নিস্তারিণী কালীবাড়ি


 সাংসারিক কলহ কিভাবে ঈশ্বর দর্শনের সহায়ক হয়ে ওঠে তার নজির মেলে রাজা হরিশচন্দ্রের জীবনে।শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র দত্তরায়।তার প্রতিষ্ঠিত নিস্তারিণী কালী আজও বহু ভক্তের আরাধ্যা। 

    জগতের দুর্গতির যিনি নিস্তার ওরেন তিনি মা নিস্তারিণী।শেওড়াফুলির গঙ্গাপাড়ে এই নিস্তারিণী মায়ের জাগ্রত পীঠ।এখানে মা নিস্তারিণী জগতের কল্যাণ করছেন।দূর দূরান্তরে তার মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে সেই যুগ যুগ ধরে একইভাবে।

    বাংলার ১২৩৪ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে রাজা হরিশচন্দ্র লিখলেন আদেশনামা।

                    "স্বীয়ে রাজ্যে ভুজঙ্গ শ্রতি শিখরি ধরা গণ্যমানে শকাব্দে।

                            কালী পদাভিলাষী স্মরহর মহিষী মন্দিরং তৎ প্রতিষ্ঠাৎ।।

                        চক্রে গঙ্গাসমীপে বিগত ভবভয়ঃ শ্রী হরিশচন্দ্র দত্ত।

                            সম্মতির্যস্য রামেশ্বর ইতি নৃপতেমন্ত্রী যত্নেন সার্দ্ধং।।"

    ৩০০ বছর আগে এই শেওড়াফুলিসাড়াফুলি নামে পরিচিত ছিল।ভাগীরথীর তীরে এই শেওড়াফুলিতেই তৈরী হয়েছিল এই নিস্তারিণী মায়ের মন্দির।মন্দির থেকে ভাগীরথীর দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট খানেক।মন্দিরের দেওয়ালে পাথরের ফলকে লেখা বর্ধমান জেলার পাটুলির অন্তর্গত দত্ত রাজবংশজাত শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষত্রিয়রাজ রাজা মনোহর রায়ের পুত্র রাজা রাজচন্দ্র রায়ের পৌত্র রাজা হরিশচন্দ্র রায় ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন।

    কথিত আছে শেওড়াফুলির রাজবংশের হরিশচন্দ্র রায় প্রথম স্ত্রী সর্বমঙ্গলা দেবীর অপমৃত্যু হওয়ায় পন্ডিতদের বিধান অনুসারে অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে আত্মার শান্তির জন্য ১৭৪৯ শকাব্দে নিস্তারিণী কালী মন্দির নির্মাণ করেন।মন্দিরে প্রতিষ্ঠা পান দেবী কালীকা।স্ত্রী হত্যার পাপস্খলনের উদ্দেশে রাজা হরিশ্চন্দ্র যে তন্ত্রসাধনা ক্ষেত্র গড়ে তুললেন দিন বদলের সাথে সাথে তা হয়ে উঠলো এলাকার মানুষের আশ্রয়ের আধার শক্তির উৎস।

    এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা হরিশচন্দ্র রায়।এই মন্দির তৈরী হয়েছিল বাংলার ১২৩৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে।এই মন্দির স্থাপনের পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস।রাজা হরিশচন্দ্রের ৩ রানী ছিলেন।সর্বমঙ্গলা, হরসুন্দরী ও রাজধন।রানীদের মধ্যে বিবাদ ছিল।কোনও কারণে রাজা হরিশচন্দ্র তার বড় রানী সর্বমঙ্গলা দেবীকে হত্যা করেন।তারপর তিনি শ্রীরামপুরে চলে আসেন।তিনি জানতেন না তিনি কোথায় যাচ্ছেন।

    হরিশচন্দ্র ছিলেন পরম ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও দেবী কালীকার ভক্ত।একদা রাজা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।পথে ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে রাজা আশ্রয় নেন গভীর জঙ্গলের এক বৃক্ষতলে।আর সেখানেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন ক্লান্ত রাজা।দেবী নিদ্রাকালে স্বপ্নাদেশ দেন রাজাকে।তিনি যেন গঙ্গাতীরে মন্দির ও দক্ষিণাকালীর মূর্তি স্থাপন করেন।

    শ্রীরামপুরে রাজা মনোহরচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামসীতা মন্দির।তিনি সেখানে যান।সেখানে গিয়ে তিনি আদেশ পান যে অপরাধ তিনি করেছেন এটি ক্ষমার যোগ্য নয়।তাকে আদেশ দেওয়া হয় তিনি যেন দক্ষিণাকালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা হবে তন্ত্রমতে।এই মন্দিরের মূর্তি তন্ত্রমতে।এর অর্থ হলো একই ব্রাহ্মণ পরিবারে পাঁচটি সন্তানের মুণ্ড তলায় রাখা রয়েছে।এই জিনিসটি করা হয়েছে তান্ত্রিক আচার মেনে হয়েছিল।কষ্টিপাথর দিয়ে মায়ের মূর্তি তৈরী হয়।

    তখনও স্থাপিত হয়নি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির।প্রতিষ্ঠিত হয়নি মায়ের বিগ্রহ।রানী রাসমণি একদিন স্বপ্নে দেখলেন দেবী তাকে আদেশ করছেন ভাগীরথীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠার।একদিন তিনি বজরা নিয়ে যাচ্ছিলেন শেওড়াফুলির দিকে।তিনি শুনেছিলেন ভাগীরথীর তীরে দেবী নিস্তারিণী অত্যন্ত জাগ্রত।রানী এখানে পুজো দেন।পূরণ হয় তার মনোবাঞ্ছা।তৈরী হলো ভবতারিণী মায়ের মন্দির।সেই থেকেই শেওড়াফুলির নিস্তারিণী মায়ের মন্দির জাগ্রত হয়ে ওঠে।

    তন্ত্রের জায়গায় আসতে গেলে কিছু পবিত্রতার প্রয়োজন হয়।এই পবিত্রতা শুধুমাত্র গঙ্গাস্নানে হয় না।এই পবিত্রতা আসে মনের মধ্যে পবিত্র চিন্তা থেকে।প্রাচীনকাল থেকে রাজবংশের প্রতিনিধিরাই ঠিক করেন মন্দিরের সামনের সবকটি সিঁড়ি অতিক্রম করলেই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়।এমন ভাবে মন্দির স্থাপন হয়েছিল যাতে মানুষ জানুক বা না জানুক তার একটি পবিত্রতা হয়ে যায়।

    শেওড়াফুলির রেলস্টেশনের পূর্বদিকে স্টেশনের পাশে শ্রী শ্রী নিস্তারিণী কালী মন্দিরের অবস্থান।মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছতে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়।মন্দিরটি অনুচ্চ ভিত্তিবেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত।মন্দিরটির দক্ষিণমুখী দালান ও থামবালা বিশাল নাট মন্দির।পরে বারান্দা সংলঘ্ন মায়ের মন্দির।মন্দিরের সামনের বলির জায়গা।মন্দিরের পঞ্চমুন্ডীর আসনের ওপর তামার বেশ বড় পাপড়ি যুক্ত একটি পদ্ম।তার ওপরেই দুই হাত মাথার দিকে তোলা মহাদেবর বুকের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে মা নিস্তারিণী।কষ্টিপাথরে দক্ষিণাকালীর রূপ মন কাড়ে সবার।ত্রিনয়নী, এলোকেশী করুণাভরা চাহুনি দেবী মূর্তি উচ্চতায় আড়াই-তিন ফুট।



    মা-কে যেহেতু রানী হিসেবে দেখা হতো তাই মায়ের হাতে তলোয়ার রয়েছে।মা-কে যদি বলির জায়গা থেকে দেখা হয় একরকম লাগে।নাট মন্দির থেকে যদি দেখা হয় একরকম লাগে আর মন্দিরের দালান থেকে দেখলে আরেকরকম লাগে।



    মন্দির ঘুরলে দেখা যায় মন্দির লাগোয়া একটি ঘরে সাদা পাথরের শিব মন্দির।২-৪ পা এগোলে আরো একটি ঘর।এই ঘরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহিষমর্দিনী।কষ্টিপাথরের তৈরী এই মূর্তি বহু প্রাচীন।ভেতরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ-এর সাথে শ্বেত পাথরের দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি।মন্দিরের পেছনে গেলে ডান দিকে পরে ছোট্ট একটি কুঠুরী।মূল দেবীর মন্দিরকে ডানদিকে রেখে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেই দেখা যায় কাঠের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত বাঁশি হাতে কৃষ্ণের মূর্তি।তার থেকে কিছুটা এগোলেই আবার একটি শিবলিঙ্গ।

    শেওড়াফুলিতে মা নিস্তারিণীর সঙ্গেই বিরাজ করছেন মা অন্নপূর্ণা, মহিষমর্দিনী, জোড়া শিবলিঙ্গ তার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কুলদেবতা বঙ্কুবিহারী।

    সকাল ও বিকেলে মা-কে লুচিভোগ দেওয়া হয়, অন্নভোগ হয় না।প্রতি অমাবশ্যায় মায়ের বিশেষ পুজো হয়।মায়ের কাছে মানত করলে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।দেবী খুবই জাগ্রত।দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের কাছে।

    ইহজগতের সকল প্রকার দুর্গতি থেকে আশ্রীতকে নিস্তার করেন যিনি তিনিই মা নিস্তারিণী।হরিশচন্দ্রের ভক্তির টানেই মা আজও জাগ্রতা।কলির কলিশ নাশ করার জন্য তিনি এখানে নিস্তারিণী নামে কালী রূপে বিরাজ করছেন।ভক্তরা আসেন মনোস্কামনা পূরণের অশা নিয়ে।নিয়ে যান মায়ের আশিস ও অপার শান্তি। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ