পুণ্যতীর্থ দক্ষিণেশ্বর


 হুগলি নদীর তীরে রয়েছে আন্তর্জাতিক পুণ্যতীর্থ দক্ষিণেশ্বর।আজ এখানে ইতিহাস বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছে।হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছেন স্বয়ং মা ভবতারিণী, ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দ।একসময় এই পুণ্যভূমি থেকে যে আধ্যাত্মবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল তা আজও সারা বিশ্বে প্রাসঙ্গিক ও আশির্বাণী এবং শান্তি বহন করে নিয়ে চলেছে।

    দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির তপোভূমি ভারতের দ্যুতিময় কোহিনুর।এই মন্দিরের ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ শব্দ বা অক্ষর নয়, দক্ষিণেশ্বরের কাহিনী আজও যেন চলমান চিত্রনাট্য।

    ব্যারাকপুরে সাবডিভিশনের অন্তর্গত সুদৃশ্য এই মাতৃ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ১৮৫৫ সালে।প্রতিষ্ঠাতা জানবাজারের রানী রাসমণি।

     সেকালের কলকাতার একজন বিদগ্ধ রমণী মহিয়সী নারী রানী রাসমণি।তিনি ১৮৪৭ সালে তাঁর স্বর্গগত স্বামীর স্মৃতির কথা ভেবে কাশী ভ্রমণে যাত্রা করেছিলেন।মনের উদ্দেশ্য যে মা অন্নপূর্ণা ও মহাদেবের কাছে পুজো নিবেদন করবেন।১০০টি ছোট বড় নৌকা নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন।কিন্তু মাঝপথে তিনি স্বপ্নাদেশ পেলেন এবং তাঁর নৌকা যেন থেমে গেলো সেইস্থানে।

    স্বপ্নাদেশে তিনি শুনতে পান, "বারাণসী যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।গঙ্গার তীরে সুদৃশ্য মন্দির তৈরী করে আমাকে প্রতিষ্ঠা কর।সেখানে আমার পুজোর ব্যবস্থা কর।এই রূপেই আমার প্রচার হবে এবং ওখানেই আমি পুজো গ্রহণ করবো"।এই স্বপ্নের মধ্যেই অঙ্কুরিত হয় ভবিষ্যতের দক্ষিনেশ্বর মন্দির।

    তীর্থযাত্রা বাতিল করেন রানী রাসমণি।মন্দিরের জন্য তড়িঘড়ি জমির খোঁজ শুরু হয়।শাস্ত্রের বচন গঙ্গার পশ্চিমকুল বারাণসী সমতুল।কিন্তু পশ্চিম পাড়ে জমি না পেয়ে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে আসেন রানী।

পূর্বকূলে মন্দির স্থাপন শাস্ত্রে খুব একটা অনুমোদিত নয়।কিন্তু রানীমা দেখলেন পূর্ব দিকে জমিটি মন্দির তৈরির জন্য অনুকূল আর তা ছাড়া জমিও পাওয়া যাচ্ছে না।এইখানে নেমে তিনি স্থির করলেন যে এখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে।

    রানী রাসমণি যখন জমি খুঁজছেন তখন ১৮৪৭ সাল।তার ২ বছর আগে ১৮৪৫ সালে ক্যালকাট্টা ভিউয়ের জানুয়ারী সংখ্যায় যে. সি. মার্শমান লিখেছেন, "গঙ্গা তীরবর্তী এই দক্ষিণশোর গ্রামটি দারুন, যা ব্রিটিশরা পেয়েছে।গত ৩০ বছরে এই জমি হাত বদল হয়েছে বহুবার"।১৮৪৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর রানী রাসমণি সাড়ে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে ২০ একর জমি কেনেন। ৫৪ বিঘা জুড়ে ছিল জেমস হেস্টি নামে এক সাহেবের বাগান।যা এলাকায়  পরিচিত ছিল 'সাহেবান বাগান' নামে।কেনা জমির বাকিটা জুড়ে ছিল মুসলিমদের কবরস্থান।

    স্যাটেলাইট-এর ছবি দেখলে এই জমিটিকে মনে হবে এই কচ্ছপের পিঠের ন্যায় দেখতে।এটি তন্ত্র সাধনার জন্য খুব উপযুক্ত।এই জমিটি মুসলিমদের অধীনে ছিল।সেখান থেকে রানী রাসমণি কিনেছিলেন।অতএব পুরোনো যে ধ্যান ধারণা হিন্দুদের মানে যেভাবে হতে হবে  সেদিক থেকে দক্ষিনেশ্বর মন্দির সম্পূর্ণ আলাদা।মুসলিমের জমিতে রানী রাসমণি একেবারে হিন্দু মতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন যে জমিতে সেটি আবার তন্ত্র সাধনার জন্য উপযুক্ত।

১৮৪৭ থেকে ১৮৫৫ প্রায় ৮ বছরে ৯লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরী হয় তিন তলা দক্ষিণমুখী নবরত্ন মন্দির।নয়চূড়া বিশিষ্ট মন্দিরের বিশাল উঠোন।

    গর্ভ মন্দিরে প্রবেশ করলেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে সন্তানের আর্তি।কষ্টি পাথরের সিংহাসনের ওপর ১০৮ রুপোর পদ্ম তার ওপরে সুসজ্জিতা এই ভুবনমোহিনী মা ভবতারিণী।কথামৃতে এই মা ভবতারিনীর রূপের দারুন ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে।

   


শ্রী পাদপদ্মে নুপুর গুজরি পঞ্চম প্যাঁজের চুটকি আর জবা বিল্বপত্র।প্যাঁজের পশ্চিমের মেয়েরা পরে পরমহংস দেবের প্রচুর সাধ তাই মথুরবাবু পরাইয়াছেন।মায়ের হাতে সোনার বাউটি তাবিজ ইত্যাদি।গলদেশে চিক মুক্তার সাতনর মালা, সোনার বত্রিশ নর তারা হার ও সুবর্ণ নির্মিত মুণ্ডমালা, মাথায় মুকুট, কানে কালবালা, কানপাস,ফুলঝুমকো চৌদানি ও মাছ, নাসিকায় নথ নোলক দেওয়া।ত্রিনিয়োনির বন্ হস্তদ্বয় নৃমুণ্ড ও  ওসি, দক্ষিণ হস্তদ্বয় বরাভয়, কটিদেশে নরকর মালা, নিমফল ও কোমরপাটা।

    মা ভবতারিনীর সহযোগী হিসেবে রয়েছেন ১২টি শিব মন্দির।বাংলার স্থাপত্য ঘরানার ৮ চালা মন্দিরের সবগুলোই পূর্ব মুখী।মন্দির চত্বরের উত্তর পূর্বে রাধাকৃষ্ণের দিবালোয়।এখানে রয়েছে সেই মদনমোহন মূর্তি।যার ভাঙা পা নিজের হাতে জুড়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।মাহিষ্য সম্প্রদায়ের রানী রাসমণি জাতিতে কৈবর্ত ছিলেন।১৮৫৫ সালের ৩১শে মে ভবতারিণী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর সব সম্প্রদায়ের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়।প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন শ্রী রামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।



    এখানে আরো একটি ঘটনা রয়েছে।মা ভবতারিনীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় স্নানযাত্রার দিন।জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার দিন যা বৈষ্ণব ধর্মের মানুষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।শাক্ত মন্দির প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে স্নানযাত্রার দিন।এই সময় রানীমা দ্বিতীয় স্বপ্নাদেশ পান।তিনি দেখলেন মা ভবতারিণী ওই কাঠের বাক্সের মধ্যে রীতিমতো ঘেমে উঠছেন।যে মুহূর্তে তিনি ওই স্বপ্নটা দেখছেন তখনি তিনি ঠিক করলেন আর কাল বিলম্ব না করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হবে মায়ের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

    শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন দেবী মৃন্ময়ী নন, তিনি চিন্ময়ী।সেই চিন্ময়ী মূর্তির কাছে রানীমার যে আত্মসমর্পণ সেটি রানীমার চরিত্রের আরেকটি দিক।এই রানীমা যিনি তার সিলমোহরে নাম খোদাই করিয়েছিলেন এই বলে 'কালিপদ অভিলাসী শ্রীমতি রাসমণি দাসী'। মন্দির নির্মাণের পর রানী রাসমণি ৫বছর ৯ মাস বেঁচে ছিলেন।বাংলাদেশের দিনাজপুরে কেনা সম্পত্তি মৃত্যুর আগের দিন মন্দির কর্তৃপক্ষকে দান করে যান তিনি।রাসমণির মৃত্যুর পর দক্ষিণেশ্বরের মাহাত্ম্য আবর্তিত হয়েছে মা ভবতারিণী ও তার অফবিট পূজারী রত্নাকর শ্রী রামকৃষ্ণকে ঘিরে।দাদা রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ যখন প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন তখন তার বয়স ১৯।ঠাকুরের মাসিক বেতন ছিল ৫ টাকা।শেষ শিব মন্দিরের উত্ত পশ্চিম কোনের একটি ঘরে ঠাকুর তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণের এটি প্রিয় সংগীত ছিল "ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন"।তিনি এই ভবতারিণী রূপে ডুব দিয়েছিলেন এবং তুলে এনেছিলেন সাধনলব্ধ মণিমাণিক্য।এখানে তিনি মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী করে তুলেছিলেন।তিনি প্রতিমার নাকে তুলো দিয়ে দেখেছিলেন নিঃশ্বাস পড়ছে।দেবতা আর মানুষের এই মিলন এটি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির।

    দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গা তীরবর্তী পঞ্চবটি ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক গবেষণাগার।অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক, আমলকী নিজের হাতে রোপন করেছিলেন ঠাকুর।মাটি আনা হয়েছিল বৃন্দাবনের শ্যামকুন্ড ও রাধাকুন্ড থেকে।পঞ্চমুন্ডীর আসনে ১২ বছর সাধনা করেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ।



    এখানেই অদৈত্যের সাধনা করতেন ঠাকুর।এই অদৈত্যের শিক্ষা তাকে দান করেছিলেন পাঞ্জাবি সাধু তোতাপুরি মহারাজ।আধ্যাত্মবাদের নানা মত ঠাকুর গ্রহণ করেছেন সবার থেকে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন বহু সাধকের বহু সাধনার দ্বারা ধেয়ে এনে মিলিত হয়েছে তারা।

    আরও একটি নিঃশব্দ বিপ্লবের সাক্ষী এই দক্ষিনেশ্বর।ফলহারিণী কালিপুজোর দিন যেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদাকে ষোড়শী রূপে পূজা করে সারা পৃথিবীর ধর্ম ইতিহাসে একটি ফলক তৈরী করে গিয়েছেন।একদিন যখন মা সারদা ঠুকের পদসেবা করছিলেন তখন মা সারদা ঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি কে? উত্তরে ঠাকুর বলেন, যে মা মন্দিরে যে মা এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন আর এখন যিনি পদসেবা করছেন তাদের সবাইকে এক বলে দেখতে পাই।তুমি সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ।



    যুক্তিবাদী নরেন ও জ্যান্ত কালী দেখা রামকৃষ্ণ-এর সাক্ষাৎ বহুমতের দক্ষিণেশ্বরের অন্যতম বড় ঘটনা।নরেন ছিলেন ব্রাম্হ মতাবলী।তিনি কিছুতেই এই মূর্তি পূজা মানতেন না।কখনো কখনো তিনি ঠাকুরকেও তিরস্কার করতেন যখন ঠাকুর তাকে বলতেন মা আমাকে এটা বলেছেন মা আমাকে ওটা বলছেন।তখন স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন ঐগুলো আপনার মাথার খেয়াল।প্রবল অর্থ কষ্টের মধ্যেও মা ভবতারিনীর কাছে ধনসম্পদ চাইতে পারেনি নরেন।মায়ের কাছে ভিক্ষা করেছিলেন জ্ঞান, বিবেক, ভক্তি আর বৈরাগ্য।



    লৌকিক অলৌকিক টানাপোড়েনের মাঝে স্বমহিমায় উজ্জ্বল দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিণী।জীবনের তিন দশক সময় এখানেই কাটিয়েছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ।ঠাকুরের কারণেই মন্দিরের আজ এতো খ্যাতি।কেশব সেন, গিরিশ ঘোষ, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো স্টলওয়ার্ডরা এসেছিলেন।কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখিয়ে ছেড়েছেন ঠাকুর।

    এ হলো প্রাণের তীর্থ নিছক পূর্ণের টানে নয় অনেকটা মা আর সন্তানের সম্পর্ক যেমন হয় সেইরকম।লক্ষ লক্ষ মানুষ মায়ের কাছে দেখা করতে আসেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ