জলন্ধর শক্তিপীঠ

    


পুরাণে কথিত আছে শিব ঘরণী সতী একবার বাবা দক্ষের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য শিবের কাছে অনুমতি নিতে গিয়েছিলেন।শিব বলেছিলেন বিনা আমন্ত্রণে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া অনুচিৎ।কারণ তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সতী যোগী মহাদেবকে বিয়ে করায় ক্ষুব্ধ ছিলেন দক্ষ।তাই মহাদেব ও সতী ছাড়া প্রায় সকল দেবদেবীকে আমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি।তাও অনড় ছিলেন দক্ষ কন্যা সতী।শেষমেশ মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সত্যি উপস্থিত হন।তবে আমন্ত্রিত অথিতি না হওয়ায় যথাযোগ্য সম্মান পাননি তিনি।মহাদেবকেও অপমান করেন দক্ষ।স্বামীর প্রতি বাবার এই অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগ বলে আত্মাহুতি দেন সতী।ক্রোধে শোকে জ্বলে ওঠেন শিব।কেঁপে ওঠে চরাচর।শেষে বিষ্ণুর চাতুরীতে রক্ষা পায় জগৎ।সুদর্শন চক্র সতীর দেহকে ৫১ খন্ডে খণ্ডিত করে।সেই খন্ড ছড়িয়ে পরে চারিদিকে।যেসব যায় সেই দেহ খন্ড গুলো পড়েছিল সেখানে গড়ে উঠেছে আজকের সমস্ত সতীপীঠ।

    পাঞ্জাবের জলন্ধরে গড়ে উঠেছে এইরকম এক সতীপীঠ।কালিকাপুরাণমতে, দেবীর স্তনযুগল পড়েছিল এই জলন্ধরে।যদিও তন্ত্রশাস্ত্র ও জনশ্রুতি অনুসারে কেউ বাম স্তন কেউ ডান স্তন পড়ার কথা বলেছে।এই জলন্ধর শহর সৃষ্টির পেছনে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক ঘটনা রয়েছে।

    জলন্ধর নামক এক দৈত্য ছিল।এটি তার দেশ।সে কৃষ্ণের তপস্যা করেছিল।পাশাপাশি সে বৃন্দাকে কামনা করেছিল।তার তপস্যা সিদ্ধ হওয়ার পরে পরবর্তী জন্মে সে বৃন্দাকে পত্নী হিসেবে পায়।কিন্তু সেখানে একটি শর্ত ছিল।বলা হয়েছিল এই জলন্ধর আমার ও অজেয় যতক্ষণ না তার পত্নীর সতীত্ব নষ্ট হচ্ছে।কিন্তু বৃন্দা প্রচুর ধর্মপ্রাণ, সে ভীষণভাবে পতি পরায়ণ।তার সতীত্ব বজায় রয়েছে সারাজীবন।জলন্ধর তখন খুব পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে।কারণ সে জানতো যতক্ষণ না বৃন্দার সতীত্ব হরণ হচ্ছে ততক্ষন কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।কোনো উপায় না পেয়ে ভগবান বিষ্ণু নিজে জলন্ধরের রূপ ধরে এসে বৃন্দার সঙ্গে মিলন করলেন আর সেখানেই বৃন্দার সতীত্ব হরণ হলো।এভাবেই জলন্ধরের মৃত্যুবান তৈরী হয়েছিল।এরপর স্বয়ং মহাদেব ত্রিশুল দিয়ে জলন্ধরের মাথা কেটে ফেললেন।কিন্তু কেটে দেয়া মাথা আবার জোড়া লেগে যায়।তখন মহাদেব জলন্ধরের মাথা কেটে মাটির নিচে পুঁতে ফেলেন।তখন দেখা যায় মাটির নিচে জলন্ধরের কাটা মাথা বড় হতে হতে প্রায় ৩২ মাইল জায়গা জুড়ে উঁচু হয়ে অবস্থান করে।পরবর্তীকালে এখানেই গড়ে ওঠে জলন্ধর শহর।শক্তিপীঠ হলেও এখানে বৈষ্ণবী ভাব তও লক্ষণীয়।নিরামিষ আহার ও বৈষ্ণবী ভোজন হয়।

    বলা হয় সাগরের ঔরসে গঙ্গার গর্ভে এই জলন্ধরের জন্ম।জলন্ধর ক্রমশই বলশালী ও মহাপ্রতাপশালী হয়ে ওঠে।যখন সে মহা পরাক্রমী হয়ে উঠেছে সেই সময় দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য সাগরকে বললেন তুমি পুত্রের জন্য জায়গা ছেড়ে দাও।তখন সাগর এই জায়গা ছেড়ে ত্রিশ যোজন দূরে চলে যায়।ভৌগোলিক ভাবে দেখালেও দেখা যায় জলন্ধরের কাছে সাগরের কোনো অবস্থান নেই।সেই সময় যে স্থলভাগ এখানে গড়ে উঠলো সেখানেই রাজত্ব করতে লাগলো জলন্ধর।সেই থেকে জলন্ধরের রাজত্বের নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় জলন্ধর।

    এখানে দুটি বিখ্যাত ধর্মীয় গুহা তৈরী করা হয়েছে।একটি হলো অমরনাথের গুহা ও বৈষ্ণবদেবীর গুহা।তবে এটি এখানকার স্থানীয় বৈষ্ণবদেবীর গুহা।

    জলন্ধরকে নিয়ে রয়েছে আরো এক পৌরাণিক গাথা।জলন্ধর ছিল দৈত্য।সে বিষ্ণুর যিনি পালনকর্তা, তার পালনকর্মকে বিঘ্নিত করছে সাথে সৃষ্টিকে বিঘ্নিত করছে।এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভগবান বিষ্ণু তাকে সংহার করবেন।যখন বিষ্ণু সংসার রক্ষার জন্য তাকে বধ করলেন তখন দৈত্য উপুড় হয়ে পরে গেলো।অনেকটা জায়গা উঁচু হয়ে পরে থাকলো জলন্ধর।তার পিঠের ওপরই তৈরী হয় এই জলন্ধর শহর।

    যে মাতৃ স্তনে সমগ্র জীবজগৎ লালিত পালিত হচ্ছে সেই মাতৃস্তন এখানে পড়ে এটি মহাপীঠ বলেও পরিচিত।মহাভারতেও এই পীঠের উল্লেখ রয়েছে।বন পর্বে মাতৃতীর্থের বর্ণনা অনুসারে স্তনকুণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।সেইদিক থেকে এই পীঠকে মহাভারতীয় যুগের বলে মনে করা হয়।

     চত্বর বেশ প্রসস্থ।একটি কুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে সমগ্র মন্দির।এই কুণ্ডের জন্য স্থানীয় বাসীদের কাছে এই মন্দিরের নাম দেবীতালাব মন্দির।এখানে মা ত্রিপুরমালিনী নাম পরিচিত।


    মূলমন্দিরের ভেতরে রয়েছে কাঁচের অপূর্ব কারুকার্য।গর্ভগৃহের মাঝখানে অধিষ্ঠিত মা ত্রিপুরমালিনী।তার একদিকে সিদ্ধিদাতা গণেশ আরেকদিকে সঙ্কটমোচন হনুমান।গর্ভগৃহে জ্বলে অখণ্ড জ্যোতি।প্রতিদিন ভোর ৪টের সময় মঙ্গল আরতি দিয়ে দিনের শুরু হয় ও সন্ধ্যা আরতি দিয়ে দিনের শেষ হয়।পুকুরের মাঝে নতুন করে গড়ে উঠেছে এক মন্দির।এখানেই মায়ের শয়ন আরতি হয়।এখানে একসঙ্গে তিন দেবী রয়েছেন।মহালক্ষ্মী, মহা সরস্বতী ও মা বৈষ্ণবদেবী।মন্দির চত্বরে রয়েছে এক প্রাচীন কালী মন্দির।সম্পূর্ণ সোনায় মোড়া এই মন্দিরের সামনের অংশ আর এর পাশেই রয়েছে পিঠ ভৈরব।


    জলন্ধরের পৌরাণিক কাহিনীতে বৃন্দার এক বড়ো ভূমিকা রয়েছে।শহরের মধ্যে রয়েছে সতী বৃন্দার মন্দির।স্থানীয় ভাবে এই মন্দিরের নাম বৃন্দ তুলসী মন্দির।এনি ছিলেন জলন্ধরের স্ত্রী।একদা কৃষ্ণের গোপিনী বৃন্দা।নিরিবিলি এই মন্দিরে স্থানীয় মহিলারা এখানে নিয়মিত প্রদীপ দিয়ে আরতি করেন।এর সঙ্গেই রয়েছে প্রাচীন শনি মন্দির।

    বর্তমানে পাঞ্জাবের এই স্থানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।সবুজ বিপ্লব বদলে দিয়েছে সমগ্র পাঞ্জাবকে।তখন থেকে পাঞ্জাবের অর্থনীতির মোড় ঘুরে গিয়েছিলো।এখানে পুরুষদের থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই মহিলারা।এই খানে দেখা যায় কিছু পুরোনো দিনের গাড়ি খানিকটা অটোর মতো দেখতে।এদের নাম গণেশ।শোনা যায় এই গণেশ এক সাথে ২০-২৫ জন যাত্রী বহনে সক্ষম।গণেশের থেকে ছোট যারা তাদের নাম বিক্রম।জলন্ধর কাঁপিয়ে বেড়ায় এই গণেশ ও বিক্রম।

    পড়ন্ত বিকেলের আলোয় অতি সুন্দর দেখতে লাগে মায়ের মন্দির।এই মন্দিরের বাইরের অংশ পুরোটাই নতুন করে গড়ে তোলা।অপূর্ব পাথরের কাজ সঙ্গে নজর কাড়া জাফরির কারুকার্য।


    সূর্যাস্তের পর শুরু হয় মন্দিরে মায়ের সন্ধ্যা আরতি।ভক্তদের ঢল নামে সেই সময় মন্দিরে।আরতি শেষে ভক্তরাও গলা মেলান দেবী বন্দনায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ