহু সাধনার সাধন ক্ষেত্র এই পুণ্যভূমি।অন্ধ্রপ্রদেশের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে দেবীর মাহাত্ম্য।শৈব ভূমি হিসেবেই পরিচিত দক্ষিণ ভারতের এই মাটি।তার মধ্যেই অপার মহিমা নিয়ে জাগ্রত পীঠাপুরম।মন্দিরে প্রবেশ করার আগেই চোখে পর্বে এক বিশাল তোরণ।তোরণ জুড়ে খোদাই করা নানা দেবদেবীর মুর্তি।মন্দির জুড়েও প্রাচীন ভারতের বহু স্থাপত্য শৈলীর বিকাশ।পাথর কেটে তৈরী হয়েছে দেবদেবীর মুর্তি।মন্দিরে ঢুকলেই চোখে পড়বে কষ্টিপাথরে খোদাই করা দেবী পুরুহুতিকার মূর্তি।

    গর্ভগৃহে পা রাখলেই শান্তিতে ভোরে উঠবে মন।মায়ের এমনই লীলা।চতুর্ভুজা দেবী পুরুহুতিকা।তাঁর একহাতে শস্যবীজ, এক হাতে কুঠার, একহাতে পদ্মফুল ও অন্যহাতে মধু পাত্র।বিগ্রহের নিচে রয়েছে শ্রীচক্র যন্ত্র।সতীর পিঠের অংশ পড়েছিল বলেই পীঠের নাম পীঠাপুরম।


    মন্দির থেকে জানা যায় সতীর পিঠ এখানেই পড়েছিল।সেজন্যই নাম পুরুহুতিকা মাতা।এই মন্দিরের পেছনে একটি মন্দির রয়েছে।সেখানে যে দেবী অধিষ্ঠিত, তিনি ওঁঙ্কারিনী মাতা।দুটো শক্তিপীঠই এক।

    সংসারে চলার পথে কত বাধা।ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন, সত্য বলছি তোমরা সংসার করছো এতে দোষ নেই।তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে।তা না হলে হবে না।একহাতে কর্ম করো, আর এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাকো।কর্ম শেষ হলে দুইহাতে ঈশ্বরকে ধরবে।

    লোভ-হিংসা-পঞ্চরিপুর তাড়নায় ভরা এই সংসার।এই বন্ধন থেকে মুক্তির জন্যই পথ খুঁজচ্ছে ভক্তকুল।মায়ের কৃপাদৃষ্টি যার ওপর পরে সেই নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করে।মায়ের পাদপদ্মে স্থান হয় সেই মহাত্মার।মা পুরুহুতিকার কাছেও সংসারের হাজার সমস্যা নিয়ে হাজির হন ভক্তকুল।মাকে মন থেকে ডাকলে সাড়াও মেলে।

    এই পীঠাপুরম তীর্থভুমির সবথেকে বড়ো আকর্ষণ শ্রী কুক্কুটেশ্বরস্বামী সতীর ভৈরব।স্ফটিকের এই লিঙ্গ দেখার জন্য বহুদূর থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা।


    দেশের অন্যতম প্রাচীন সতীপীঠ এই পীঠাপুরম।মন্দিরে ঢুকতেই রয়েছে ধ্বজাস্তম্ভ ও এক শিলায় নন্দী।সতীপীঠের ভৈরব কুক্কুটেশ্বরস্বামী এখানে স্ফটিক লিঙ্গে আসিল ও স্বয়ম্ভু।

    কুক্কুটেশ্বর মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাসাধক শ্রী পদশ্রীবল্লব স্বামীর মন্দির।গোটা দক্ষিণ ভারত জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই পুণ্যাত্মার নানা অলৌকিক কাহিনী।ঠিক যেভাবে তারাপীঠে বামদেবকে নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা গল্প গাঁথা।পুণ্যভূমি পীঠাপুরমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা পৌরাণিক গল্প।

    কথিত আছে গয়াসুরকে বধ করার পর তার দেহ সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত করেন বিষ্ণু।গয়াসুরের পা পড়েছিল এই পীঠাপুরমেই।তাই পাদ গোয়া হিসেবেও পরিচিত এই সতীপীঠ।বিষ্ণুচক্রে তিনটি খণ্ড হয়েছিল গয়াসুরের দেহ।খণ্ডিত মাথা পড়েছিল বিহারের গয়াক্ষেত্রে।গয়াকে তাই বলা হয় শির গয়া।নাভি পড়েছিল ওড়িশার যাজপুরে।

    দক্ষিণ ভারতের পুণ্যভূমি এই পীঠাপুরমের গুরুত্ব অনেকখানি বেড়েছে এই গয়াসুরের কাহিনী আর জগৎগুরু শ্রীপাদবল্লবের জন্মস্থানের কারণে।

      মায়ের মন্দির মানেই ভক্তকুলের নানা আবদার।মনোবাঞ্ছা পূরণের আকুল আর্তি।সন্তানের মঙ্গোল কামনা থেকে শুরু করে মালাবদল সব শুভ কাজেই মায়ের আশীর্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভক্তরা।মায়ের বরাভয় মূর্তিতেই রয়েছে সেই মঙ্গলের বার্তা।

    পীঠাপুরম থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে পুরুহুতিকা মাতার জন্মভিটে এমনটাই বিশ্বাস ভক্তকুলের।মন্দিরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে মা পুরুহুতিকার কাষ্ঠ মূর্তি।একহাজার বছরের পুরোনো এই মূর্তি।পঞ্চদশ শতকে এই মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়।পরে আবার তৈরী করা হয় দেবীর মূর্তি।এটাই পুরুহুতিকা মায়ের জন্মস্থল।অত্যন্ত প্রাচীন এই মূর্তি।মায়ের জন্মভিটেতে সাকল থেকেই ভক্তদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।হাত জোড় করে মায়ের কাছে সমস্ত ইচ্ছে জানায় ভক্তরা।ভক্ত ও ভগবানের এমন সার্থক মিলনস্থল সত্যিই বিরল।


    সারা দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে সতীপীঠ।এটাই সতীপীঠের কেন্দ্রস্থল।সতী মায়ের মধ্যস্থল অর্থাৎ পিঠ এখানেই পড়েছিল। 

সন্ধ্যে নামলেই শুরু হয় মন্দিরে সন্ধ্যাআরতি।মায়ের আরতি এখানে খুবই জনপ্রিয়।কালো মেয়ের রূপের ছটায় ভোরে ওঠে পুরুহুতিকার মন্দির।রাতের অন্ধকারেও প্রদীপ শিখায় জেগে থাকে মা পুরুহুতিকা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ