দেবী চিন্তাপুরনি মাতার মন্দির


 একটি মন্দিরকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে তিলে তিলে একটি সমাজ পারিপার্শ্বিকতা গড়ে ওঠে, মানুষের জীবন শৈলী, জীবন যাত্রা, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা।হিমাচলের মাটিতে একদিক থেকে বয়ে চলেছে দিয়াস অপরদিকে থেকে শতদ্রু।আর ঠিক তার কাছেই রয়েছে হিমালয়ের পর্বতরাশি।

    এই হিমালয়ের পাদদেশেই রয়েছে চিন্তাপুরনি দেবীর মন্দির।ভক্তের সবচিন্তা তিনি দূর করে দেন।তাই তিনি চিন্তাপুরনি।৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম হিমাচলপ্রদেশের উনার মাতা চিন্তপুরনি।দেবী এখানে ছিন্নমস্তা।মাতৃসত্তা আত্মবিধ্বংসীক্রোধ এবং কম লালসার দমন এই তিন আপাত বিচ্ছিন্ন ভাবধারা সুচারু ভাবে গোথিত একটি মালায়।হিন্দুধর্মের শক্তিপূজা কেন্দ্রিক শাক্ত সম্প্রদায়ের কালিকুল শাখায় দেবী ছিন্নমস্তার পূজা প্রচলিত।

    অন্যতম মহাবিদ্যা হিসেবে হিন্দুদেবমণ্ডলীতে বিশেষ স্থানের অধিকারী হলেও ছিন্নমস্তার মন্দিরের সংখ্যা খুবই কম।সর্বজনীন ভাবে তার পূজাও বিশেষ করা হয় না।সাধারণত তন্ত্রসাধকরা তাঁর পূজা করা থাকে।

    মার্কেণ্ডিয় পুরাণমতে দেবী যখন মহিষাসুর রক্তবীজ শুম্ভ ও নিশুম্ভকে হত্যা করেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন দুই যোগিনী, জয়া ও বিজয়া।পিপাসার্তু জয়া-বিজয়ার পিপাসা মেটাতে দেবী নিজের মস্তক ছিন্ন করে রক্তধারায় তাদের পিপাসা মেটান।তাই চিন্তাপুরনি মাকে ছিন্নমস্তাও বলা হয়।দেবী এখানে ছিন্নমস্তা রূপেও পূজিতা।ছিন্নমস্তের গূঢ় অর্থ দেহ থেকে মনকে আলাদা করা।চিন্তাপুরনি মন সাধনার ক্ষেত্র।মানুষের ষড়রিপু থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন করা।প্রশান্তি লাভ করা।মনের সঙ্গে শরীর যখন একাত্ম হয়ে যায় তখনই কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।সেই বন্ধন থেকে মুক্তি মানেই মনের মুক্তি।



    শুদ্ধ ও পবিত্র মনে ছিন্নমস্তার পায়ে মাথা ঠেকালে সব মানসিক চিন্তা দূর করে দেন মা চিন্তপুরনি।ভক্তের সব সমস্যা হরণ করে নেন তিনি।শাস্ত্রে দেবীর নাম ছিন্নমস্তা।ভক্তরা মায়ের নাম চিন্তাপুরনি রেখেছে কারণ মা সমস্ত চিন্তা হরণ করে।যাঁরাই মায়ের চরণে থেকে মায়ের কাছে কিছু চায় মা তার সমস্ত কামনা পূর্ণ করে।

    করোও কাছে এই মন্দির প্রচন্ড শক্তিরূপ মাতা ছিন্নমস্তা দেবীর মন্দির আবার কারও কাছে ভক্তের যাবতীয় চিন্তা পূরণ করা দেবী মাতা চিন্তাপুরনি দেবীর মন্দির।অপরদিকে থেকে পৌরাণিক মত বলে এখানেই পড়েছিল মায়ের চরণ।অর্থাৎ বিশ্বাসের প্রবাহ যাই হোক না কেন আসল কথা ভক্তের মন।ভক্তের মন শান্তি পায় এই মন্দির প্রাঙ্গনে।সেই কারণেই শুধু হিমাচল নয়।আ-সমুদ্র হিমাচলের মানুষ ছুতে আসে এই মন্দিরে আশীর্বাদের লক্ষ্যে।

    পৌরাণিক বিশ্বাস মতে এইখানের গাছের তলাতে মাতা চিন্তাপুরনি দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ মাই দাস।সেইদিন থেকেই এই বনস্পতি পবিত্র হয়ে গিয়েছে।সাধারণ মানুষ এই গাছের গুঁড়িতে শাখা-প্রশাখায় এখানেই মানত করেন।তাদের যা কিছু কামনা চিন্তাপুরনি দেবীর পাশাপাশি এই গাছের কাছে চেয়ে যান সাধারণ মানুষ।



    একদিকে মা চিন্তাপুরনি অন্যদিকে মা ছিন্নমস্তা।চিন্তাপুরনি মায়ের সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এক শারৎশত ব্রাহ্মণ পূজারী মাই দাসের নাম।ছাপরো গ্রামে থাকতেন বছর আশির প্রৌঢ়।একদিন মাইদাস পৃথিপুরে তার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন।পাহাড়ের মাথা থেকে ভেসে আসছিলো ভক্তিগীতির সুমধুর সুর।সেই সুর বড় টানছিলো মাইদাসকে।তিনি সেখানে পৌঁছে অবাক হয়ে যান।১২-১৩ বছরের এক অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী বসে আছে এক সিংহের ওপর।তাকে ঘিরে একাধিক মানুষ।ওই কিশোরীর স্তুতি করে তারা ভক্তিগীতি গাইছেন।কিশোরীর মাথার পেছন থেকে ছড়িয়ে পড়ছে অলৌকিক আলোর ছোট।ধীরে ধীরে মাইদাসের দিকে এগিয়ে আসে কিশোরী।তাকে বলে আমি এই স্থানের মা দূর্গা রূপে চিরবিরাজমান হতে চাই।আর তুমি আমৃত্যু আমার পূজা করবে।বিস্ময়হীন গূঢ় মাইদাস ওই কিশোরীর কাছে জানতে চান এই পাহাড় ও জঙ্গলের মাঝে জল ও ফুল কোথায় পাবো? দিশা দেয় ওই কিশোরী।এই পাহাড় ধরে কিছুটা হেটে গেলেই বিশাল একটি পাথরের দেখা পাওয়া যাবে।সেই পাথর সরালেই জলের সন্ধান মিলবে।সেই জলাশয়ের জল আজ পর্যন্ত কোনোদিন শুকোয়নি।সেই জলেই মা ভগবতীকে নিত্যদিন স্নান করানো হয়।কিন্তু একটি ভুল করেছিলেন মাইদাস।পরেরদিন সকালবেলা শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।মায়ের নির্দেশ অমান্য করে এই স্থান তিনি পরিত্যাগ করে পথিমধ্যেই তিনি অন্ধ হয়ে যান।পরে এক পথিক তাকে এই স্থানে ফিরিয়ে আনেন।পুজো শুরু করেন মাইদাস।ফিরে পান দৃষ্টিশক্তি।তারপর কোনোদিন সেই পুজোয় ছেদ পড়েনি।মাইদাসের মৃত্যুর পর তার ৪ ছেলে পালাক্রমে পুজো করতে থাকেন।বংশ পরম্পরায় মাইদাসের উত্তরসূরিরা মা চিন্তাপুরনির পুজো করে আসছেন।



    জলই জীবন এই সত্য আরও একবার প্রমান হয় মাইদাসের গল্প কথনের মধ্যে দিয়ে।যখন মাতা চিন্তাপুরনি দেবীর প্রথম দর্শন পান মাইদাস যখন মাতার নির্দেশে তাকে মন্দিরের পুজো শুরু করতে হয় সেই সময় প্রথম সংকট হিসেবে সামনে দাঁড়িয়েছিল জলের অভাব।

    এখানে কোথাও জল ছিল না, বিন্দুমাত্র সবুজ ছিল না।কিন্তু মাতার নির্দেশে কয়েকটি পাথর সরিয়ে এখানে প্রথম জলকুণ্ডের সন্ধান পান মাইদাস।আর তারপর থেকেই এই জল এখনো পর্যন্ত পবিত্র জল হিসেবে পরিচিত রয়েছে।এখন থেকেই প্রত্যেকদিন ২বার করে জল নিয়ে যান মন্দিরের পুরোহিতরা আর সেই জল দিয়েই স্নান করানো হয় মাতাকে এবং তার পাশাপাশি সেই জল থেকেই রান্না হয় যাবতীয় ভোগের।অর্থাৎ এই জলকে ঘিরেই এখানে যাবতীয় পবিত্রময় কাজ হয়।

    আর পাঁচ জায়গার পৌরাণিক গল্প মানে হয় ভাসানো কাহিনী নয়।মাইদাস অর্থাৎ যে শারোৎসত ব্রাহ্মণ তিনি চিন্তাপুরনি মাতার সন্ধান পেয়েছিলেন, দর্শন পেয়েছিলেন।এই জায়গা সেই মাইদাসের সমাধিক্ষেত্র।আর সেইখানেই যে মন্দিরের মতো চারটি গম্বুজ রয়েছে সেই চারটি গম্বুজ তাঁর চার সন্তানের সমাধিক্ষেত্র।

    জনশ্রুতি চিন্তাপুরনি মাতার প্রসাদ এই মন্দির থেকে বেরিয়ে মাতার জ্বালাজির কাছে নিয়ে যাওয়া যায় না।কেউ যদি অন্যথা করেন তাহলে বিপদ হতে পারে।অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে বলে লোকমুখে প্রচলিত।এটাও মনে করা হয় নবরাত্রির রাতে মাতা চিন্তাপুরনির শিখা এখানে আসে।৭টি জ্যোতি প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে।যে ভক্ত শুদ্ধ চিত্তে মায়ের সেবায় নিয়োজিত তিনিই এই জ্যোতি দর্শন পান।এই মন্দিরে এলে সেই অলৌকিক শক্তির অনুভব করা যায়।সকালে একবার মায়ের স্নান হয় দুপুরে ভোগ দেওয়া হয় মাতাকে আবার সন্ধ্যায় স্নান করানো হয়।



    চিন্তাপুরনি মন্দিরের চারপাশে শংকর মহাদেব বিরাজমান।চারিপাশ থেকে সতীকে রক্ষা করেন তিনি।আর মা রক্ষা করেন তাঁর আপামর ভক্তকুলকে।

মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সব মানসিক অশান্তি দূর হয়ে জেগে ওঠে শান্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ