দেবী মনসার পূজা বিধি ও মঙ্গলকাব্য



  • মনসা পূজার সময়কাল:

     আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর যে পঞ্চমী তিথি (শ্রাবণ) তাকে নাগপঞ্চমী বলে। নাগপঞ্চমীতে উঠানে সিজগাছ স্থাপন করে মনসা পূজা করা হয়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী পর্যন্ত পূজা করার বিধান আছে।ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে একমাস যাবত্‍ পূজা করে পূজাসমাপনান্তে বিশেষভাবে পুজো করা হয়। শুধুমাত্র শেষ দিনে পুরোহিত দ্বারা পূজা করা হয়। উল্লেখ্য, নাগকুল কশ্যপমুনির জাত যা সাধারণ সাপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অধিক শক্তিশালী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন। যেমন- বাসুকি, অনন্ত, শিষ নাগ প্রভৃতি।ভগবান বিষ্ণুর মস্তকের উপরে থাকেন শিষ নাগ।

  • মঙ্গলকাব্য:

    মনসা মূলত একজন আদিবাসী দেবতা।নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল।পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে।বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীরূপে  পূজিত হন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে সর্পজাতির পিতা কাশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে।খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে, মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন।কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিত হন।তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন।শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলস্রুতি।এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন।মহাদেব শিব তাঁকে কৃষ্ণ-আরাধনার উপদেশ দেন। মনসা কৃষ্ণের আরাধনা করলে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তাঁকে সিদ্ধি প্রদান করেন এবং প্রথামতে তাঁর পূজা করে মর্ত্যলোকে তাঁর দেবীত্ব প্রতিষ্ঠা করার উপদেশ দেন।ভগবানের নির্দেশে মনসা মর্ত্যে নেমে আসেন মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে মানুষ তাঁকে উপহাস করত।কিন্তু যারা মনসার ক্ষমতা অস্বীকার করল, তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে। মনসা তাদের বাধ্য তাঁর পুজো করার জন্য।মুসলমান শাসক হাসানের মতো বিভিন্ন জাতি-উপজাতির মানুষকে মনসা তাঁর ভক্ত করে তুললেন।কিন্তু চাঁদ সদাগর তাঁর পূজা করলেন না।মনসা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো একজন দেবী হতে চাইছিলেন।কিন্তু তাতে সফল হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের হাতে পূজাগ্রহণ তাঁর কাছে বাধ্যতামূলক ছিল।কিন্তু চাঁদ ছিলেন শিবের উপাসক।তিনি সঙ্কল্প করেছিলেন, তিনি মনসার পূজা করবেন না।মনসা চাঁদকে ভয় দেখানোর জন্য একে একে চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করলেন।যে সপ্তডিঙা নিয়ে চাঁদ বাণিজ্যে গিয়েছিলো তাও জলে ডুবে যায়।শেষে মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক-নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন।এঁদের নাম ছিল ঊষা ও অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ চাঁদ ও তাঁর স্ত্রী সনকার সপ্তম পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করলেন।তাঁর নাম হল লখিন্দর। ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করলেন।লখিন্দর ও বেহুলার বিবাহ হল।মনসা বাসর ঘরে লখিন্দরকে বিষধর সাপ দিয়ে হত্যা করলেন।কিন্তু বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নদীতে ভেসে চললেন।শেষে তিনি চাঁদের সাত পুত্রের প্রাণ ও হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করার উপায় জেনে ফিরে এলেন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়েই বাঁ হাতে তাঁর দিকে ফুল ছুঁড়ে দিলেন।মনসা এতেই খুশি হলেন। তিনি চাঁদের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দিলেন এবং তাঁর হারানো সম্পদও ফিরিয়ে দিলেন।মঙ্গলকাব্যে রয়েছে, এরপর মনসার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেল।
মনসামঙ্গলকাব্যে রয়েছে, পূর্বজন্মে মনসা চাঁদকে বিনা কারণে অভিশাপ দিয়েছিলেন।তাই চাঁদও মনসাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তিনি মনসার পূজা না করলে, মনসাপূজা মর্ত্যে জনপ্রিয়তা পাবে না। এই কারণেই, ভক্তদের পূজা পেতে  মনসার অসুবিধা হচ্ছিল।এরপর মনসা বা পদ্মা ‘শক্তি’র একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং শৈবরা তাঁর পূজা স্বীকার করে নেন।তিনি ঈশ্বরের মাতৃকাশক্তির এমন একটি ধারা, যাঁকে অনেক ভক্ত দূরবর্তী ও নির্গুণ শিব ধারণার থেকে নিকটতর ও প্রিয়তর মনে করেন।

  • দেবী মনসার ধ্যান মন্ত্র :

    
ওঁ দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাম্ । হংসারূঢ়মুদারামস সুললিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব ।। স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কনকমণিগণৈর্মুক্ তয়া চ । প্রবালৈর্বন্দেহ হং সাষ্টনাগামুরুকু চগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্ ।।

  • দেবীর প্রণাম মন্ত্র:

ওঁ অযোনিসম্ভবে মাতর্মহেশ্বরসুতে শুভে ।
পদ্মালয়ে নমস্তুভ্যং রক্ষ মাং বৃজিনার্ণবাত্ ।
আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা ।
জরত্কারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তু তে ॥

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ