শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের ব্রতকথা

     


    ব্রতের নিয়ম-
এই ব্রতে কোনো তিথি নক্ষত্রের নিষেধ নেই।যে কোনও লোক প্রদোষকালে এই ব্রত করিতে পারে।নারী-পুরুষ, কুমার-কুমারী সকলেই এই ব্রত করতে পারে।পূর্ণিমা বা সংক্রান্তি এই ব্রতের প্রসিদ্ধ দিন।উপবাসী থাকিয়া এই ব্রত করিতে হয়।

    ব্রতের উপকরণ- ঘট, আম্রপল্লব, ডাব বা কলা, গামছা, সিঁদুর, গঙ্গামাটি, ধান, পিঁড়ে বা চৌকি, পাতন বস্ত্র, তীরকাঠি, পান, কলা, সন্দেশ বা বাতাসা, পয়সা, ফুলের মালা, পতাকা, ফুলের তোড়া, ছুরি, তিল, হরীতকী,  ফুল, তুলসী, দূর্বা, বেলপাতা, ধূপ, দীপ, পূজার বস্ত্র, গামছা, আসনাঙ্গুরীয়, মধুপর্কের বাটি, দধি, মধু, গব্যঘৃত, সিন্নির সামগ্রী নানারকম ফল কুচা, নৈবেদ্য, মিষ্টান্ন, দধি, গোময়, গোরোচনা, দক্ষিণ।

    ব্রতের ফল- যে কোনও বয়সের নর-নারী এই ব্রত করিতে পারে।এই ব্রত করিলে সংসারে কোনও প্রকার দুঃখ কষ্ট থাকে না।মনের সমস্ত কামনা-বাসনা নারায়ণ পূর্ণ করেন।

    ব্রতকথা- প্রথমে বন্দি আমি দেব গজানন।সর্বসিদ্ধিদাতা আর বিঘ্ন বিনাশন।।হর-গৌরী বন্দিন বিরিঞ্চি নারায়ণ।বশিষ্ঠ বাল্মীকি আদি বন্দি মুনিগণ।।প্রণমিনু সত্যপীর নিয়ৎ হাসিল।যাহার কৃপায় হয় হয় ভুবন অখিল।।লক্ষ্মী সরস্বতী বন্দি কালী করালিনি।সত্যপীর উপাখ্যান অপূর্ব কাহিনী।।শুন শুন সর্বজন হয়ে এক চিত।যার যে পাইবে বর মনে বাঞ্ছিত।।গরিব ব্রহ্মন এক ছিল মথুরায়।ভিক্ষা করি কাটে কাল সুখ নাহি পায়।।একদিন সেই দ্বিজ ভ্রমিয়া নগর।কিছু না পাইয়া ভিক্ষা হইলো কাতর।।বৃক্ষতলে আসি বিপ্র বিষাদিত মনে।কাঁদিতে লাগিল দ্বিজ ভিক্ষার কারণে।।কাঁদিতে কাঁদিতে দ্বিজ হইলো অস্থির।দেখিয়া দয়ার্দ্র বড় হইলো সত্যপীর।।দয়াময় প্রভুদেব সত্যনারায়ণ।ফকিরের বেশে তারে দিলো দর্শন।।দ্বিজে কয় নারায়ণ, শুনো মহাশয়।কি কারণে কাঁদ তুমি বসিয়া হেথায়।।দ্বিজ বলে কি হইবে বলিলে তোমায়।ফকির বলেন দ্বিজ ক্ষতি কিবা তায়।।দ্বিজ বলে নিত্য আমি ভিক্ষা করি খাই।আজ না পাইনু ভিক্ষা দুঃখ ভাবি তাই।।ফকির কহিল, দ্বিজ যাও নিজ ঘরে।আমারে পুজোহ তবে দুঃখ যাবে দূরে।।দ্বিজ বলে, নিত্য পুজি শিলা নারায়ণ।তাহা ভিন্ন না করিবো স্লেচ্ছ আচরণ।।হাসিয়া ফকির বলে, শুনো দ্বিজবর।পুরাণ কোরানে কিছু নাই মতান্তর।।র্যাম ও রহিম যেন নাহি ভেদাভেদ।ত্রিজগতে এই দুই জানিবে অভেদ।।এতো বলি নিজমূর্তি ধরে জগন্নাথ।শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী চারি হাত।।মূর্তিহেরী দ্বিজবর পড়িল ধরণী।করিল প্রচুর স্তব গদগদ বাণী।।দেখিতে দেখিতে পুনঃ ফকির হইলো।দেখি তাহা দ্বিজবর বিস্মিত হইলো।।ব্রাহ্মণ বলেন, প্রভু পূজিবো তোমায়।পূজার পদ্ধতি কিবা বলো হে আমায়।।ফকির বলিল তবে শুনো দ্বিজবর।পূজার পদ্ধতি যথা বলি অতঃপর।।বলিতে লাগিল প্রভু ব্রাহ্মণের তরে।গম কিংবা তণ্ডুল-চূর্ণ সওয়া সেরে।।সওয়া ছড়া কলা করিবে আয়োজন।সওয়া গণ্ডা গুবাক আর পন সওয়া পান।।সওয়া সেরা চিনি কিংবা গুড় আর ক্ষীর।তাহাতে সন্তুষ্ট হই আমি সত্যপীর।।চিনি আর খির দিতে যার নাই শক্তি।দুগ্ধ আর গুড় দিয়ে করিবে ভক্তি।।বসিবে সকল ভক্ত হয়ে একমন।এক মনে ভক্তিভরে করিবে পূজন।।পূজাঅন্তে ব্রতকথা শুনিবে শ্রবনে।ভক্তিতে পূজা কর শাস্ত্রের বিধানে।।সত্যপীর বলি সবে মাথে দিবে হাত।নারায়ণ বলিয়া করিবে প্রণিপাত।।প্রসাদ লইবে সবে শাস্ত্রের বিধান।এতো বলি নারায়ণ হন অন্তর্ধান।।ভক্তিভাবে দ্বিজবর হয়ে হরষিত।কিছু ভিক্ষা করি গৃহে হন উপনীত।।ব্রাহ্মণী শুনিয়া সব হয়ে আনন্দিত।পূজা হেতু আয়োজন করে বিধিমতো।।ভক্তিভাবে পূজে দ্বিজ নারায়ণ পদ।প্রভুর কৃপায় দ্বিজ লভিল সম্পদ।।কাঠুরিয়াগণ সবে বিস্ময় মানিল।ভক্তিভরে ব্রাহ্মণেরে জিজ্ঞাসা করিল।।ব্রাহ্মণ তাদের বলে বিধান সমস্ত।কাঠুরিয়া পুজিবারে হইলো বড় ব্যস্ত।।সিন্নি যে করিল তারা বিধি সহকারে।দুঃখ দূর হইলো আনন্দ ঘরে ঘরে।।অতঃপর সদানন্দ সাধু একজন।কাঠুরের সম্পদ দেখিয়া হৃষ্টমন।।জিজ্ঞাসিয়া সবকথা জানিতে পরিল।শুনিয়া সাধুর মনে ভক্তি উপজিল।।সাধু বলে অপ্রতুল নাহি অন্যধনে।কন্যা নাই দুঃখ তাই সোডা উঠে মনে।।যদ্যপি আমার এক জনমে তনয়া।সত্যদেব পূজা করে আনন্দিত হইয়া।।এতো বলি গেলো সাধু অঙ্গীকার করি।যথাকালে জন্মে কন্যা পরমাসুন্দরী।।সত্যনারায়ণ পূজা সে সাধু ভুলিল।যথাকালে কন্যাটির বিবাহ যে দিলো।।অতঃপর সাজাইল সপ্তমধুকর।জামাতা সহিত সাধু চলিল সত্বর।।দক্ষিণ পাটনে রাজা নাম কলানিধি।সেই রাজ্যে সওদাগর মিলাইলো বিধি।।রাজা সন্তাশিয়া তাকে তরুণী চাপিয়া।প্রমাদ ঘটিল তার সিন্নি নাহি দিয়া।।রাজার ভান্ডার মাঝে ধনাদি যা ছিল।রাত্রিতে আসিয়া সাধুর তরী পূর্ণ হলো।চল পেয়ে রাজা তার টোরি লুঠ করে।শ্বশুর জামাতা লয়ে রাখে কারাগারে।।রাজাদেশে কোটাল মশানে লয়ে যায়।পাত্র অনুরোধে তারা উভে প্রাণ পায়।।কারাগারে বন্দি থাকে শ্বশুর জামাই।কি কহিব উভয়ের দুঃখের সীমা নাই।।এখানে সাধুর পত্নী আর তার সুতা।পতির বিলম্ব দেখি মহা শোকযুক্তা।।সঙ্গতি বিনষ্ট হইলো পড়িল দুঃখেতে।দাসিত্ব করিয়া খায় পরের গৃহেতে।।একদিন সাধু কন্যা বেড়াইতে গিয়া।আনন্দিত দ্বিজ-গৃহে সিন্নি দেখিয়া।।সব শুনি কন্যা সেথা মানত করিল।পিতা আর পতি-আশে কামনা করিল।।শ্বশুর জামাতা যেথা বন্দি কারাগারে।নারায়ণ স্বপ্নে কোন সেই নৃপবরে।।শুনো ওহে মহারাজ আমার বচন।কলিকালে পুঁজি আমি সত্যনারায়ণ।।সওদাগর দুইজন শ্বশুর জামাই।বিনাদোষে বন্দি আছে তোমারে জানাই।।প্রভাত হইলে তুমি দুই সওদাগরে।দশগুন ধন দিয়া তুসিবে আদরে।।এতো বলি ধরিলেন নিজের মূর্তি।স্বপ্ন দেখি চমকিয়া উঠিল নৃপতি।।মুক্ত করি সওদাগরে বহুধন দিলো।তরী পূর্ণ করি রাজা বিদায় করিল।।বুঝিতে সাধুর মন সত্যনারায়ণ।ফকিরের বেশে পথে দিলো দর্শন।।ফকির বলেন, শুনো ওহে সওদাগর।ফকিরের কিছু ভিক্ষা দিয়া যাও ঘর।।শুনি সওদাগর তাকে অবজ্ঞা করিল।তরীর সামগ্রী সব তুষাঙ্গর হইলো।।দেখি তাহা সওদাগর করে হায় হায়।ধরণী লুটায়ে ধরে ফকিরের পায়।।অবশেষে ফকির তাহারে কৃপা করিল।ধনৈশ্চর্য্যে তরী পুনঃ পরিপূর্ণ হইলো।।উতরিলো ঘটে সাধু হইলো কোলাহল।সাধুর রমণী কন্যা শুনি কৌতূহল।।তরীর সামগ্রী যত ভাণ্ডারেতে লইয়া।সিন্নি করিল সাধু আনন্দিত হইয়া।।সকলে প্রসাদ নিলো জোড় করে পাণি।প্রসাদ ভূমিতে ফেলে সাধুর নন্দনী।।তাহা দেখি সত্যদেব কূপিত হইলো।জামাতা সহিত তরী জলেতে ডুবাল।।হাহাকার করে সবে পড়িয়া ভূমিতে।শুনি সাধু কন্যা যায় ডুবিয়া মরিতে।।হেনকালে দৈববাণী হইলো আচম্বিত।সিন্নি ফেলিয়া কন্যা করিল বিপরীত।।শুনি কন্যা সেই সিন্নি চাটিয়া খাইলো।জামাতা সহিত তরী ভাসিয়া উঠিল।।তরীর সকল দ্রব্য ভাণ্ডারেতে আনি।করিলেক সওয়া সের  সোনার সিন্নি।।স্বপ্নে কহিলেন দেব, শুনো সাধু তুমি।সোনা হতে আটায় সন্তোষ হয় আমি।।স্বপ্নে দেখি সওদাগর পরম হরিষে।এটার সিন্নি করি পূজা সবিশেষে।।ক্রমেতে প্রচার হলো সবার আলয়।ভক্তিভরে পুজিলেই আশাপূর্ণ হয়।। একমনে শুনে কিংবা পূজে নারায়ণ।সর্বদুঃখ দূরে যায় শাস্ত্রের বচন।।সিন্নি মেনে যেই জন হয় দুই মনা।কদ্যপি না হয় সিদ্ধ তাহার কামনা।।

                ----অথ সত্যনারায়ণের ব্রতকথা সমাপ্ত----

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ