মা মনসার পাঁচালি


মা মনসার পাঁচালি


চম্পক নামেতে এক বিখ্যাত নগর।
সেথায় বসতি করে রাজা চন্দ্রধর॥
মনসার সহিত বাদ করে অবিরাম।
দেবীর কোপেতে হারাইল যশ নাম॥
মনোকষ্ট পায় তবু দম্ভ নাহি ছাড়ে।
তবু ও সে মূঢ়মতি পূজা নাহি করে॥
একে একে হারাইল ছয়টি কোঙর।
শক্তিধর, যাত্রাধর আর পুত্র দুর্গাধর॥
সনকা তাহার পত্নি অতি গুণবতী।
সদা ধর্মপরায়ণা পতিব্রতা সতী॥
আড়াল করিয়া পাতি পদ্মা ঘটবারি।
করয়ে মনসা পূজা, মিলি যত নারী॥
সনকা সনকা বলে ডাকি উচ্চঃস্বরে।
উপণীত হইলা সাধু গিয়া পুজা ঘরে॥
ভাঙিল পূজার ঘট পদাঘাত করি।
যেই ঘটে অধিষ্ঠিত ছিলা বিষহরি॥
ভাঙা ঘট হাতে লয়ে সনকা বেণেনী।
দুই অক্ষি হইতে তার ঝরে অশ্রুপানি॥
হেনকালে অন্তরীক্ষে বজ্রসম দ্যুতি।
বিকট হাসিতে কম্প দেবী পদ্মাবতী॥
রক্তবর্ণা পদ্মাবতী অগ্নিলোচন।
মনসার কোপে পরে কোটিশ্বর নন্দন॥
সপ্ততরী সাজাইয়া বাণিজ্য তে গেল।
মনসার রোষে ডিঙার ভরাডুবি হল॥
একে একে হারাইল ধন জন মান।
সর্বহারা ভিখারী সে না পায় স্থান॥
এত ভাবি পদ্মাবতী চিন্তিত অন্তর।
কি রূপে হইবে পূজা চম্পক নগর॥
এদিকে আনন্দ মুখর ইন্দ্রের ভবন।
ঊষা অনিরুদ্ধ সেথায় নাচে দুইজন॥
নৃত্য হেরিবারে দেবী উপস্থিত হইল।
দেবীর কপটে তাদের তালভঙ্গ হইল॥
তালভঙ্গ দেখি ইন্দ্র দিল মহাশাপ।
যাও যাও মর্ত্যধাম দিলাম অভিশাপ॥
ইহা শুনি স্বর্গমধ্যে সেই দুইজন।
মনঃতাপ পায় দোহে হইলা অচেতন॥
চেতন করায় পদ্মা দিয়া গঙ্গাজল।
নিরন্তর দুইজনে ঝরায় অশ্রুজল॥
পদ্মা বলে শুনো দোহে আমার বচন।
পূজা প্রচারিতে করো মর্ত্যে গমন॥
মর্ত্যধামে গমন করিলা অতঃপর।
ঊষা-অনিরুদ্ধ জন্মে মর্ত্যের ভিতর॥
ঊষা জন্মে মর্ত্যলোকে হইয়া বেহুলা।
লক্ষিন্দর নামে অনিরুদ্ধ জন্ম নিলা॥
দিনে দিনে বাড়ে যেন পূর্ণশশীকলা।
শুভক্ষণে উভে মিলি বিবাহ করিলা॥
কপালের লিখা কভু খন্ডানো না যায়।
বাসরের রাতে পতি কালিনাগে খায়॥
ওঠো ওঠো প্রাণপ্রিয়া কতো নিদ্রা যাও।
বিষম জ্বালা করে চক্ষু মেলি চাও॥
পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করে বর লক্ষিন্দর।
তবু ও না জাগে বধূ নিদ্রায় কাতর॥
এইমতে লক্ষিন্দর পরাণ ত্যাজিল।
সর্বঅঙ্গে কালকূট ছড়িয়া পরিল॥
চৈতন্য পাইয়া ওঠে শাহের কুমারী।
ততক্ষণে লক্ষিন্দর গেল যমপুরী॥
মরা স্বামী কোলে লইয়া বেহুলা নাচনী।
দুই অক্ষি হইতে তার ঝরে অশ্রুপানি॥
নববধূর বেশ-ভূষা যেন ছন্নছাড়া।
সতী নারী পতি বিনা যেন প্রাণ হারা॥
পুত্র হারাইয়া কান্দে সনকা সুন্দরী।
পুত্রের মরণে যেন শূন্য হল পুরী॥
পদ্মাবতীর কোপে গেল চাঁদের নন্দন।
তথাপি না পূজে চাঁদ মনসার চরণ॥
চারিদিকে যত লোক ছিল সেইখানে।
সকলে তাহারে দোষে পুত্রের মরণে॥
এত শুনি বিপুলা যে লাগে বলিবারে।
পতি লয়ে যাব আমি দেবের নগরে॥
কলাগাছ কাটি আনে বান্ধিবারে ভেলা।
সেই ভেলা ভাসি যাবে সুন্দরী বেহুলা॥
ভেলায় ওঠিল সতী যাবে সুরপুরে।
মনসা স্মরিয়া রামা যাত্রা শুরু করে॥
পথমধ্যে নানা বাধা নানা বিপর্যয়।
মনসার বরে সর্ব বিঘ্ন দূর হয়॥
গাঙুরের জলে রামা ভাসিতে লাগিল।
পচা মরা বাসি দেহ কঙ্কাল হইল॥
ধোপানীর ঘাটে পৌঁছে বেহুলা সুন্দরী।
সেথায় কাপর কাঁচে মহেশ কুমারী॥
বিপুলায় বলে ধরি তোমার চরণ।
ইহা শুনি ধোপানীর আহ্লাদিত মন॥
বিপুলাকে হেরি নেতা প্রসন্ন হইল।
শতখানি চুম্ব দিয়া আদর করিল॥
নেতা বলে শুনো রামা আমার বচন।
যত্ন করি ধৌত কর দেবের বসন॥
বস্ত্র ধৌত করি সতী বলে ঘাট হতে।
ধুইলাম যত বস্ত্র উত্তম রূপেতে॥
শুষ্ক করি যত সব দেবের বসন।
পদ্মার বস্ত্রের কথা শুন দিয়া মন॥
শুখায়ে তাঁহার বস্ত্র বহু যত্ন করি।
বস্ত্র মধ্যে লিখে যেন দেখে বিষহরি॥
বংশাবলি লেখে রামা বস্ত্রের ভিতরে।
ছয়টি ভাসুর আর শ্বাশুড়ী শ্বশুরে॥
তারপর লিখি দিল মনের আকুতি।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো দেবী পদ্মাবতী॥
একে একে লিখে রামা যতেক ঘটনা।
পদ্মার চরণ বিনে অন্য নাহি জানা॥
অবশেষে লিখিলেক সহস্র প্রণাম।
বিপদ ভঞ্জিতে করো মা মনসার নাম॥
দেবের বসন যত লইল বান্ধিয়া।
উপণীত হইল দোহে স্বর্গধামে গিয়া॥
পরিচয় দিল গিয়া মোর বোন ঝি।
পরিচিয় করাবারে স্বর্গে আনিয়াছি॥
বস্ত্র দেখি পদ্মাবতী পারিল বুঝিতে।
বস্ত্র মধ্যে এতো লেখা কার হস্তে তে॥
সভামধ্যে কহে সতী মনের যা আশা।
সবাকার শত্রু নাশ করেন মনসা॥
বেহুলার বাক্যে দেব লাগিল বলিতে।
পতি প্রাণ ফিরে পাবে শর্ত পশ্চাতে॥
নৃত্য করি তুষ্ট যদি করিবারে পার।
ধনে জনে পতি লয়ে গৃহে যেতে পার॥
শর্ত শুনিয়া রামা লাগে বলিবারে।
পতি জিয়াইতে পারি সব করিবারে॥
অতঃপর নৃত্যসাজ করিল ধারণ।
বেহুলার নৃত্যে তুষ্ট যত দেবগণ॥
অতঃপর বর মাগে শাহের কুমারী।
পতি জিয়াইয়া দেও যাই নিজ পুরি॥
বেহুলার বাক্য শুনি যত দেবগণ।
করযোড়ে মনসারে করিল স্মরণ॥
স্বর্গমধ্যে পদ্মাবতী প্রকটিত হইল।
সেথায় বেহুলা তাঁর চরণ ধরিল॥
চরণ ধরিয়া রামা কান্দে উচ্চঃস্বরে।
তুমি বিনে মোর দুঃখ কে খন্ডাতে পারে॥
ছয়মাস জলে ভাসি আসি সুরপুরি।
জিয়াইয়া দেও প্রাণ জয় বিষহরি॥
পূজা দেবে নিজ হাতে সদাগর বেণে।
কথা দিলাম স্বর্গমধ্যে সাক্ষী দেবগণে॥
বেহুলার বাক্যে পদ্মার দয়া উপজিল।
লখিন্দর জিয়াইতে গমন করিল॥
কনকের কমণ্ডলু দুই করে ধরি।
পদ্মপুষ্প তার মধ্যে ধ্যানে বিষহরি॥
আদ্যমন্ত্র জপে পদ্মা কান্তিময় হন।
চতুর্দিকে দেবগণ বিস্মিত নয়ন॥
মূলমন্ত্র পড়ে পদ্মা ছিটে পদ্মবারি।
জলের ছিটায় বিষ দেয় দেহ ছাড়ি॥
একে একে গঠিলেক শরীর সুন্দর।
ধীরে ধীরে চক্ষু মেলে পুত্র লক্ষিন্দর॥
উলঙ্গ তাহার দেহ দেখে লজ্জা পায়।
নেতা দেবী আসি তারে বসন পরায়॥
ধন্য ধন্য পদ্মাবতী আস্তিক জননী।
তুমি সে জানো বিষ করিবারে পানি॥
পদ্মার মহিমা কভু না হয় মলিন।
পদ্মসম কোমল সে বজ্রন্যায় কঠিন॥
তারপর জিয়াইল ছয়টি ভাসুর।
সকলে প্রত্যক্ষ করে থাকি বহুদূর॥
তারপর জিয়াইল ওঝা ধন্বন্তরি।
প্রণমিল শাহকন্যা করযোড় করি॥
পদ্মা বলে শুনো কন্যা আমার বচন।
ফিরাইয়া দিব আছে ডিঙা ধনজন॥
পূজা যদি করে সাধু দিয়া বহুগুণ।
সকলি ফিরাইয়া দিব করিয়া দ্বিগুণ॥
অতঃপর প্রণমিয়া দেবের চরণ।
প্রস্থান করিল কন্যা সানন্দিত মন॥
সঙ্গে লয়ে যায় কন্যা স্বামী আর ভাসুর।
পূজামাত্র প্রাণ পাবে জান এতদূর॥
ভেলা ভাসি পৌঁছে রামা চম্পক নগর।
সকলে তাহারে দেখি প্রসন্ন অন্তর॥
এতক্ষণে আসিলেক রাজা মূঢ়মতি।
পায়ে ধরি সতী নারী করয়ে প্রনতি॥
একবার যদি পূজ জয় বিষহরি।
সকলি ফিরিয়া পাবে দুইগুণ করি॥
ভেলা মধ্যে আছে দেখো হারা পুত্র যত।
সকলে পাইবে প্রান পদ্মা পূজা মাত্র॥
বেহুলার বাক্য শুনি চম্পক অধিপতি।
ইঙ্গিতে বলয়ে পূজিবেক পদ্মাবতী॥
চাঁদের সুমতি দেখি যত প্রজাগণ।
সকলে মিলিয়া করে পূজার আয়োজন॥
স্নান করি বসে সাধু উত্তম বসন।
নানাবিধ ফল-ফুল অগরু চন্দন॥
বেদ-বিধিমতে মন্ত্র উচ্চারণ করি।
লক্ষ বলি দিয়া পূজে জয় বিষহরি॥
অষ্টোক্তর শত পদ্ম চয়ন করিয়া।
মনসার পূজা করে হরষিত হইয়া॥
পদ্মপাতে চাপাকলা আতপ তণ্ডুল।
স্বর্ণ থালা মধ্যে রাখে বিল্বপত্র ফুল॥
সারি সারি নৈবেদ্য আর বহু উপচার।
পাত্র ভরি দুগ্ধ কলা সন্মুখে তাহার॥
ঢাক ঢোল কাংস্য বাজে শুনিতে সু-স্বর।
পূজা দেখিবারে আসে যত নারী-নর॥
বলি কাটি সদাগর হরিষ অন্তর।
রুধিরু ভরিয়া দিল পাত্রের উপর॥
পদ্মা পূজা করে চাঁদ দেখিতে সুন্দর।
পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পরে যুড়ি দুই কর॥
সন্তুষ্ট হইলা দেবী পূজাতে তাহার।
দ্বিগুণ হইয়া সব ফিরিল তাহার॥
ওঠিয়া বসিল মরা পুত্র সপ্তজন।
চৌদ্দডিঙ্গা পাইল সাধু সাথে ধনজন॥
সকলি ফিরাইয়া দিল দেবী বিষহরি।
চন্দ্রধর হইতে যাহা নিয়াছিলো কারি॥
পদ্মার কৃপায় তার দুঃখ গেল দূরে।
প্রতক্ষ্য দেবতা পদ্মা কহি এতদূরে॥
জয় জয় দিয়া বন্দ দেবী মনসা।
প্রণতি করিয়া কহ যাহার যে আশা॥
ধনে জনে পরিপূর্ণ চাঁদের আলয়।
মনসার বরে তাঁর মানবৃদ্ধি হয়॥
ভক্তিভরে যেইজনে পূজে মনসারে।
সর্ব বাধা দূরে যায় সেই দেবীর বরে॥
পদ্মাপুত্র গৌরব বলে করযোড়ে।
ভবসিন্ধু তরিবারে ভজ মনসারে॥
পদ্মার মঙ্গল-কথা হইল সমাপন।
হরি হরি বলো সবে ভরিয়া বদন॥

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ