পুণ্যতীর্থ সতীপীঠ অমরকণ্টক


তপোবন ভারতবর্ষ।এদেশের অসংখ্য নগর, গ্রাম, বন, উপবন এমনকি দুর্গম পাহাড়ের ঢাল সুসজ্জিত হয়ে আছে দেবতার মন্দিরে।এইসব তীর্থ, মন্দির অনাদিকালের ঘুম ভাঙানোর জায়গা।তীর্থের মাটি জল স্পর্শ করলে জেগে ওঠে আমাদের প্রকৃত সত্ত্বা।তাইতো ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন-"তীর্থে গেলে উদ্দীপন হয়"

    একদিকে সাতপুরার বিন্ধ্যপর্বত মাঝে মেখল পাহাড়ের চূড়ায় পুণ্যতোয়া নর্মদার তটে পুণ্যতীর্থ অমরকণ্টক।রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কেন্ডীয় পুরাণ এমনকি মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত সর্বত্রই এই অমরকণ্টকের নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা বলা হয়েছে।সতীপীঠ হিসেবে অমরকণ্টক বিশেষ উল্লেখযোগ্য মা নর্মদার কারণে।

    "মেঘ এই যে আম্রকুট পর্বতের কথা কহিলাম ও শুধু নামে নহে সত্যি ওর শিখর দেশটি আমগাছে ভরা।তাই ওর নাম আম্রকুট।মেঘ তেল কুচকুচে মিশমিশে কালো চুলের বেনীর মতো তোমার রং।তুমি গিয়া যখন ওই পাণ্ডুবর্ণ নৈবেদ্যকার শৃঙ্গের ওপর বসিবে তখন আকাশ হইতে দেব-দম্পতিরা নিচের দিকে চাহিলে দেখিবেন যেন ধরণীর সুন্দরীর তিন প্রয়োচর শোভা পাইতেছে।আলোকপুরীতে নির্বাসিত যক্ষ বিরহে কাতর।মেঘকে অনুরোধ করেছেন পত্নীর খবর নিতে।মহাকবি কালিদাস তার বর্ণনায় আশ্চর্য সুন্দর ছবি এঁকেছেন নর্মদার উৎসমুখ অমরকণ্টক পর্বতের।

    পাহাড়ি পথের দুই ধরে অজস্রো গাছ।এই পথের আকর্ষণই আলাদা।গিরিখাত আর গাছগাছালির বিচিত্র বিন্যাস বাতাসের গুনগুনানি মহুয়ার নেশার মতো মাতাল করে দেয়।

    গোটা অমরকণ্টকই মন্দিরময় আর অমরকণ্টকের যাবতীয়র কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মা নর্মদার মন্দির।এখন থেকেই নর্মদা নদীর উৎপত্তি।এখান থেকেই নর্মদা প্রবাহিত হয়েছে গোটা অমরকণ্টকে।আর অমরকণ্টকের যাবতীয় মহিমাকে ঘিরে রয়েছে এই মা নর্মদাই।



    তিনদিন সরস্বতীতে স্নান করলে, এক সপ্তাহ যমুনাতে স্নান করলে এবং গঙ্গাতে স্নান করলে পাপের যে ক্ষয় ও যে পুণ্য অর্জন হয় তা এই মা নর্মদার দর্শনেই হয়ে যায়।এতটাই মহিমা এই মা নর্মদার এই কলিযুগে।

    বহুপ্রাচীন বিন্ধ্য পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ হলো অমরকণ্টক।এখান থেকেই পৌরাণিক নদী নর্মদার যাত্রা শুরু।শত শত বছর ধরে কুণ্ডে উঠে আসা জল বেরোনোর জন্য রয়েছে একটি নালার সংযোগ।এর নাম গোমুখ নালা।গোমুখ নালার মধ্যে দিয়ে নর্মদা এসে পড়েছে কোটিতীর্থে।

    পৌরাণিক কথা অনুসারে যখন ভগবান শিব বিষ পান করেছিলেন এবং ওই বিষের জ্বালাযন্ত্রণা থেকে মহাদেব চারিদিকে ভ্রমণ করতে থাকেন।তিঁনি যখন এই বিন্ধ্য পর্বতের ওপর দিয়ে যাত্রা করছিলেন সেই সময় যখন তিনি মহাকাল পর্বতের ওপর দিয়ে যান তখন আকস্মিক তাঁর কন্ঠে যে বেদনা ছিল তা সমাপ্ত হয়ে যায়।যেখানে এখন নর্মদা কুণ্ড রয়েছে ওখানে একটি বাঁশঝাড় ছিল।পুরাণমতে, ৫০০০ বছর পর্যন্ত ভগবান শিব সমাধিতে বিলীন ছিলেন।তখন ওনার কণ্ঠ থেকে যে ঘাম বেরিয়ে এসেছিলো তাহাই নর্মদা নদীর উৎপত্তির হেতু।

    স্বয়ং মহাদেবের তপস্যার ফল নর্মদা।এই সতীপীঠের মাহাত্ম্য অনেক।মহাদেব নর্মদাকে বলেন তুমি এখন থেকে পশ্চিমে যাও এবং তোমার দুই তটে যা সমস্ত পাষান থাকবে তা আমার স্বরূপ হয়ে যাবে।এই জন্য বলা হয় নর্মদার সমস্ত কাঁকর সবই মহাদেব শংকর।

    অমরকণ্টক সাধনতীর্থ।কথিত আছে কপট পাশাখেলার হারের ক্ষত জুড়োতে নর্মদার তীরে ধ্যান করেছিলেন প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির।পুরাণ বলে, নারদ, বশিষ্ঠ, কপিল, ভৃগু ও দুর্বাশার মতো মহান মুনিঋষিরা তপস্যা করেছেন নর্মদা তীর্থ অমরকণ্টকে।

    এখানে তিনটি নদীর উৎপত্তি।নর্মদা, শোন ও জোহিলা।এখানে তিনটি পর্বতেরও সঙ্গম।বিন্ধ্য, সাতপুরা ও মহাকাল।এলাকার মানুষের বিশ্বাস মা নর্মদার প্রতিটি কাঁকরই হলো ভগবান শংকর।এখানে রয়েছে কপিল ধারা।এখানের গহন অরণ্যে বসে সাধনা করেছিলেন কপিলমুনি।হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী অমরকণ্টকের মহামোক্ষ ক্ষেত্র হলো এই কপিল ধারা।


    মাথা উঁচু করে জেগে মৌন পর্বত একেবারে ধ্যানস্তব্ধ।কপিল ধারার বিরামহীন ধারাপাত।সব মিলিয়ে অমরকণ্টক এক মায়াময় অধ্যাত্মভুমি।

    নর্মদা সমস্ত নদীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর অমরকণ্টক হলো একাধারে শৈবপীঠ, তন্ত্রপীঠ ও অঘোরপীঠ।তপস্যার উত্তমভূমি নর্মদা তট।এখানে তপস্যা করলে অন্য যেকেনো স্থানে তপস্যার চেয়ে অধিক ও দ্রুত ফল লাভ হয়।তাই প্রাচীনকাল থেকে সমস্ত মুনি ঋষি সাধনের জন্য নর্মদা পীঠ কেই বেঁচে নিয়েছিলেন।

    নর্মদা নদী থেকে ৪-৫ কিমি দূরে শোনমোড়া।শোন নদীর উৎপত্তিস্থলে গড়ে উঠেছে দেবী সোনাক্ষির মন্দির।যা ৫১ সতীপীঠের অন্যতম পীঠ।দক্ষযজ্ঞে সতীর প্রাণ ত্যাগের পর মহাদেব যখন তাকে কাঁধে করে জগৎ পরিভ্রম করছেন তখন ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহ খন্ড বিখন্ড করেন।সতীর দেহাংশ যেখানে যেখানে পড়েছে সেখানে গড়ে উঠেছে মহা শক্তিপীঠ।কথিত আছে শোনমোড়ায় দেবীর বাম নিতম্ব পড়েছিল।বিষ্ণু চক্রে খণ্ডিত সতীদেহের অংশ অমরকণ্টকের কোথায় পড়েছিল তা নিয়ে পন্ডিতমহলে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।একদল শাস্ত্রজ্ঞ বা পন্ডিতদের মতে অমরকণ্টকের শোন নদীর তীরে সোনাক্ষি দেবীর মন্দির গহন অরণ্যের মধ্যে এখানেই দেবী সতীর বাম নিতম্ব পড়েছিল।



    যেখানে সত্যি সেখানেই শিব।সোনাক্ষী দেবীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে শিব লিঙ্গ।মহাদেব এখানে মহাকাল ভদ্রসেন নাম পূজিত হন।সতীপীঠের স্থান নির্বাচন নিয়ে মতভেদ থাকলেও অমরকণ্টকের স্থান মাহাত্ম্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই।তীর্থভূমি ভারতের বুকে এই জায়গা এখানে সাধু সন্ত ও মহাত্মা তীর্থ অভিলাসীদের যুগ যুগ ধরে আওহ্বান করে চলেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ