বৃন্দাবনের মদনমোহন মন্দিরের ইতিহাস

 


বৃন্দাবনের মদন মোহন মন্দির।এটি দেবদাস আদিত্য নামক টিলার ওপর অবস্থিত।এই মন্দিরে রাধারানী , মদনমোহন, ললিতাসখীদের সাথে পুজো করানো হয়।এই মন্দিরে আজও শুকনো রুটি ও লবন ছাড়া ভোগ নিবেদন করা হয়।এই মন্দিরের মূল বিগ্রহের প্রতিমূর্তি পূজিত হন।

    এই মন্দিরের বিগ্রহটি ভগবান রামচন্দ্র থেকে প্রাপ্ত।এটি পেয়েছিলেন তার ভাই শত্রুঘ্ন। রামচন্দ্র যে সময় রাজা ছিলেন সেই সময় বৃন্দাবনে লবণাসুর নামক এক অসুর বৃন্দাবন বাসীদের জীবন অতিষ্ঠ  তুলেছিল।সেই সময় রাজা রামচন্দ্রের আদেশে এই বৃন্দাবনে ভাই শত্রুঘ্ন এই লবণাসুরকে বধ করার জন্য আসেন।রাম শত্রুঘ্ন কে আদেশ করেন লবণাসুর বধের পর তিনি যেন কিছুকাল সেখানে বসবাস করেন।শত্রুঘ্ন এই আদেশ পালন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন।তিনি প্রত্যহ সকালে দাদা রামচন্দ্রের মুখ দর্শন না করে কিছু সেবা গ্রহণ করেন না।এই সমস্যার সমাধান হিসেবে রামচন্দ্র এই মদন মোহন বিগ্রহটি দিয়েছিলেন।তিনি বলেছিলেন এটি দর্শন করা মানেই আমাকে স্বয়ং দর্শন করা।এই বিগ্রহ আর আমার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।আমরা এক ও অভিন্ন।এর পরেই শত্রুঘ্ন মূর্তি নিয়ে বৃন্দাবনে চলে আসেন এবং লবণাসুর কে বধ করে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করেন।এই বিগ্রহ রাখার অসুবিধার জন্য মদন  মোহন বিগ্রহটিকে একটি বট গাছের তলায় রাখে দেন।পরবর্তীকালে এই বটগাছের থেকে এই মূর্তি প্রাপ্ত হয়।

    অপর একটি তথ্যমতে, শ্রীকৃষ্ণের পপৌত্র ব্রজনাথ মথুরা রাজসিংহাসনে থাকার সময় এই মদন মোহন বিগ্রহটি নির্মাণ করেন।



    পরবর্তীকালে, কয়েক হাজার বছর পর এই মদন মোহন বিগ্রহটি হাত বদল হতে হতে ভক্তিভাব যুক্ত চৌবে পরিবারের নারায়ণ চৌবের হাতে এসে পড়ে।এই মদন মোহনের খাওয়া-দাওয়া করানো, ওনাকে সিংহার করানো এই সমস্ত কাজ চৌবেস পত্নী নিজের হাতে করতো।মদন মোহন বিগ্রহকে তিনি নিজের সন্তানের মতো রাখতেন।

    বৃন্দাবন সেই সময় জঙ্গলে ভরা ছিল।সেইসময় লীলাপ্রকাশের জন্য চৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন গোস্বামীকে বৃন্দাবনে পাঠালেন।মহাপ্রভুর নির্দেশে সনাতন গোস্বামী দেবদাস আদিত্য টিলায় আসেন এবং সেখানে বসে ভগবানের ভজন করছিলেন।জীবিকা নির্বাহের জন্য মথুরার বিভিন্ন পাড়ায় ভিক্ষা করতেন।তারপর ভিক্ষা নিয়ে গোবর্ধনে যেতেন।সেখানে ২১ কিলোমিটার গোবর্ধন পরিক্রমা করতেন তারপর আবার এই বৃন্দাবনের এই টিলায় আবার ফিরে আসতেন।এটাই ছিল সনাতন গোস্বামীর  নৈমিত্তিক কাজ।এইরকম কোনও একদিনে সনাতন গোস্বামী মথুরার চৌবে পরিবার যে পাড়ায় থাকতো সেই পাড়ায় ভিক্ষা করতে যান।সেই বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি শব্দ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন।শব্দ শুনে অনুসরণ করে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন চৌবে পত্নী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিকে ধমক দিচ্ছিলেন।খাওয়ার খাওয়ানোর বিষয়ে।সনাতন গোস্বামী বাড়ির ভেতরে উপস্থিত হলেন এবং সব দেখে শুনে বললেন-"এটি খুব অন্যায়।ভগবানকে প্রেম সহকারে খাওয়ার খাওয়ানোর পরিবর্তে তুমি তাকে ভয় দেখিয়ে খাওয়ার খাওয়াছো"।এই কথা শুনে নারায়ণ চৌবে বলেন- "অনেক দেরি হয়ে গেছে প্রভু।অনেক সময়ধরে বলেও খাওয়ার খাচ্ছেন না।তাই এই অবস্থায় পৌঁছেছি প্রভু"।তখন চৌবে পত্নী সনাতন গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন- "বলুন মুনিবর কি নিয়ম হওয়া উচিত এই ভোগ নিবেদনে।আপনি আদেশ করুন কিভাবে আমরা তা পালন করবো"।সনাতন গোস্বামী উত্তরে বলেন- "ভগবানকে প্রেম পূর্বক ভোগ নিবেদন করুন।নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোগ নিবেদন করুন এবং ভোগের মধ্যে নানাপ্রকার ব্যঞ্জন ও মিষ্টান্ন দিন"।এই কথাগুলি বলে সনাতন গোস্বামী ঐখান থেকে চলে গেলেন।

    কয়েকদিন পর সনাতন গোস্বামী এক রাতে স্বপ্নাদেশ পান।সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলছেন- "সনাতন, তুমি নারায়ণ চৌবে কে কি বিধান দিয়েছো? তুমি তাকে ঐরকম নিত্যনিয়ম পূজার নিদের্শ কেন দিলে? তুমি তো যেন সনাতন শুধু নিয়ম করে পূজার্চনা করলে হয় না।তার মধ্যে ভক্তিভাব, প্রেম না থাকলে এই পুজোর কোনো অর্থ নেই।ভিন্ন মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভক্তির রূপ থাকে ।তা তোমার নিশ্চই অজানা নয়।এখন চৌবে পত্নী কি করে তুমি কি তা জানো? আগের থেকে এখনের তফাৎ কি তা কি তুমি জানো? আগে চৌবে পত্নী আমাকে সন্তানের মতো ভালোবেসে খাওয়াতেন।বাসী কাপড়ে মা যেমন তার সন্তানকে বাল্যভোগ দেন তেমন করে আমাকে খাওয়াতেন।সকালের মধ্যে আমার ভোজন সম্পন্ন হয়ে যেত।এখন তিনি নিজেকে নিয়ম নিষ্ঠার বেড়াজালে বন্দি রেখে স্নান করে ভোগ রান্না করে।তারপর পুজো শেষ করে আমাকে ভোগ নিবেদন করে।আমারও ভোজনের দেরি হয়ে যায়"।তিনি সনাতনকে নির্দেশ দিলেন- "তুমি আবার চৌবের বাড়ি যায় আর তাদের বলো তারা যেন পুনরায় আগের মতো আমার সেবার ব্যবস্থা করে"।

    স্বপ্নাদেশের পরেরদিন সকালে সনাতন গোস্বামী পুনরায় নারায়ণ চৌবের বাড়িতে উপস্থিত হলেন এবং স্বপ্নাদেশে পাওয়া সমস্ত কথা তাদের খুলে বললেন।সময়ের পরিবর্তন হতে থাকে চৌবে পত্নী বৃদ্ধা হয়ে পড়েন।তিনি আর আগের মতন করে ভোগ নিবেদন বা ভগবানের সেবা করতে পারছিলেন না আর চাইলেও শরীর তার সাথে দিচ্ছিলো না।এমতো অবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে নারায়ণ চৌবে ও তার পত্নী সনাতন গোস্বামীকে গিয়ে বললেন- "প্রভু এবার আপনি আমার মদনমোহন কে দেখভাল করবেন।আমরা ও মদনমোহন উভয়েই এটা চাই।আপনি আমাদের ফেরাবেন না প্রভু"।

    সেইদিন থেকে এই টিলার ওপর জনশুন্য হীন জায়গায় সনাতন গোস্বামী ও মদনমোহন থাকতে লাগলো।এনাদের সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের মতো।মদনমোহন ছিলেন প্রতিমা স্বরূপ।কিন্তু দর্শন দিতেন পাঁচ বছরের শিশুর ন্যায়।এইভাবেই দিন কাটছিলো।একদিন ভিক্ষা করে আনা আটা রুটি বানিয়ে সনাতন গোস্বামী ভগবান মদনমোহনকে খাওয়াতে যাবেন ঠিক সেই সময় মদনমোহন সনাতনের হাত চেপে ধরে।ভগবান বলছেন- "প্রত্যহ তুমি আমাকে বিনা লবনে রুটি সেবা দিচ্ছ।কিছুতা পরিমান লবন তো এটাতে দিতে পারো।প্রত্যহ শুকনো রুটি আমার আর ভালো লাগে না"।সনাতন তখন বলছেন- "আমি যখন বাংলার রাজা হুসেন শাহের রাজসভায় ছিলাম, তখন আমি সেখানে তোমাকে রাজসেবায় রাখতাম।তুমি সব ছেড়ে গাছের তলায় নিয়ে এসে বসিয়েছো।আজ তুমি লবন চাইছো, কাল তুমি খির ছানা মাখন চাইবে তা আমি কথা থেকে এনে দেব? এইভাবে থাকতে পারলে তুমি এখানে থাকো নাহলে তুমি যেখানে ছিলে সেখানে চলে যাও"।

    নারায়ণ চৌবের বাড়িতে মদনমোহন ভগবান যেইভাবে সেবা পেতেন সনাতন গোস্বামীও ঠিক সেইভাবে সেবা করতেন বলে ভগবান তার কাছে এই আব্দার করেন।সব কিছু মানিয়ে নিয়ে তাঁরা দুইজন সবসময় এইস্থানে থাকেন।কিছুদিন পরে জলপথে এক ব্যবসায়ী কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন।তিনি মথুরা রয়ে দিল্লির দিকে যাচ্ছিলেন আর ঠিক সেই সময় ভয়ংকর ঝড় শুরু হয়।সেই ঝড়ের দাপটে জাহাজটি ভাসতে ভাসতে মদনমোহন টিলার সামনে এসে আটকে যায়।এতে ব্যবসায়ী খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।জাহাজে অনেক দ্রব্যাদি ছিল এবং তার সঙ্গে ছিল লবণের বস্তা।এই জঙ্গলময় জায়গায় কি করবে তা ব্যবসায়ী কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারলেন না।জাহাজের উঁচু জায়গায় উঠে তিনি চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।হটাৎ তিনি লক্ষ্য করেন টিলার ওপর থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে।তিনি এই পথ দিয়ে বহুবার বাণিজ্যে গিয়েছেন কিন্তু কোনো জনমানবের খোঁজ তিনি পাননি।তিনি ভাবতে লাগলেন টিলার চূড়ায় নিশ্চই কোনো সাধু মহাপুরুষ রয়েছেন।সেখানে গেলে ঠিক তার জাহাজ আবার জলে ফিরে যেতে পারবে।এইভাবে ধোঁয়া অনুসরণ করে তিনি এখানে আসেন।এসে সান্তনা গোস্বামীকে দেখতে পান।তিনি সব কথা এখানে খুলে বলেন।


    সনাতন গোস্বামী তাকে জিজ্ঞাসা করেন তোমার জাহাজে কি কি দ্রব্য রয়েছে?উত্তরে ব্যবসায়ী বললেন লবন আর ফল রয়েছে।সনাতন গোস্বামী মৃদু হেসে উঠলেন।তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন কিছুদিন আগে ভগবান আমার কাছে লবন চেয়েছিলো আমি দিতে পারিনি এটা ওনারই কাজ হবে।সনাতন ব্যবসায়ীকে বললেন আমি তো কিছু করতে পারবো না তবে টিলার নিচে আমার পাঁচ বছরের ছেলে রয়েছে তার নাম মদনমোহন সে কিছু করলেও করতে পারে।সে জাহাজের কিনার খেলছে তাকে গিয়ে বলো।
    নিচে গিয়ে ব্যবসায়ী দেখলেন মদনমোহন ভগবান জাহাজটি ধরে রেখেছেন।তিনি হাত জোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে জাহাজটি ছেড়ে দিতে বলেন।তখন মদনমোহন বলেন তুমি তো এই রাস্তা দিয়ে শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই তে বাণিজ্যে যাও।তুমি দেখছো আমি বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে এখানে বাস করছি এই ঝুপড়ির মধ্যে।আমি যদি তোমার জাহাজ ছারে দেই তাতে আমি কি পাবো?ব্যবসায়ী তখন বলছেন আমার জাহাজের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে ধ্বংস হয়ে গেছে।আমি আপনাকে কি দিতে পারি! তখন ভগবান বলছেন তোমার জাহাজ ছেড়ে দিলে তুমি আমার থাকার জন্য মন্দির বানিয়ে দেবে?প্রভু জাহাজে তো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমি কিভাবে তৈরী করে দেব? তুমি জাহাজের ভেতরে গিয়ে দেখো।তোমার যা কিছু ছিল সব আগের মতো অবস্থাতেই আছে।ব্যবসায়ী যখন জাহাজে গিয়ে দেখলেন লবন সব সোনাদানা মণিমুক্তায় পরিণত হয়ে গিয়েছে।ফলগুলো সব করপুরে পরিণত হয়েছে।তখন তিনি ছুতে এসে মদনমোহনের পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়েন।মদনমোহনকে সঙ্গে নিয়ে ওই ব্যবসায়ী সনাতন গোস্বামীর কাছে আসেন এবং সনাতন গোস্বামীর নির্দেশে এই মন্দির নির্মাণ হয়।এই ব্যবসায়ীর নাম রামদাস।



    এই মন্দিরটি ১৫৮০ সালে নির্মিত।জনশ্রুতি কাপুর রামদাস বণিক এই মন্দিরের স্থাপনা করেন।পরবর্তী সময়ে মোঘল শাসন আমলে ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালে এবং ঔরঙ্গজেবের রোসালল থেকে বাঁচতে মদনমোহন বিগ্রহটি রাজস্থানের করোলিতে স্থানান্তরিত করা হয়।এটি ভগবানের নির্দেশে সরানো হয়েছিল।রাজস্থানের করোলিতে এখনো একই নামে মন্দির রয়েছে।সেখানেই রয়েছে মূল বিগ্রহ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ