বিস্ময়কর কোনার্ক সূর্য মন্দির

     


ভারতবর্ষ যাকে বিশ্বের গুরু হিসেবেও মানা হতো।ভারতের অন্যান্য রাজ্য গুলির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো ওড়িশা।প্রাচীনকালে যা কলিঙ্গ নামে পরিচিত ছিল।কোনার্ক সূর্য মন্দির তেরো শতাব্দীতে নির্মিত একটি বিখ্যাত ভারতীয় মন্দির।প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্বগঙ্গ রাজবংশের প্রথম নরসিংহদেব এই মন্দির ঋণমান করেন।মন্দিরটি একটি বিশাল রথের আকারে তৈরী করা হয়েছে।মন্দিরটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহিস্থান এবং ভারতের ৭টি আশ্চর্যের মধ্যে রয়েছে।মন্দিরটি পুরি থেকে ৩৫ কিমি ও ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত।কোনার্ক নামটি সংস্কৃত 'কোন' ও 'অর্ক' শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত।যা মন্দিরে উল্লেখিত সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের অর্থ বহন।

    কলিঙ্গের কঙ্গো সাম্রাজ্যের রাজা নরসিংহ দেব মাত্র ১৮ বছর বয়সে কাকতীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা গণপতিদেবের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন।প্রায় ৩ বছর ধরে নরসিংহদেব নিরন্তর যুদ্ধ করতে থাকেন।যুদ্ধে রাজা গণপতিদেব পরাজিত হয়।যুদ্ধ জয় করে যখন নরসিংহদেব প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরছিলেন তখন তার জন্য রাজ্যে খুব বড় সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়।রাজ্ মাতা কস্তুরীদেবী পুত্র নরসিংহদেবের বীরত্ব দেখে খুবই মুগ্ধ হন।তিনি পুত্র নরসিংহদেবকে নিজের মনের আশার কথা জানান।তিনি বলেন তোমার পিতা শঙ্খক্ষেত্র পুরীতে ভগবান জগন্নাথ দেবের মন্দির স্থাপন করেছিলেন।কিন্তু আমি চাই তুমি অর্ক ক্ষেত্র কোনার্ক-এ ওর থেকেও সুন্দর ও বিশাল সূর্য মন্দির স্থাপন করো।নরসিংহদেব মাতা কস্তুরী কে প্রশ্ন করেন সূর্য মন্দির কেন? কোনার্ক স্থানেও বা কেন?

    মাতা উত্তরে বলেন, দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পুত্র সাম্য খুবই সুশীল ও সুন্দর ছিলেন।সাম্য সর্বদা নারদমুনিকে বিরক্ত করতো।একদিন নারদমুনি সাম্যকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল করেন।নারদমুনি সাম্যের রূপের প্রশংসা করতে করতে গোপীদের সাথে জলের মধ্যে খেলার পরামর্শ দেন।অপরদিকে নারদমুনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে বলেন সাম্য তার মাতৃসম গোপীদের সাথে জলক্রীড়া করছেন।এই কথা শুনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ খুবই রেগে যান।তৎক্ষণাৎ পুত্র সাম্যকে অভিশাপ দিয়ে বলেন, যে সুন্দর রূপের কারণে তোমার এতো গৌরব তা এখুনি নষ্ট হয়ে যাবে।সাম্যের কুষ্ঠ রোগ হয়।সময় রাজমহলে ফিরে আসে।মাতা জাম্ববতী যখন এই কথা জানতে পারেন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপের কারণে পুত্রের এই দুর্দশা হয়েছে তখন রানীরা খুব ক্রোধিত হয়ে যান।সবশেষে নারদমুনিকে আওহ্বান করা হয়।নারদমুনি রোগ নিবারণের উপায় বলে দেন।তিনি বলেন সূর্যের প্রথম কিরণ কোনার্কে পড়ে।সাম্যকে এখুনি ঐস্থানে গিয়ে সূর্যদেবের আরাধনা করতে হবে।তবেই সাম্য এই রোগ থেকে মুক্তি পাবে।

    অনেক বড় ও কঠিন যাত্রার পর সাম্য কোনার্কের চন্দ্রভাগা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হয়।অন্ন-জল ত্যাগ করে ১২ বছর কঠোর তপস্যার পর সূর্যদেব তার সামনে প্রকট হন এবং সময়কে রোগমুক্ত হওয়ার বরদান করেন।স্নান করার পর সাম্য যখন যদি থেকে বাইরে আসে তখন সে রোগ মুক্ত হয়ে যায়।তখন তার হাতে একটি পাথর খন্ড ছিল।তার সুন্দর শরীর দেখে তার অনুচরেরা ও সেবকরা আনন্দিত হয়।সময় সেই পাথরটিকে সেইস্থানে রেখে একটি ছোট মন্দির তৈরী করে।যখন সে জানতে পারে সূর্য পূজার বিধিবিধান এখানে কেউ জানে না তখন সে আবার সূর্যদেবের তপস্যা শুরু করে।সূর্যদেব আবার প্রকট হন এবং সাম্যকে বলেন দূর পশ্চিমের সার্কের দেশ (ইরান) এর মাগা ব্রাহ্মণ সূর্যপূজার বিধিবিধান জানে।এই কথা শুনে সাম্য সেইখানে যায়।দীর্ঘ ১৮ মাসের পরিভ্রমণের পর ১৮ মাগা ব্রাহ্মণ পরিবারকে সাথে নিয়ে কোনার্কে ফিরে আসে।তারপর থেকে সূর্য মন্দিরে পূজা শুরু হয়।

    মাতা কস্তুরীদেবী নরসিংহদেবকে বোঝান, বিবাহের বহুবছর পর যখন তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।তখন তিনিও সেই মন্দিরে পূজার্চনা করেছিলেন।তখনি তিনি নরসিংহদেবকে পুত্র রূপে লাভ করেন।এই কথা শুনে নরসিংহদেব তার মা-কে কোনার্কে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও বিশাল মন্দির তৈরী করার কথা দেন।

    সদাশিব সামন্ত্রাই মহাপাত্র যিনি সিবেসন্ত্রাই নাম লোক প্রিয় ছিলেন।তিনি তার সঙ্গী বিশু মহারানার সাথে মন্দিরের প্রতিরূপ তৈরী করেন এবং রাজা নরসিংহদেবের সামনে প্রস্তুত করেন।নরসিংহদেব মন্দিরের প্রতিরূপ দেখে অভিভূত হয়ে যান।তিনি শীঘ্রই মন্দির নির্মাণের আদেশ দেন।দূর দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসা হয়।মন্দির নির্মাণের কার্য দ্রুত হতে থাকে।১২০০ কারিগর মিলে ১২ বছরে এই বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন।কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও ওই মন্দিরের চূড়ায় একটি কলস স্থাপন করা যাচ্ছিলো না।যা কিছু চুম্বকীয় পদার্থ দিয়ে টোরি ছিল।অপরদিকে রাজা নরসিংহদেব আদেশ দেন যে কাল রাতের মধ্যে যদি কলস স্থাপন না হয় তাহলে ১২০০ কারিগরের শিরোচ্ছেদ করা হবে।এই কথা শুনে সমস্ত শিল্পীরা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান।

    মুখ্য শিল্পী বিশুমহারানা এখানে আসার আগে একটি পুত্র সন্তান হয়েছিল।তার নাম ছিল ধর্মপদ।সবাই তাকে আদর করে ধর্ম বলে ডাকতো।ধর্ম সূর্যমন্দিরের প্রতিরূপের মাথায় কলস বসিয়ে প্রসন্ন হয় এবং পিতাকে দেখানোর জন্য মায়ের কাছে জেদ করে।তখন ধর্মপদর মা বাগানের কিছু ফল একটি পুটলিতে দেয় এবং তাকে কোনার্ক যেতে বলে।

    ধর্মপদ কোনার্ক পৌঁছায়।সেখানে পৌঁছে ধর্ম তার পিতাকে চিনতে পারে এবং তাকে প্রণাম জানায়।সমস্ত কারিগরদের চিন্তিত দেখে ধর্ম এর কারণ জানতে চায়।কারণ জেনে ধর্ম তার পিতাকে বলে, আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন আমি মন্দিরের চূড়ায় কলস স্থাপন করতে পারি।সিবেসন্ত্রাই ধর্মপদকে অনুমতি দেন।কিছুক্ষন চেষ্টার পর সে কলস স্থাপনে সফল হয়ে যায়।কলস স্থাপন হওয়ার পর সূর্যদেবের মূর্তি চুম্বকীয় আবেশের ফলে হওয়ায় ভাসতে থাকে।এই ডেকে অনেক কারিগর খুশি হয়ে যান।কিন্তু কিছু কারিগর এই বিষয়ের বিরোধিতা করেন।তারা বলে কাল যখন রাজা সমস্ত কথা জানতে পারবে যে কাজ ১২০০ কারিগর করতে পারেনি সেই কাজ এক ১২ বছরের বালক করে দেখিয়েছে।এতে রাজা অবস্যই সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন।

    এই কথা শুনে ধর্মপদ নির্ণয় করে তার জীবনের থেকে অধিক মূল্যবান ১২০০ কারিগরের জীবন।ধর্মপদ তার পিতাকে বোঝালো এবং মন্দিরের চূড়া থেকে পাশের সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়।এর কিছু সময় পরে রাজা নরসিংহ দেব মন্দিরের সামনে উপস্থিত হন।সূর্যদেবের প্রতিমাকে হাওয়ায় ঝুলতে দেখে তিনি খুব খুশি হন।তিনি ঘোষণা করেন মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী তিথিতে মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করা হবে।শিবসন্ত্রাই বলে, রাজা তিথি খুবই ভালো কিন্তু মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য এটা উচিত সময় নয়।কিন্তু রাজা নরসিংহদেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

    নির্দিষ্ট তিথিতে মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়।কিন্তু কিছু সময় পরে এই মন্দিরে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে।মন্দিরে লাগানো এক বিশাল সিংহের মূর্তি পরে যায়, মন্দির থেকে অনেক পাথর ও পরে যেতে থাকে।তারপর নরসিংহদেব যখন জানতে পারেন মন্দিরের প্রথম দিন এক ১২ বছরের বালকের মৃত্যু দিয়ে শুরু হয় তখন এই মন্দিরে পুজো বন্ধ করেও দেওয়া হয়।

    ১৮০০ শতক নাগাদ এই মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকে।এই মন্দির এবং এর আশেপাশের এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছিলো।জলদস্যু ও ডাকাদের আস্তানায় পরিণত হয় কোনার্ক মন্দির।৩০০ বছর ধরে বালির স্তুপের নিচে অনাদর ও অবহেলায় পরে থাকা এই সূর্য মন্দিরটিকে ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন উদ্ধার করেন।

    এই মন্দিরের চৌম্বকীয় শক্তি সমস্ত জাহাজকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতো।এই চুম্বক লাভের জন্য অনেক যুদ্ধ হয়।

আজ আমরা কোনার্ক সূর্যমন্দিরে যা দেখতে পাই তা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ মাত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ