সতীপীঠ বারাণসী

 


    তপোভূমি ভারতের শ্রেষ্ঠ তীর্থ বারাণসী।গঙ্গার তীরে মন্দিরময় সুপ্রাচীন নগর যার সম্পর্কে মার্ক টন লিখেছেন, "ওল্ডার দ্যান সিভিলাইসেশন"।শক্তি ও শিবের আরাধনায় যুগের পর যুগ স্বীকৃত হয়ে আছে এই বারাণসী।মৃত্যু এখানে মোক্ষলাভের সমান।মাহাত্ম্য মহত্ম্য ও তাৎপর্যের ভিত্তিতে বারাণসী সব তীর্থের মধ্যে তীর্থ অগ্গ্যে বলে বিবেচিত।অনেক মানুষ বারাণসী বলতে কাশী কেই বোঝে।একসময় এই কাশী ছিল মানুষের দ্বিতীয় আশ্রয়।দেবাদিদেব বিশ্বেশ্বরের বাসস্থান এই অবিমুক্ত কাশী।প্রতিটি ভারতীয় জন্মলগ্ন থেকে জানে এই প্রাচীন শহরের মাহাত্ম্য।কাশিতে মৃত্যু হলে আর জন্ম নিতে হয় না আজও সেই বিশ্বাস অটুট।

    সবাই কাশীকে অন্নপূর্ণা বিশ্বেশ্বরের বাসস্থান বলে জানে।সতীপীঠের আলোচনায় তাই মনে হয় এই পীঠের মা অন্নপূর্ণা ও ভৈরব বিশ্বেশ্বর।কিন্তু আসলে তা নয়।সতীপীঠ বারাণসীর পীঠদেবী হলেন বিশালাক্ষী এবং ভৈরব হলেন কালভৈরব।অবিমুক্ত কাশীতে বাবা বিশ্বনাথের মাহাত্ম্যই বেশি।বারাণসী যে পীঠস্থান এই তথ্য অনেকেরই অজানা।তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে, "বারাণস্যং বিশালক্ষ্মী দেবতা কাল ভৈরব মণিকর্ণিকি বৃক্ষতা কুলমঞ্চ মমশ্রুতে"।

    নারী শক্তির জয়ধ্বনি তোলা ভারতে আগে লক্ষ্মী পরে নারায়ণ।তেমনভাবে প্রথমে শিবাণী তারপরে শিব।সাধারণত এই নিয়ম মেনে সতীপীঠ ঘুরে দেখা হয়।কিন্তু এখানে তার ব্যতিক্রম।কারণ বারাণসী ঘুরে দেখতে হলে সবচেয়ে আগে যার অনুমতি লাগে তিনি হলেন কালভৈরব।

    এনাকে কাশীর দ্বাররক্ষী বলা হয়।এখানে সবাইকে প্রথমে পুজো দিতে হয় তবেই তার সমস্ত মনোস্কামনা পূর্ণ হয়।বিশ্বনাথ মন্দির থেকে প্রায় মাইল খানেক উত্তরে প্রতিষ্ঠিত আছে কালভৈরব মন্দির।কালভৈরবই বলেন কাশীধামের দ্বারপাল।কালো রঙের কুকুর তাঁর বাহন।

    বারাণসীতে কালভৈরব কিভাবে এলেন তার উল্লেখ পুরাণে পাওয়া যায়।ব্রহ্মার তপোবলে সৃষ্টি হন শতরূপা নামের এক অতি সুন্দরী রমণী।রূপের ছটায় সৃষ্টিকর্তা নিজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সৃষ্টির প্রতি।শতরূপা কোথায় যায়, কি করে, সবসময় নজরদারি চালাতে থাকে ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক।ব্রহ্মার জ্বালায় অতিষ্ঠ শতরূপা মহাদেবের দ্বারস্থ হন।প্রজাপতির আচরণে ক্ষুব্ধ মহাদেবের ললাট থেকে রুদ্র তেজ উৎপন্ন হয়।তার থেকে সৃষ্টি হন কালভৈরব।শতরূপা দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে কাল ভৈরব ব্রহ্মার পঞ্চম শীর কেটে ফেলেন।ব্রহ্মা হত্যার পাপে কালভৈরবের হাতে আটকে থেকে যায় ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক।বহু জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত মুক্তি মেলে কাশীর কপাল মোচনে।কাশীর দ্বারপাল হিসেবে কালভৈরবকে নিযুক্ত করেন স্বয়ং মহাদেব।

    বারাণসী কেন সতীপীঠ তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।পীঠনির্ণয় তন্ত্র থেকে শিবচরিত, তন্ত্রচূড়ামণি থেকে চন্ডীমঙ্গল এক এক জায়গায় এক এক রকম আখ্যান।সতীপীঠ বারাণসীর মাহাত্ম্য খুঁজে দেখতে হলে প্রথমেই যেতে হবে মণিকর্ণিকা ঘাটে।কারণ মণিকর্ণিকার মহাশ্মশান ঘিরেই যুগ যুগ ধরে আবর্তিত হচ্ছে বারাণসীর সতীকথা।তন্ত্রচূড়ামনিতে বলা হয়েছে এই মণিকর্ণিকাতেই দেবীর কুণ্ডল পড়েছিল।কাশীর জনস্রোতেই মোক্ষলাভের জন্য খ্যাত মণিকর্ণিকায় স্নান করতে এসেছিলেন স্বয়ং হরপার্বতী।স্নানের সময় মহাদেবের মণি ও দেবীর কানের কুণ্ডল পড়ে যায়।আর তা থেকেই নাম হয় মণিকর্ণিকা।

    অনেক খোঁজার পরেও তা পাওয়া যায় নি।তখন মা পার্বতী রাগে অভিশাপ দেন।তিনি বলেন যেভাবে মহাদেবের মণি হারিয়ে যাওয়াতে তিনি রেগে আগুন হয়ে গেছেন সেইজন্য এইখানেও সবসময় আগুন জ্বলতে থাকবে।তখন সমস্ত দেবদেবীরা মাতা পার্বতীর কাছে প্রার্থনা করে এবং মাতা তাদের বলেন আমি আমার অভিশাপ তো ঘুরিয়ে নিতে পারবো না তবে আমি বরদান করছি কাশীতে যার মৃত্যু হবে বা অন্যকোনও স্থানের মৃতদেহ যদি এখানে পোড়ানো হয় তাহলে সে মোক্ষলাভ করবে।


    যেহেতু দেবীর দেহাংশ না পরে কুণ্ডল পড়েছিল তাই শিবচরিতের মতে বারাণসী হলো উপপীঠ।আবার পিঠনির্ণয় তন্ত্র বলছে অন্য কথা।সেখানে বারাণসীকে মহাপীঠ বলে দাবি করা আছে।দেবী হলেন মণিকর্ণি বা বিশালাক্ষী।পুরানবিদদের একাংশের দাবি শিব যখন সতীর দেহ নিয়ে তান্ডব নৃত্য করছিলেন তখন বিষ্ণু চক্র দ্বারা খণ্ডিত দেবীর দেন কানের কুণ্ডল এখানে পড়ে।অনেক আসা নিয়ে যারা বিশ্বনাথ দর্শনে আসেন তারা বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরে যান।সারাবছর পুণ্যার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে।


    মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে বলা হয়েছে, কাশীতে দেবীর বক্ষস্থল পড়েছিল।বারাণসী ক্ষেত্রে দেবী বিশালাক্ষী জাগ্রতা।তিনি গঙ্গার তীরে এক বিশাল তীর্থ তৈরী করেছেন।স্কন্দপুরাণে এইভাবেই অগাস্তো মুনির কাছে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন দেব সেনাপতি কার্তিক।

    পুরাণ ছেড়ে যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে বারাণসীর মাহাত্ম্য স্বীকৃত রয়েছে আরও এক বিরাট আধ্যাত্মিক ব্যাক্তিত্ত্বের মাধ্যমে।তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব।ভ্রমণকালে এই মণিকর্ণিকা ঘটে জ্বলন্ত চিতা দেখে সমাধিস্থ হন ঠাকুর।রানী রাসমণির সেজো জামাই মথুর বাবুর সঙ্গে কাশী গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।গঙ্গায় নৌকা থামানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মথুরবাবু।মণিকর্ণিকার পাশেই বারাণসীর প্রধান চিতাভূমি।নৌকা যখন মণিকর্ণিকা ঘাটের সামনে তখন ঠাকুরের ভাবান্তর হয়।তিনি সমাধিস্থ হন।পরবর্তীকালে ঠাকুর তাঁর শিষ্য ভক্তদের কাছে এই স্থানের অনুভূতির কথা বলেছেন- "দেখিলাম পিঙ্গলবর্ণ জটাধারী দীর্ঘাকার এক শ্বেতকায় পুরুষ গম্ভীর পদবিক্ষেপে শ্মশানে প্রত্যেক চিতার পার্শ্বে আগমন করিতেছেন এবং প্রত্যেক দেহীকে সযত্নে উত্তোলন করিয়া তাহার কর্ণে তারক-ব্রহ্মমন্ত্র প্রদান করিতেছেন।সর্বশক্তিময়ী শ্রী জগদম্বা ও স্বয়ং মহাকালী রূপে জীবের ওপর অপর পার্শ্বে সেই চিতার ওপর বসিয়া তাহার স্থূল সুক্ষ কারণ প্রভৃতি সকল প্রকার বন্ধন খুলিয়া দিতেছেন।এবং নিবারণের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া স্বহস্তে তাঁকে অখণ্ডের ঘরে প্রেরণ করিতেছেন"।সতীপীঠ মণিকর্ণিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের এই দর্শন তীর্থের মাহাত্ম্যকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করে।


    আমরা মন্দির দেখি, বিগ্রহ দেখি এগিয়ে চলি এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে আমাদের গতায়তে অন্তরদীপন এই পর্যন্তই।আলাদা ভাবে দেখতে শিখিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তিনি বলেছেন শিল্পের স্পর্শে যেসব পাথর প্রাণবান তাদের পুরোপুরি বুঝতে গেলে শুধু ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখলে চলবে না।শিল্পকার্য হিসেবে সেগুলো কি সংবাদ দিচ্ছে সেটাও জানা দরকার।উন্মত্ত বিধর্মীর আক্রমণে বারবার ধ্বংস হয়েছে বিশ্বনাথ মন্দির।সেকেন্দার আলী থেকে ঔরঙ্গজেব কে নেই সেই তালিকায় কিন্তু নিশ্চিহ্ন করা যায়নি বিশ্বনাথের মাহাত্ম্য।তপোভূমি ভারতের প্রতিটি তীর্থই নিজগুনে সুন্দর।কিন্তু বারাণসীর মতো এতো ধারাবাহিক সৌন্দর্য্য অন্য কোথাও নেই।বিদেশ থেকে আসা বহু নামি পর্যটক লিখে গিয়েছেন এই কথা।


    শিব ও শক্তির জাগ্রত আদিস্থান এই কাশী।যুগ যুগ ধরে সাধকদের তপস্যায় জাগ্রত হয়েছে এই স্থান।কাশীতে আসার মোক্ষলাভ সম্পূর্ণ হয় তখনি এই গঙ্গাপাড়ে এই গঙ্গা আরতি দর্শন করার পর।দেশবিদেশ থেকে পুণ্যার্থীরা এই গঙ্গা আরতি দর্শন করে আসেন।এখানেই বারাণসীর গঙ্গার আসল মাহাত্ম্য।কেবল সতীপীঠ নয় সংস্কৃতি ও বিদ্যার পীঠস্থান।দীর্ঘ সময় ধরে এখানে সঞ্চিত হয়েছে শুভভাব।চারিদিকে তৈরী হয়েছে এক ভাবঘন রূপ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ