কি কারণে সমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী

 


শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে তৈরী করেছিলেন এই দ্বারকা নগরী।হিন্দু ধর্মে দ্বারকা নগরীকে সপ্তম সবথেকে প্রাচীন নগরী হিসেবে মনে করা হয়।বাকি ছয়টি নগর হলো মথুরা, কাশী, হরিদ্বার, অবন্তিকা, কাঞ্চিপুরম ও অযোধ্যা।কিছু মানুষ দ্বারকা কে দ্বারাবতী, কুশস্থলী, অনুর্ত্বক, গোমতী দ্বারকা, ওখামন্ডল, চক্রতীর্থ, অন্তর্দ্বীপ এবং বাণীদূর্গ নামেও চেনেন।এই শহরের চারিপাশে বড় বড় দেওয়াল উপস্থিত।যেখানে একাধিক দুয়ার ছিল।এই দুয়ারের কারণেই শহরের নাম হয় দ্বারকা।

    দ্বারকা নগরীকে শ্রীকৃষ্ণের বাসস্থান বলে মনে করা হয়।মহাভারতে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ যখন কংসের বধ করলেন তখন জরাসন্দ কৃষ্ণ ও যদুবংশীয়দের বিনাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।তাই সুযোগ পেয়েই জরাসন্দ মথুরাতে যদুবংশীয়দের ওপর বার বার আক্রমণ করতে লাগলেন।ধীরে ধীরে অত্যচার বাড়তে লাগলো।যদুবংশীয়দের কল্যাণের কথা ভেবে শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।মথুরা থেকে বেরিয়ে তিনি এমন এক নগরের স্থাপনা করলেন যেটি বিশাল এবং সুসংগত ছিল।এই নগরের নাম ছিল দ্বারকা নগরী।বলা হয়ে থাকে শ্রীকৃষ্ণ এখানে সবাইকে নিয়ে খুব আনন্দে বাস করছিলেন।

    সময় এগোতে লাগলো।এইভাবে ৩৬ বর্ষ রাজত্ব করার পর এবং শ্রী কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকা নগরী সমুদ্রে ডুবে যায়।পৌরাণিক কাহিনীতে দ্বারকা নগরীর সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়ার ২ টি কারণ পাওয়া যায়।

    প্রথমত, মাতা গান্ধারীর শ্রীকৃষ্ণকে দেওয়া অভিশাপ।

    দ্বিতীয়ত, ঋষিদের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্যকে দেওয়া অভিশাপ।

  কথা অনুসারে, মহাভারত যুদ্ধে কৌরবদের পরাজিত করার পর যখন যুধিষ্ঠিরের হস্তিনাপুরে রাজতিলকের আয়োজন করা হয়েছিল তখন কৌরবদের মাতা গান্ধারী তার একশত পুত্রের মৃত্যুর জন্য শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেন এবং অভিশাপ দেন যে প্রকার কৌরব বংশের বিনাশ হয়েছে ঠিক সেই প্রকার যদু বংশেরও বিনাশ হবে।

    আবার দ্বিতীয় কথা অনুসারে, মহাভারত যুদ্ধের ৩৬ বর্ষ পরে দ্বারকা নগরীতে বিভিন্ন অমঙ্গল জনক ঘটনা ঘটতে শুরু করে।তখন একদিন ঋষি বিশ্বামিত্র, নারদমুনি প্রমুখ স্বজ্জন ঋষিগণ দ্বারকাতে আসেন।যেখানে যদুবংশের কিশোরেরা ঋষিগনদের নিয়ে পরিহাস করার কথা ভাবলেন।তারা শ্রীকৃষ্ণ পুত্র সাম্যকে স্ত্রী বানিয়ে ঋষিদের সামনে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, এই স্ত্রী গর্ভবতী।ঋষিগণ তখন এর সত্যতা যাচাই করার জন্য ধ্যান করতে লাগলেন।যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন এই স্ত্রী আসলে একজন পুরুষ তখন তারা রাগে ক্ষুব্ধ হলেন।এরপর তাঁরা কিশোরদের বললেন তোমরা আমাদের অপমান করেছো।তাই কৃষ্ণপুত্র লোহার এক মুশলকে জন্ম দেবে।এই মুশলই হবে তোমাদের বংশের পতনের কারণ।এই মুশলের প্রভাব থেকে কেবল শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামই মুক্ত থাকবে।শ্রীকৃষ্ণ যখন এই কথা জানতে পারলেন তখন তিনি বললেন ঋষিদের এই কথা অবশই সত্য হবে।

    ঋষিদের অভিশাপে সাম্য দ্বিতীয়দিন ই মুশলের জন্ম দিলেন।যখন এই কথা রাজা উগ্রসেন জানতে পারলেন তখনি তিনি ওই মুশলটিকে সমুদ্রের জলে ফেলে দেন।তারপরে রাজা উগ্রসেন ও শ্রীকৃষ্ণ নগরে ঘোষনা করলেন আজ থেকে কেউ নিজের বাড়িতে মদ্যজাতীয় পদার্থ তৈরী করবে না।যদি কেউ মদ্যপান করে বা মধ্যজাতীয় পদার্থ তৈরী করতে গিয়ে ধরা পরে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।ঘোষণা শুনে দ্বারকাবাসী মদ্যদ্রব্য না বানানোর সংকল্প নেন।কিন্তু এরপরেও দ্বারকাতে বিভিন্ন অমঙ্গল হতে লাগলো।প্রতিদিন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো, নগরীতে মানুষের তুলনায় ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেলো।এই সময় যদুবংশীয়দের পাপ করতেও দ্বিধা হতো না।দ্বারকার করুন অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে গেলেন কৌরব মাতা গান্ধারীর অভিশাপ সত্য হতে চলেছে।এরপর শ্রীকৃষ্ণ যদু বংশীয়দের তীর্থ যাত্রা করার পরামর্শ দিলেন।শ্রীকৃষ্ণের আদেশ পেয়ে যদুবংশীয়রা সমুদ্রতীরে প্রভাসতীর্থে এসে বসবাস শুরু করেন।প্রভাসতীর্থে বসবাস করাকালীন একদিন সাত্যকি মজার ছলে পীতবর্মার উপহাস করেন পীতবর্মাও কিছু এমন কথা বলে যে সাত্যকি রেগে গিয়ে পীতবর্মার বধ করে ফেলেন।এই দেখে সবাই সত্যকিকে ঘিরে ফেলেন এবং তাকে আক্রমণ করে বসলেন।সত্যকিকে একা দেখে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুন্য তাকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ান এবং সাত্যকি ও প্রদ্যুন্য একই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন।সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে সাত্যকি ও প্রদ্যুন্য তাদেরকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয় এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ করলেন।নিজের পুত্র ও সত্যকির মৃত্যুতে ক্রোধিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মাটি থেকে একমুঠো দূর্বাঘাস তুলে নিলেন।হাতে আসা মাত্রই তা মুশলে পরিণত হয়।যেকেউ সেই ঘাস তুললেই তা মুশলে পরিণত হতো।ওই মুশলের একটি প্রতিঘাতেই মানুষের মৃত্যু হতে পারতো।ঐসময় কালের প্রভাবে সকল বীর মুশল যুদ্ধ শুরু করে।তারা মুসল দিয়ে একে ওপরের বধ করতে লাগলো।যদুবংশীয়রাও একে ওপরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মারা যেতে থাকে।শ্রীকৃষ্ণের সামনেই সাম্য, চারুদেষ্ণ ও গদের মৃত্যু হয়।এরপরে শ্রীকৃষ্ণ বলরামজীকে ঐস্থানে থাকার কথা বলে দ্বারকা ফিরে আসেন।তারপর শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত কথা তাঁর পিতা বাসুদেবকে জানান।যদুবংশীয়দের মৃত্যুর কথা শুনে তিনিও খুব দুঃখ পেলেন।শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেবজীকে বললেন দাদা বললাম তার জন্য বনে অপেক্ষা করছেন।আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি।এই বলে কৃষ্ণ সেখান থেকে প্রস্থান করে।বনে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন বলরামজী সমাধি বিলীন।দেখেত দেখতে বলরামজী শেষনাগে অবতারে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের কাছে আজ্ঞা পেয়ে তিনি বৈকুন্ঠধামে ফিরে গেলেন।বলরাম দেহত্যাগ করার পর মনের দুঃখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বনের মধ্যে চলতে লাগলেন।তারপর তিনি একটি জায়গায় বসে গান্ধারীর অভিশাপ সম্পর্কে বিচার করতে লাগলেন।দেহত্যাগ করার ইচ্ছায় শ্রীকৃষ্ণ চোখ বন্ধ করলেন এবং মহাযোগ অবস্থায় তিনি মাটির ওপর শুয়ে পড়লেন।সেই সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমাধি বিলীন ছিলেন।সেই সময় জরা নামের এক শিকারি হরিণ শিকারের জন্য বনে আসে।তিনি শ্রীকৃষ্ণের চরণকে হরিণের শরীর ভেবে বাণ নিক্ষেপ করেন।বাণ নিক্ষেপ করার পর যখন তিনি শিকারটিকে ধরতে যান তখন যোগাস্থিত শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেয়ে সে তার ভুল বুঝতে পারলো।শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্থ করলেন এবং হওয়ায় বিলীন হয়ে গেলেন।

    এদিকে শ্রীকৃষ্ণের সারথি দ্বারক দেহত্যাগের ঘটনা পাণ্ডবদের গিয়ে জানলেন।এই কথা শুনে পাণ্ডবরা খুব কষ্ট পেলেন।অর্জুন তৎক্ষণাৎ মামা বাসুদেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য দ্বারকা প্রস্থান করেন।অর্জুন যখন দ্বারকা পৌঁছালেন তখন শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী-রা কান্না শুরু করেন।অর্জুনও নিজের চোখের জল ধরে তাখতে পারলেন না।তারপর অর্জুন মামা বাসুদেবের সঙ্গে দেখা করেন।বাসুদেবজি বলেন শীঘ্রই দ্বারকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে।অতঃপর তুমি দ্বারকাবাসীদের তোমার সাথে নিয়ে যাও।এরপর অর্জুন কৃষ্ণের নিকট পরিজন ও বাকি দ্বারকাবাসীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে প্রস্থান করেন।তাদের প্রস্থান করার পরেই দ্বারকা নগরী সমুদ্রে ডুবে যায়।

    ২০০৫-২০০৭ এর মধ্যে (Archaeological Survey of India)-এর নির্দেশে ভারতীয় ডুবুরিরা সমুদ্রের নিচে সমাহিত দ্বারকা নগরীর অবশিষ্টকে খুঁজে পান।যেটি শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর জলজ্যান্ত প্রমান।ডুবুরিরা জলের তলায় ৫৬০ মিটার লম্বা দ্বারকা নগরীর কিছু দেয়ালের খোঁজ পান।তারা পৌরাণিক কালের কিছু বাসনও খুঁজে পান।যেগুলি ১৫০০-৩০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ের হবে।তাদের মতে জলের তলার এই নগরী ৯০০০ সাল পুরোনো।

এইভাবেই ডুবেছিল শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ