ধ্রুবতারার পৌরাণিক কাহিনী

   


 অনেক বছর আগে উত্তনাপদ নামের এক রাজা ছিলেন।রাজার দুই রানী ছিল।বড়ো রানীর নাম সুনীতি ও ছোট রানীর নাম সুরুচি।সুনীতির এক পুত্র ছিল যার নাম ধ্রুব আর সুরুচির ও এক পুত্র ছিল, যার না উত্তমান।ছোটোরানী সুরুচি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী।রাজা সুরুচির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে সবসময় ছোটরানীর মহলেই থাকতেন।এই জন্য রাজা মাসে একবারও রানী সুনীতির মহলে যান নি।একদিন যখন ধ্রুব সুরুচির মহলে এলো উত্তমান তখন তার পিতার কোলে বসে খুব মজা করছিলো আর রাজা তাকে আদর করে আনন্দ করছিলেন।এটা দেখে ধ্রুবও দৌড়ে গিয়ে নিজের পিতার কোলে চড়ে বাং পাশের কোলে বসে পরে।কিন্তু এটা রানী সুরুচি কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না।তুমি এখানে কেন এসেছো ধ্রুব এই বলে সে টেনে ধ্রুবকে তার পিতার কোল থেকে নামিয়ে দেয়।ধ্রুব রানী সুরুচি কে জানায় সেও তার পিতার কোলে বসতে চায়।এই কথা শুনে রানী সুরুচি বলে এই অধিকার একমাত্র তার পুত্র উত্তমানের আছে।তাই পরজন্মে আমার পুত্র হয়ে জন্ম নেয়ার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর।তবেই তুমি মহারাজের কোলে বসার অনুমতি পাবে।

    এই কথা শুনে ধ্রুব কাঁদতে কাঁদতে পিতার দিকে তাকায় এবং তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে পালিয়ে আসে তার মা সুনীতির কাছে।ধ্রুবকে কাঁদতে দেখে সুনীতি আদর সহকারে তাকে জিজ্ঞাসা করে।কেউ কি তোমায় বকেছে ধ্রুব ? তুমি এতো দুখী কেন ? আমার পিতা কেন আমাকে ভালোবাসেনা।কেন তিনি আমাকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।কোনো পথ আছে মা?

    সুনীতি উত্তরে বলেন এই বিশ্বে নিরাদর মানুষের জন্য একজনই আছেন তিনি ভগবান বিষ্ণু।এই শুনে ধ্রুব ভগবান বিষ্ণুর দর্শন পাওয়ার সমস্ত কথা মা সুনীতির কাছে জানতে থাকে।এই কথা শুনে ধ্রুব ভগবান বিশুর খোঁজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলো।কিন্তু পুত্রকে এক পাঠাতে সুনীতির একদমই মন ছিল না।কিন্তু কোনো উপায় না পেয়ে সুনীতি ধ্রুবকে অনুমতি দেয় এবং তার সমস্ত রাজকীয় পোশাক নিয়ে তাকে সাধারণ মানুষের পোশাক পরিয়ে দেয়।সুনীতি ধ্রুবকে বলে এই রাজ্য পরিত্যাগ করে জঙ্গলে যায় পুত্র আর সেখানে এক মনে ভগবানের প্রার্থনা কর।ভগবান ভালো মনের ভক্তকে নিরাশ করেন না সর্বদা সমাদর করেন।তাই তুমি সবকিছু ভুলে শুধু ভগবান বিষ্ণুকেই স্মরণ করো।যেদিন তিঁনি তোমাকে দর্শন দেবেন সেইদিন তুমি তোমার মনের সমস্ত কথা ভগবান কে জানিয়ো। সবসময় ভগবান তোমার সাথে থেকে তোমার রক্ষা করবেন।

    এরপরই ধ্রুব মাতা সুনীতিকে প্রণাম জানিয়ে জঙ্গলের দিকে প্রস্থান করে।ধ্রুব যত এগোতে থাকলো ততই তার থেকে তার রাজ্যের দূরত্ব বাড়তে লাগলো।তখন সেই স্থানে দেবর্ষী নারদ ধ্রুবকে দেখে প্রশ্ন করে -"কে তুমি বালক ? এইরূপ পোশাক পরিধান করে কোথায় যাচ্ছ ? এই পথ তো জঙ্গলের দিকে যায়।নগর রাস্তা তো তোমার পশ্চাতে।এই জঙ্গলে তো অনেক ভয়ংকর পশু-পাখি থাকে।আমার সাথে চলো আমি তোমাকে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাবো"।

    এই শুনে ধ্রুব দেবর্ষীকে প্রণাম জানিয়ে বলে-"পিতার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি ভগবানের দর্শন করতে এসেছি।যতদিন না তা সম্পূর্ণ হচ্ছে আমি এই জঙ্গলেই থাকবো।"

    দেবর্ষী বলেন- "তুমি এখনো বালক তপস্যা তো বড় মুনি ঋষিরাও পারে না।তুমি যদি ফিরে যায় তোমার মা অত্যন্ত খুশি হবেন ।তুমি ফিরে চলো"।

    ধ্রুব উত্তরে বলে- "যে ভগবানকে মানে তাকে কখনোই ভগবান নিরাশ করেন না।এই কথা আমার মা আমাকে বলেছেন।আমার পিতা আমাদের কে ভালোবাসেন না।আমাকে আমার পিতার ভালোবাসা আদর পেতে হবে।তাই আমি বনে থাকে ভগবানকে স্মরণ করতে চাই।আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন মহর্ষি"।

    ধ্রুবের এই কথা শুনে নারদমুনী অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন।তিনি ধ্রুবকে আশীর্বাদ করে বলেন তুমি যে পথ ধরে আছো সেই পথে যদি তুমি সবসময় থাকতে পারো তাহলে তুমি নিশ্চয়ই ভগবানের দর্শন পাবে।তুমি যমুনা নদীর তীরে যাও ওখানে মধুবনে তুমি তপস্যা করো।মধুবন তপস্যার জন্য অতি উত্তম স্থান।প্রথমে নদীতে স্নান করে তুমি তপস্যা শুরু করো।তুমি নিশ্চই সফল হবে।এরপর দেবর্ষী নারদ ভগবান নারায়ণের ধ্যানমন্ত্র ধ্রুবকে বলেন।

    এরপর ধ্রুব দেবর্ষী নারদকে প্রণাম জানিয়ে যমুনা নদীর দিকে যাত্রা শুরু করে।যমুনা নদীতে স্নান করে ধ্রুব মধুবনে পৌঁছে তপস্যা শুরু করে দেয়।ভোজন ও নিদ্রাকে ত্যাগ করে শুধুই তপস্যায় বিলীন হয়ে থাকতো।প্রথম মাসে ধ্রুব তিন দিনে একবার ২টি ফল খেতো।পরের মাসে ছয় দিনে কিছু পাতা খেতো।তৃতীয় মাসে সে কেবলমাত্র নয় দিনে একবারই জল পান করে থাকতো।চতুর্থ মাসে শুধুমাত্র বাতাস খেয়ে থাকতো।পঞ্চম মাস থেকে ধ্রুব এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে কঠিন তপস্যা শুরু করে।বালক ধ্রুবের এই কঠিন তপস্যা ত্রিলোক কেঁপে উঠেছিল।

    তখন উপায় না দেখে দেবগণ বৈকুন্ঠে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়।ধ্রুবের তপস্যায় খুশি হয়ে বিষ্ণুদেব ঠিক করলেন এবার তিনি ধ্রুবকে তার রূপ দর্শন দেবেন।তাই তিনি গরুড় বাহনে করে ধ্রুবের সামনে উপস্থিত হন।বালক ধ্রুব তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট হয়েছি।তুমি যা চাও আমি তোমায় তাই প্রদান করবো।প্রথমে তুমি তোমার চোখ তো খোলো।

    ধ্রুব উত্তরে বলে ভগবান গত পাঁচ মাস ধরে এইরকম অনেক দৈবকথা শুনে আমি নিজের চোখ খুলেছি।কিন্তু আপনার স্বরূপ আমি কখনোই দেখতে পাইনি।আমি তখন বুঝতে পারি এটা আমার মনের ভুল।আমার মাতা বলেছেন আপনি যেকোনো সময় আমার সামনে এসে উপস্থিত হতে পারেন।যদি আপনি সত্যই আমার সামনে এসে থাকেন তাহলে আমার মনের দৃষ্টিতে আপনার স্বরূপ প্রকাশ করুন প্রভু।তখনি আমি বিশ্বাস করবো।এই কথা শুনে ভগবান হাসিমুখে ধ্রুবের মনের দৃষ্টিতেও নিজেকে প্রকাশ করেন।ধ্রুব মনের দৃষ্টিতে বিষ্ণুর স্বরূপ দেখতে পেয়ে চোখ খোলে এবং ভগবান বিশুর চরণ স্পর্শ করে।


    ভগবান বিষ্ণু ধ্রুবকে বলেন আশীর্বাদ করে বলেন তোমার সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হবে।তুমি তোমার রাজ্যে ফিরে যাও সেখানে তুমি শাসন কর।তোমার পিতা তোমাকে সবসময় ভালোবাসবেন।আমি তোমাকে এক লোক প্রদান করবো যার আধারে সমস্ত গ্রহনক্ষত্ররা ঘুরতে থাকে এবং যার চারপাশে জ্যোতিষচক্র পরিক্রমণ করে।এই লোকের কখনো বিনাশ হয় না।সপ্তঋষীরাও নক্ষত্রদের সাথে এই লোক প্রদক্ষিণ করে।এই লোকের নাম তোমার নাম পরিচিত হবে।সবাই এই লোক ধ্রুবলোক নামে জানবে।ছত্রিশ সহস্র বছর ধরে তুমি পৃথিবীকে শাসন করবে।সবশেষে তুমি আমার লোক প্রাপ্ত হবে।এই বরদান দিয়ে ভগবান বিষ্ণু সেইস্থান থেকে চলে যান।ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে ধ্রুব সময়পরে ধ্রুবতারাতে পরিণত হয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ