নবদ্বীপের পোড়ামাতলার ইতিহাস

 


প্রায় ১০০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস ধারাকে ধরে নিয়ে চলছে নদিয়া জেলার নবদ্বীপ শহরটি।১১৫৯ - ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেন রাজা বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেনের রাজত্বে নবদ্বীপ ছিল বাংলার রাজধানী।ষোড়শ শতাব্দীর আগে গঙ্গানদী প্রবাহিত হত নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়ে যা এখন পূর্বদিকে সরে গিয়েছে।১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ওপার বাংলা থেকে বহু শরণার্থী এসে আশ্রয় নেয় এই নবদ্বীপে।শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বহু লীলাগাঁথার সাক্ষী এই নবদ্বীপ।নবদ্বীপের অর্থনীতি এখন প্রায় পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।প্রাচীনকাল থেকেই এই নবদ্বীপে ঘটেছে বহু আশ্চর্যকর ঘটনা।সেইরকমই একটি স্থান হলো পোড়ামাতলা।

    নবদ্বীপের পোড়ামাতলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্দির।এই মন্দিরে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো প্রবেশ করে না।এই মন্দিরের পরিবেশ খুবই অদ্ভুত ধরণের।যেহেতু সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করে না তাই মন্দিরটিকে খুবই রহস্যময় বলে মনে করা হয়।প্রাচীন এই মন্দিরের সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে বহু পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী।


    এখানে বাসুদেব সার্বভৌম এখানে সাধনা করেছিলেন।তিনি এখানে একটি করে মোমবাতি জ্বালাতেন।এই স্থানেই মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

    প্রিয়দত নামের এক তন্ত্রসাধক ও সিদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন এই নবদ্বীপে।তিনি একসময় এইখানের এক বনের মধ্যে দেবী কালীকা কে স্থাপন করেছিলেন একটি ঘটের মধ্যে।এই ঘটেই তিনি নিষ্ঠাভরে পুজো করতেন যথা নিয়মে।প্রিয়দত মারা গেলে পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম।তিনি বন থেকে দেবীর ঘটটিকে এনে একটি বট গাছের নিচে পুনঃস্থাপন করেন।কিন্তু হটাৎ একদিন বাজে পরে প্রচন্ড অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় সেই গাছটি।সে থেকে দেবী হয়ে গেলেন পোড়ামা ভবানী।এরপর নবদ্বীপের বাজারে প্রাচীন একটি বটগাছের গোড়ায় ছোট্ট একটি মন্দিরে স্থাপিত হলো সেই কালীকামাতা ঘট এবং চলতে থাকে আগের মতোই নিষ্ঠাভরে নিত্যপূজা।

    প্রাচীন এই মন্দিরের সূষ্টি নিয়ে অন্য একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।ধাত্রী গ্রাম ও বিল্ব গ্রামের ২জন সাধক এখানে এসে কঠোর তপস্যা শুরু করেন।তারা বাগদেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ পায়।এই ঘটনার কিছুদিন পর তিন ব্রাহ্মণ ও নয়ঘর চাষী নিয়ে রাজা কাশীনাথ এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।এখানে তিনি আগুন লাগিয়ে জঙ্গল পুড়িয়ে দেন।তারপর এখানে বসতি স্থাপন করেন।সেই আগুনেই ভস্মীভূত হয় দেবীর স্থান সহ বটগাছটিও।তারপর থেকে দেবী এখানে পোড়ামা নামে সুপ্রসিদ্ধ।

    বিশিষ্ট লেখন ক্রান্তিচন্দ্র রানীর লেখা থেকে জানা যায় রাজা লক্ষণ সেন রাজ্য হারানোর ১০০ বছর পরে এক তান্রিক এই বটগাছের গোড়ায় পোড়ামায়ের ঘটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    নদিয়া কাহিনী বইটিতে পাওয়া যায় অন্য এক কথা।তান্ত্রিক পৌরানন্দগিরি পরমহংস গ্রামের প্রান্তে ঘটের প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি বেদ-বেদান্ত আগম ও তন্ত্র শাস্ত্রের বিশিষ্ট পন্ডিত ও তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ ছিলেন।কথিত আছে এই সন্ন্যাসী নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ কুমারের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দীক্ষা দেন।কিন্তু দীক্ষা দিতে গিয়ে ভুল করে তাকে তার নিজের সিদ্ধ মন্ত্র বলে ফেলেন ভুলবশত মন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় সন্ন্যাসী ভেঙে পড়েন।তখন তিনি তার শিষ্যকে বটবৃক্ষমূলে তার স্থাপিত ঘটে মা দক্ষিণাকালীর পুজো করার উপদেশ দিয়ে চিরকালের জন্য নবদ্বীপ ত্যাগ করেন।তখন থেকেই দেবীকে নবদ্বীপবাসীরা পুজো করে আসছে।তার কিছুকাল পরেই ভয়ংকর এক অগ্নিকান্ডে সেই বটবৃক্ষ পুড়ে যায়।তারপর থেকে এই জায়গার নাম হয়ে যায় পোড়াবটতলা ও দেবীর নাম হয়ে যায় পোড়ামা।


    আবার দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ওই থেকে পাওয়া যায় যে এখানে একবার এক শাক্ত সাধক ও বৈষ্ণব সাধকের মধ্যে শাস্ত্রীয় তর্ক যুদ্ধ বাঁধে।সেই তর্ক যুদ্ধের শর্ত ছিল পরাজিত ব্যক্তি বিজয়ীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন।সেই তর্ক যুদ্ধে শাক্ত সাধকের পরাজয় ঘটে।নিয়ম মতে যখন তিনি ইস্ট মন্ত্র ত্যাগ করতে যান তখনই এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় সাধকের মন্দির।সেই সময় দুই সাধক দেখতে পান মন্দিরের মধ্যে দেবীর কোলে বসে আছেন গোপাল।প্রচন্ড আগুনে সবকিছু পুড়ে গেলেও মন্দিরের দুটি ইঁট অক্ষত ছিল।আর সেই দুটি ইঁটের ওপর ঘট স্থাপন করে পোড়ামাতলার পুজো শুরু হয়।

    অনেকে আবার বলেন সম্রাট হুসেন শাহের আমলে যখন নবদ্বীপে বহু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল তখন হুসেন শাহের সেনারা এখানকার একটি জাগ্রত শক্তি মন্দিরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।সেই মন্দিরের দেবীই হলেন এই পোড়ামা।

    আবার এও সোনা যায় কালাপাহাড় পোড়ামা মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।তবে এই কিংবদন্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রমান পাওয়া যায়নি।

    তবে এই মন্দিরের সর্বোত্তম কাহিনীটি হলো বাসুদেব সার্বভৌমর মূর্খ থেকে পন্ডিত হওয়ার কাহিনী।বাসুদেব সার্বভৌম ছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন বেদান্ত ও ন্যায়শাস্ত্র বিচারক।কথিত আছে, সার্বভৌম প্রথম জীবনে ছিলেন মূর্খ।পড়াশোনাতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।এতে তার পিতা মহেশ্বর ভট্টাচার্য্য খুব বিরক্ত ছিলেন। একবার স্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় তিনি উত্তেজিত ভাবে স্ত্রীকে বলেন অমন ছেলের মুখে চাই দিতে হবে।স্ত্রীও স্বামীর বাক্য মান্য করার জন্য বাসুদেবের খাবার থালায় খাবারের সাথে একমুঠো চাই দিয়ে দেন।এতে বাসুদেব মনে খুব কষ্ট পায়।তখনি সে কবরের থালা সরিয়ে রেখে গৃহত্যাগ করে।সে মনে মনে চিন্তা করে কি হবে এই ব্যর্থ জীবন রেখে।তিনি ভাগিরথীতে আত্মবিসর্জনের সিদ্ধান্ত নেন।সেইমত তিনি চলে আসেন গঙ্গার ঘটে।কিন্তু তার আর আত্ম বিসর্জন দেওয়া হয় না।তিনি গঙ্গায় নাম মাত্র দৈববাণী শুরু হয়।"তুমি আত্মবিসর্জন করো না।আমার বরে তুমি মহাপণ্ডিত হবে।নবদ্বীপ তগধবনে আমি ঘটে রূপে অবস্থান করছি।তুমি আমাকে গ্রামের মধ্যে এনে প্রতিষ্ঠা করো ও আমার পুজোর ব্যবস্থা করো।আমার বোরে তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে"।এরপরেই বাসুদেব ঘটটিকে বন থেকে এনে এইস্থানের এক বটগাছের কোটরে স্থাপন করেছিলেন।তারপর তিনি শুরু করেছিলেন কঠোর সাধনা।তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন মহা শ্রুতিধর পন্ডিত।তাই পোড়া শব্দটি হয়তো এখানে পড়া শব্দের অপভ্ৰংশ।

    এই পোড়ামাতলা মন্দিরের কাছে রয়েছে আরো দুটি মন্দির।মা ভবতারিণী মায়ের মন্দির ও ভবতারণ শিবের মন্দির।১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা গিরিশচন্দ্র এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।আবার অনেকে মনে করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।


    ২০০ বছরের প্রাচীন মন্দিরে ৩৫০ বছরের পুরোনো এই মা ভবতারিণীর মূর্তি।নদিয়ার সিংহাসনে তখন কৃষ্ণনগর রাজ্ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের পুত্র রাঘব।ধর্মপ্রাণ রাজা রাঘব তার রাজত্বের শেষ পর্বে নবদ্বীপে গঙ্গার ধরে শিব ও গণেশের জোড়া মন্দির সহ মূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে।১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠার অল্পকালের মধ্যেই মারা গেলেন রাঘব।পাশে প্রকান্ড শিব মন্দিরের কাজ তখনও শেষ হয়নি।অসম্পূর্ণ সেই কাজ শেষ করলেন তার পুত্র রুদ্র রায়।পিতার নাম অনুসারে সেই শিবের নাম রাখা হয় রাঘবেশ্বর।এরপর কেটে যায় প্রায় ১০০ বছর।১৭৬০ সালে নবদ্বীপে গঙ্গার  ভাঙ্গন দেখা দেয়।তখন গঙ্গা শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বইতো।সেই ভাঙ্গনের ফলে ওই জোড়া মন্দির নদী গর্ভে যাওয়ার উপক্রম হয়।তখন কৃষ্ণনগরে রাজত্ব করছেন প্রতাপশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।তিনি তৎক্ষনাৎ মন্দির থেকে বিগ্রহ দুটি সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।নগরের মধ্যে স্থানান্তরিত করা হয় বিগ্রহ দুটিকে।নতুন করে পুজো শুরু করার আগে উঠল আপত্তি।স্থানান্তরের সময় বিশালাকার দুই বিগ্রহ বহু মানুষের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে গেছে।তাই শোধন না করে পুজো করা যাবে না ওই বিগ্রহে।পন্ডিতেরা বিধান দেন ১২ বছর মাটির নিচে পুঁতে রাখলে নাকি দেবত্ব ফিরে পাবে গণেশ এবং শিব মূর্তি।তাই ওই সময়ে ওই দুটি মূর্তিকে পুঁতে রাখা হয় মাটির তলায়।কিন্তু ১২ বছর কেটে গেলেও মাটির নিচ থেকে তোলা হয়নি সেই দুটি বিগ্রহকে।বহু বছর কেটে যাওয়ার পর সেই মূর্তিদ্বয়ের খোঁজ পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পপৌত্র গিরিশচন্দ্রের আমলে। ১৮০২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন।তারই উৎসাহে মাটির নিচ থেকে তোলা হয়েছিল মূর্তি দুটিকে।মাটির তোলা থেকে মূর্তি তোলার সময় গণেশের শুঁড় ভেঙে যায়।অঙ্গহানি হয়ে যাওয়ায় ওই গণেশের মূর্তি পুজোর অযোগ্য বলে বিবেচিত হলো।রাজার ইচ্ছায় ও পন্ডিতদের পরামর্শে এক শিল্পী সেই ভাঙা গণেশ মূর্তি থেকে তৈরী করলেন মহারাজ গিরিশচন্দ্রের আরাধ্য দেবী আনন্দময়ীর মূর্তি।তার নামকরণ হলো ভবতারিণী।নবদ্বীপের পোড়ামাতলার একদিকে প্রতিষ্ঠা হলো মা ভবতারিণীর অন্যদিকে সেই শিবলিঙ্গ।যার নতুন নামকরণ হলো ভবতারণ শিব।সময়টা ছিল ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ