সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় বিদ্যা


 দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় বিদ্যা ও বৃহস্পতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী তারা।সিদ্ধপীঠ তারাপীঠের মাহাত্ম্য সর্বত্র ছড়িয়ে।সাধক বামদেব, আটলাগ্রাম, মহাশ্মশান আর তারা মায়ের মন্দির যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে।সিদ্ধপীঠের সেইসবের সাক্ষ্য বহন করে নিয়ে চলেছে দ্বারকা নদী।দ্বারকার পারে এসে সেই এক একটি অধ্যায় যেন তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ছে।

    কিংবদন্তি বলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ট কামরূপ কামাখ্যায় স্থির সংযমীভাবে তারামন্ত্র জপ করেছিলেন কিন্তু মায়ের অনুগ্রহ লাভ করেননি।এইসময় বশিষ্ট অভিশাপ দেন যে খুব তাড়াতাড়ি করা তারামন্ত্র কখনোই ফলবতী হবে না।দেবীও উল্টে অভিশাপ দেন যে বীরাচার সাধনা ব্যাতিত সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়।শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন বশিষ্ট।কোনো কোনো তন্ত্রে বশিষ্টের চিনে যাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।

    কিছু প্রামানিক গ্রন্থে বলা হয়েছে এই বশিষ্টদেব কামাখ্যা থেকে চিনে যান।মূলত তিব্বতের কথা এখানে উল্লেখ রয়েছে।তিব্বতের মানুষরা এই তারা পূজা করেছেন, চৈনিক আচারে তারা এ পূজা করেছেন।

    তারাপীঠের সাধনভূমি বলেই পরিচিত এখানকার মহাশ্মশান।বামদেব, নয়নদেব, তারাক্ষ্যাপা সকলেই সিদ্ধিলাভ করেছেন এই শ্মশানভূমি থেকে।বহু প্রাচীনকাল থেকে দাহ করার পাশাপাশি এখানে সমাধিও দেওয়া হয়।তাই তারাপীঠ মহাশ্মশানে খালি পায়ে প্রবেশ করে রীতি।ঘর কালো অন্ধকারের মধ্যে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে জোনাকির মতো জ্বলে এক একটি হোমকুন্ড।রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তান্ত্রিকরা মেতে ওঠেন তন্ত্র সাধনায়।হোমকুন্ডের আঁচ ছড়িয়ে পরে সেখানে থাকা সবার মধ্যে।সামনে থেকে সেই দৃশ্য দেখলে ভয়ে শরীরে কাঁটা দেয়।জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে জলে থাকা আগুনের শিক্ষা আরো রহস্যময় করে তোলে গোটা পরিবেশকে।গভীর রাতে এই জাগ্রত মহাশ্মশানের ঘর রবকে চাপিয়ে উঠতো বামাক্ষ্যাপার মেঘমণ্ডিত গভীর কণ্ঠস্বর।নাচ সিদ্ধ সাধকের "জয় তারা" ধ্বনি শোনা যেত বহু দূর থেকে।

    সাধক বামাক্ষ্যাপা শরীর ছাড়ার পূর্বে স্থান নির্ণয় করেছিলেন নগেন বাগচীকে সামনে রেখে তিনি স্থান নির্ণয় করেছিলেন পাদপদ্মের ঠিক পাশে।মহাশ্মশানে পাদপদ্মে মায়ের পা রক্ষিত হয়েছে।এটি একটি বিশেষ আসনও।বহু সাধক ওখানে এসেছেন।

    বামদেবের শরীর ছাড়ার পর পাদপদ্মের পশে যখন মাটি খোঁড়া হয়েছিল তখন ঠ্যং করে একটি শব্দ হয়।সবাই ভেবে বসে মোহরের হাঁড়ি বা ওই জাতীয় কিছুর শব্দ।কিন্তু আরো একটু খোঁড়া হলে দেখা যায় মোহরের থেকেও দামি জিনিস রয়েছে ওইস্থানে।একটি ত্ৰিশূল পাওয়া যায়।আরোও একটু খোঁড়া হতে দেখা যায় ঐস্থানে একটি মন্দিরও রয়েছে।মনে করা হয়, প্রাচীনকালে এই স্থানে তারা মায়ের একটি মন্দির ছিল।

    মন্দির তৈরী নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।মন্দিরের ফলকে কারিগরদের নাম এখনো রয়েছে।কেউ বলেন পাঁচশো আবার কেউ বলেন সত্য বছরের ইতিহাস।মন্দির নির্মাণের সময় এই জায়গার নাম ছিল চণ্ডীপুর।ঘন জঙ্গলে মোড়া ছিল এই জায়গা।বেশ গা ছমছমে পরিবেশ ছিল।দ্বারকা নদীর ওপর দিয়ে বাণিজ্য যাত্রা করছিলেন বণিক সওদাগর জয় দত্ত ও তার ছোট ছেলে।জয় দত্ত ছিলেন শিবের ভক্ত।তিনি কালী পুজোর ঘোর বিরোধী ছিলেন।বাণিজ্য যাত্রায় ক্লান্ত হয়ে যৌ দত্তের ছেলের জ্বর আসে এবং তার পুত্র মারা যায়।নৌকা এসে দাঁড়ায় চণ্ডীপুর জঙ্গলের কাছে।সেইদিন রাতে মা তারা বণিকের কাছে এসে জানতে চায়, তোমার নৌকায় কি আছে? শোকে কাতর জয় দত্ত উত্তরে বলে, ছাই আছে?

    পরদিন সকালে দেখা যায় জয় দত্তের পুত্রের শরীর ছাইয়ে পরিণত হয়েছে।বণিক মায়ের কাছে ছেলেকে ফেরত চাইলে পুত্রের মৃতদেহ আবার ফিরে পায়।সেইদিন সকালে নৌকার নাবিকেরা জঙ্গলের মধ্যে একটি পুকুরে রান্নার জন্য মাছ ধুইতে গিয়ে দেখে মরা মাছ জ্যান্ত হয়ে গেছে।এই খবর তারা এসে জানায় জয় দত্তকে।জয় দত্ত তখন তার পুত্রের মৃতদেহ সেই জলে নিয়ে গেলে সে প্রাণ ফিরে পায়।তখন জয় দত্ত ওই জঙ্গলে মা তারার তপস্যা শুরু করেন।মা স্বপ্নাদেশে জয় দত্তকে মন্দির তৈরী করতে বলেন আর সেই মন্দিরে মায়ের ব্রহ্মশিলাকে প্রতিষ্ঠা করতে বলেন।তখন বণিক সমস্ত কারিগরদের খবর দিতে বলেন।সমস্ত কারিগরদের কাজ দেখেও জয় দত্তের পছন্দ হলো না।তখন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ছদ্মবেশে এসে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন।স্বপ্নে বণিক মায়ের যেই রূপ দেখেছিলেন সেইরূপে মূর্তি তৈরীর নির্দেশ দেন জয় দত্ত।এইভাবে তৈরী হয় তারাপীঠ মন্দির।

    তারপর এক বিশাল বন্যায় ভেসে যায় পুরো চণ্ডীপুর।মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য চণ্ডীপুর ছেড়ে চলে যায়।মন্দির বন্ধ হয়ে যায়।তারপর নাটোরের রাজা রামজীবন চৌধুরী মন্দির পুনঃসংস্কার করেন।

    ভোরবেলা মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে।তখন মায়ের মহাস্নান হয়।ভক্তরা তখন মন্দিরের সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে।মায়ের মহাস্নানে গামছা, তেল, ঘি, মধু, মদ, গোলাপজল, ডাব, আতপচাল, চন্দন এইসব সামগ্রী লাগে।গর্ভগৃহের দরজা খোলা মাত্র গোটা মন্দির প্রাঙ্গন মাতৃ নামে মুখর হয়ে ওঠে।তারপরেই শুরু হয় মঙ্গল আরতি।

    তারাপীঠের তারামা শিলা ব্রহ্মময়ী।এখানে মায়ের শিলারূপী মূর্তি পূজিত হয়।কিংবদন্তি বলে বশিষ্ট তারাকে মাতৃরূপেই পেতে চেয়েছিলেন আর মাতৃরূপের পূর্ণপ্রকাশ সন্তানকে স্তন্য দানরুপী মূর্তিতেই।বিশ্বাস বশিষ্টকে দর্শন দিয়েই মা শিলায় প্রবেশ করেছিলেন।শিলা ব্রহ্মময়ী এই মূর্তির মাহাত্ম্য তাই অনেক পবিত্র।শিশু মহাদেবকে স্তন্যদানরতা তারা অধিষ্ঠান করেন এই মূর্তিতেই।কিংবদন্তি বলে সমুদ্রমন্থন সময় হলাহল বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন মহাদেব।তাকে স্তন্যপান করিয়ে বিষমুক্ত করেছিলেন তারা।তারাপীঠের তারামা উগ্র তারা রূপেই পূজিত হন।



    তারা অর্থাৎ ত্রাণকর্তী, ত্রিমাত্রিকশক্তি, একজটা, নীলসরস্বতী ও উগ্র তারা।তারা হলেন তন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

মূলমন্দিরের সামনে রয়েছে নাট মন্দির।সারাদিন এখানেই জব ধ্যানে কাটিয়ে দেন অনেক ভক্ত।প্রধসন নাট মন্দিরের উত্তরে আরো একটি নাট মন্দির রয়েছে।সেখানে ভক্তরা হোম যজ্ঞ করেন।এর পাশেই রয়েছে বলির স্থান।মায়ের মন্দিরে নিয়ম করে বলিদান হয়।প্রতিদিন গড়ে ১০টি ছাগল বলি হয়।মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী বলির মাথা আর পেছনের একটি পা মায়ের ভোগ রান্নার জন্য সেবায়েতদের দেওয়া হয়।বলির বাকি অংশ নিয়ে মন্দির সংলগ্ন শ্মশানে গিয়ে প্রসাদী ভোগের আয়োজন করেন ভক্তরা।প্রতিটি তন্ত্রপীঠের নিয়ম মেনেই তারাপীঠে বলিদান আবশ্যিক।

    মায়ের মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও চারটি মন্দির।এর মধ্যে অন্যতম চন্দ্রচূড় মহাদেবের মন্দির।তারাপীঠের ভৈরব বলেই তিনি পূজিতা হন।এর কারণেই এখানে তৈরী হয়েছে বিতর্ক।সতীর ৫১ পিঠের মধ্যে তারাপীঠের নাম নেই।তবে অনেকেই মহাপীঠকে সতীপীঠ হিসেবে মনে করেন।তন্রমতে তারাপীঠে সতীর উর্ধ নয়নতারা পড়েছিল।তাই তারাপীঠকে সিদ্ধ দেবীপীঠ বলা হয়ে থাকে।প্রতিটি সতীপীঠের মতো তারাপীঠের ভৈরব মন্দির রয়েছে।তবে বেশিরভাগ সাধক মনে করেন তারাপীঠ সতীর ৫১ পীঠের অন্তর্গত নয়।

    তারাপীঠের আসল নাম চন্ডীপুর।তারামায়ের বাস চণ্ডীপুরে বলেই এই স্থানের নাম তারাপীঠ।

চন্দ্রচূড় মন্দিরের পাশেই রয়েছে সঙ্কটমোচনের মন্দির।এই মন্দিরে সঙ্কটমোচনের সাথে শিলারূপী গণেশেরও পূজা হয়।সঙ্কটমোচন মন্দিরের পাশেই রয়েছে বামদেবের মন্দির।তারাপীঠ মন্দিরের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে রয়েছে বামদেবের স্মৃতি।এই মন্দিরেই মাঝে মাঝে বড়মা বড়মা বলে  তিনি।শিলারূপী দেবীকে কোনো তন্ত্র মন্ত্র ছাড়াই জাগ্রত করেছিলেন তিনি।বামদেবের মন্দিরের সামনে রয়েছে দক্ষিণমুখী বাসুদেব মন্দির।প্রাচীন কষ্টিপাথরের তৈরী বিগ্রহ।বাসুদেব মন্দির ও বামদেবের মন্দিরের মাঝখান দিয়েই মায়ের পুকুর ঘাটে যাওয়ার রাস্তা।


    মন্দিরের ঠিক পেছনে দক্ষিণদিকে রয়েছে একাধিক ভোগের রান্নাশাল।তারা মায়ের ভোগেরও নানা তারতম্য রয়েছে।ছাগ মাংস মায়ের ভোগের প্রধান পদ।তারাপীঠে মায়ের মন্দির খোলার নির্দিষ্ট সময় থাকলেও তা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।ভক্তদের ভিড় বেশি থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খুলে দেওয়া হয় মন্দির।কালীপুজো ছাড়া তারাপীঠের প্রধান উৎসব কৌশিকী অমাবস্যায়।এই দিন মায়ের আবির্ভাব হয়।এছাড়াও দেবী পক্ষের চতুর্দশী তিথিতেও এখানে ভক্তের সমাগম হয়।

    প্রতিবছর তারামায়ের আবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করে উৎসবের হাট বসে যায়।এদিন মায়ের শিলামূর্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় বিরামখানায়।সেখানে দেবীকে স্নান করানো হয়।এরপর বিরাম খানাতেই অলংকারে সাজিয়ে মায়ের পূজাপাঠ শুরু হয়।বছরের এই একটিদিনেই দেবীর শিলামূর্তিকে গর্ভগৃহ থেকে বাইরে আনা হয় আর দিনটিতেই ভক্তরা মায়ের মূর্তিকে স্পর্শ করতে পারে।

    তারাপীঠে তারামায়ের মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩০০টি সেবায়েত পরিবার নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে।এই সেবায়েতরা মাথাপিছু বার্ষিক ৬০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা আয় করে।ভক্তদের অনুদান বাবদ এখানে সেবায়েতরা প্রায় ১০লক্ষ টাকা পায়।এই টাকা তারাপীঠ সংলঘ্ন জামিন এলাকার উন্নতির জন্য ব্যয় করা হয়।

    সন্ধ্যা নামলেই পাল্টে যায় মন্দিরের ছবি।ভক্তদের ঢল নামে মন্দিরে।নাট মন্দির কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।মায়ের মন্দিরে শুরু হয় সন্ধ্যারটির প্রস্তুতি।মায়ের নামে ভোরে ওঠে গোটা মন্দির শুরু হয় আরতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ