বৃন্দাবনের রাধারমণ মন্দিরের অলৌকিক কাহিনী

 


    বৃন্দাবনে সর্বাধিক পূজিত এবং জনপ্রিয় বিখ্যাত মন্দির হলো রাধারমণ মন্দির।এই রাধারমণকে বৃন্দাবনের মধ্যে পবিত্র পূজনীয় বলে মনে করা হয়।রাধারমণ কথার অর্থ রাধার প্রেমিক।এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণকে রাধারমণ রূপে পুজো করা হয়।এই রাধারমণ হলেন স্বয়ংভূ।শালগ্রাম শিলা থেকে স্বয়ং প্রকটিত হয়েছিলেন।তাঁর পিঠে এখনো শালগ্রামের চিহ্ন দেখা যায়।এই রাধারমণ মূর্তিটি একফুট উচ্চতা বিশিষ্ট।এই মন্দিরে শ্রীরাধারানীর কোনো মূর্তি নেই।শাস্ত্র অনুযায়ী নাম আর ব্যক্তি অভিন্ন সেই কথা মেনে এখানে রাধারাণীর নামে পূজা হয়।শ্রীকৃষ্ণের পাশে একটি সোনার মুকুট রাধারাণীর নামে রাখা হয়েছে সেই মুকুটে রাধার নামে পুজো করা হয়।এই মুকুটের পাশেই বাকি মূল শালগ্রাম শিলা গুলি রাখা রয়েছে।এই মন্দিরের বিশেষত্ব হলো মোঘল হামলার পরও রাধারমণজি বৃন্দাবন ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি।হামলার সময় মন্দিরের ফুলের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিলেন।এছাড়াও জন্মাষ্টমীর সময় যখন সারা পৃথিবীতে কৃষ্ণ মন্দিরগুলিতে রাত ১২টার সময় পুজো শুরু হয় কিন্তু রাধারমণ মন্দিরে জন্মাষ্টমীর পুজো শুরু হয় বেলা ১২টার সময়।মনে করেন রাতে ঠাকুরকে তোলা ঠিক নয়।তাই সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে।এছাড়াও এই মন্দিরে পৌনে পাঁচশো বছর থেকে বিনা দেশলাই প্রয়োগে ঠাকুরজির আরতি হয়ে আসছে।শুরুর দিকে মন্দিরের প্রথম আরতির সময় অগ্নি ও বজ্রিক মন্ত্রের সাহায্যে ৪৭৫ বছর পূর্বে অগ্নি প্রকট করা হয়েছিল।সেই থেকে গোপালভট্ট গোস্বামীর মনে অরণ্য মন্ত্রনের সাহায্যে আরতি করা হয়।সেই জন্য আরতির অগ্নি দেশলাই প্রয়োগ করে জ্বালাতে হয় না।

    এই রাধারমণ হলো গোপালভট্ট গোস্বামীর সেবিত বিগ্রহ।এই রাধারমণ বিগ্রহের আবির্ভাবের কাহিনীটিও অপার্থিব।কারণ এই বিগ্রহ কেউ প্রকট করেননি।ভগবান আপন ইচ্ছাতেই এই শিলায় বিগ্রহ রূপে প্রকট হয়েছিলেন।একদিন গোপালভট্ট গোস্বামী স্বপ্নে দেখেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলছেন আমার দর্শন পেতে হলে নেপাল যাও।স্বপ্নাদেশ মতো তিনি নেপালে যান।সেখানে গিয়ে গোপালভট্ট গোস্বামী বিখ্যাত কালীগণ্ডকী নদীতে স্নান করেন।স্নান করার সময় নদীতে যখন জলপাত্র নিমজ্জিত করেন তখন ১২টি শালগ্রাম শিলা পাত্রে উঠে আসে।তিনি শিলাগুলিকে জলে ফেলে দিয়ে পুনরায় পাত্রটিকে জলে নিমজ্জিত করেন।পুনরায় ১২টি শালগ্রাম শিলা উঠে আসে।তখন তিনি জলের মধ্যে থেকে শব্দ শুনতে পান।কে যেন বলছে এই শিলাগুলি তুমি বৃন্দাবনে নিয়ে যাও আর এইগুলিতে পূজা আরম্ভ করো।এরপর গোপালভট্ট গোস্বামী ওই ১২টি শালগ্রাম শিলা নিয়ে বৃন্দাবনে চলে আসেন।তারপর তিনি মন প্রান দিয়ে সেই শিলাগুলির পূজা শুরু করেন।তার এই সেবা পূজা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে মহাপ্রভু বলেছিলেন তোমার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং শ্রীহরি শালগ্রাম শিলায় আবির্ভুত হবেন।১৫৪২ সালে গোপালভট্ট গোস্বামী সেই শালগ্রাম শিলা নিয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলেন।বৃন্দাবনে তখন রূপ গোস্বামী সনাতন গোস্বামীর থাকতেন।তাঁরা সাদরে গোপালভট্ট গোস্বামীকে আমন্ত্রণ করে নেন।তখন বৃন্দাবনে সকল সম্প্রদায় রসিক আচার্যরা নিধিবনে একত্রিত হয়ে সৎসঙ্গ করতেন।সেই সৎসঙ্গে তারা আপন আপন বিগ্রহ নিয়ে মনের ভাব ব্যক্ত করতেন।সেই সঙ্গে সবাই নিজের ভক্তিমূলক রচনাও পরে শোনাতেন।

    এইরকম এক সৎসঙ্গের দিন এক ধনী বণিক সেখানে আসেন এবং প্রত্যেক মন্দিরের বিগ্রহের জন্য বহু মূল্যবান বস্ত্র, আভূষণ অলংকার উপহার দিয়ে যান।গোপালভট্ট গোস্বামী সেই উপহার নিতে রাজি হননি।কারণ গোলাকার শালগ্রাম শিলায় সেইগুলো ব্যবহার করা যায় না।তিনি দাতাকে সেগুলো অন্যকোথাও দেন করতে বলেন।কিন্তু দাতা তা করতে অস্বীকার করেন এবং গোপালভট্ট গোস্বামীকেই সেগুলো দেন করে যান।তখন গোপালভট্ট গোস্বামী বলেন হে শালগ্রাম প্রভু আপনি যদি শিলাবিগ্রহ হতেন তাহলে আমি আপনাকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে তুলতে পারতাম।তারপর তিনি সেই শালগ্রাম শিলাগুলিকে একটি বাঁশের ঝুড়িতে শয়ন দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।সেদিন রাত শেষ হওয়ার আগেই ঠাকুর তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন- "ওঠো গোপালভট্ট! জাগো।তোমার সেবায় আমি প্রসন্ন হয়েছি।তোমার বাসনা অনুসারে আমি রাধারমণ রূপে প্রকটিত।শ্রীগোবিন্দদেবের মুখ, শ্রীগোপীনাথের বুক ও শ্রীমদনমোহনের শ্রীচরণ আমারই মতো।সেই তিনরূপ একসাথে নিয়ে আমি শালগ্রামে আবির্ভুত হয়েছি।তাই ভক্তরা আমাকে দর্শন করলে একসাথে তিন ভগবানের কৃপা পাবে"।স্বপ্নে এইকথাগুলি শুনে গোপালভট্টের ঘুম ভেঙে যায়।জেগে উঠে গোপাল ভট্ট যখন সালগরম শিলাগুলি দেখতে যান তিনি অবাক হয়ে যান।শিলার মধ্যে বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে।মোট ১১টি শিলা রয়েছে এবং একটি শিলা মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।তৎক্ষণাৎ তিনি বৃন্দাবনের অন্যান্য গোস্বামীদের ডেকে এনে সব বৃত্তান্ত খুলে বলেন।গোস্বামীরা সব কিছু শুনে মূর্তিটির অভিষেক করেন।


    বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এখানে প্রতিষ্ঠিত হলেন শ্রী রাধারমণ।তারপর গোপালভট্ট গোস্বামী প্রেমপূর্বক চিত্তে বস্ত্র ভগবানকে পরালেন এবং এই বিগ্রহকে রাধারমণ রূপে অলংকৃত করলেন।তারপর থেকে এই বিগ্রহ বৃন্দাবনে শীর্ষ পরম্পরায় সেবিত হয়ে আসছেন।৬২ বছর সেবা ওরেন গোপালভট্ট গোস্বামী প্রথমে গোস্বামীদের প্রতিষ্ঠিত ছোট্ট একটি মন্দিরে শ্রীরাধারমন বিরাজ করতেন।সেই সময় জয়পুরের মহারাজা মানসিং শ্রীরাধারমণের প্রকট স্থলে লাল পাথরের দোল মণ্ডপ নির্মাণ করেন।পরে ১৬৫১ সাল নাগাদ দিল্লির আগারওয়াল শেঠ এখানে একটি বড় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ঔরঙ্গজেব এই মন্দির আক্রমণ করেন এবং সবকিছু ধ্বংস করে দেন।সেই সময়ের তৎকালীন পূজারী তাকে নিয়ে চলে যান ফারুকাবাদে।ঔরঙ্গজেবের আক্রমণ শেষ হলে রাধারমণ আবার বৃন্দাবনে ফিরে আসেন এবং গোস্বামীদের সেবা গ্রহণ করতে থাকেন।অবশেষে বিক্রম সংঘাত ১৮৭৯ সালে লখ্নৌয়ের নবাব ওয়াজ আলী শাহ, মন্ত্রী কুন্দলাল এবং কুন্দলালের পিতামহ লাল বিহারী লালজি রাধারমণের বর্তমান মন্দির নির্মাণ শুরু করেন।১৮৮৪ সালের মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে এই মন্দিরে রাধারমনজির নতুন করে স্থাপনা হয়।


    শালগ্রাম শিলা প্রাপ্তির আরেকটি কাহিনী রয়েছে।বল্লবভট্ট যখন চৈতন্যমহাপ্রভুর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এই নীলাচলে তখন মহাপ্রভুর কাছে গোপালভট্ট গোস্বামীর ব্যাপারে খুব সুনাম শুনেছিলেন।তাই বল্লবভট্ট যখন বৃন্দাবনে যান তখন ঠিক করেন বৃন্দাবনে যেহেতু গোপালভট্ট গোস্বামী রয়েছেন তাঁর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন।যমুনা নদীর তীরে দুজনের সাক্ষাৎ হয়।এই বল্লবভট্ট মনে মনে বিচার করেন এর মধ্যে মহাপুরুষের লক্ষণ রয়েছে।সমস্ত গাঢ় প্রেম লক্ষণ স্পষ্ট।একনাকে দর্শন করলে দর্শনহেতু কিছু দক্ষিনা আমাকে প্রদান করতে হবে।তাই বল্লবভট্ট তার ঝোলা থেকে একটি শালগ্রাম শিলা গোপালভট্ট গোস্বামীকে দক্ষিণা স্বরূপ দান করলেন।

    এই মন্দিরের আলাদা একটি চত্বরে গোপালভট্ট গোস্বামীর সমাধি রয়েছে।গোপালভট্ট গোস্বামীকে চৈতন্যমহাপ্রভু উপহার স্বরূপ একটি কোপিন পাঠিয়েছিলেন সেই বস্ত্রখণ্ড এইমন্দিরে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ