শ্রীকৃষ্ণের মাথার ময়ূর পালকের রহস্য

 


জগৎ সংসারের প্রতিপালক শ্রীবিষ্ণুর অবতার মনমোহন শ্রীকৃষ্ণ।তার মোহনীয় রূপে বিমুগ্ধ হতো সমগ্র ব্রজবাসী।ঘন কৃষ্ণবর্ণ মেঘের মতো তার চেহারা, লালচে ঠোঁটে সবসময় যেন একটা হাঁসি লেগে আছে।উজ্জ্বল দীপ্তিতে উদ্ভাসিত তার নয়ন।মুখমন্ডলের চারপাশে বিন্যস্ত গভীর কালো কোঁকড়ানো কেশের বাহার।তার শরীরে ভূষিত পীত বর্ণের বসন এবং বক্ষ মাঝে শোভা পায় শক্তিশালী কৌস্তভ রত্ন।শ্রীকৃষ্ণের এই রূপ বর্ণনার চুম্বক অংশ হলো তার মাথায় শোভা পাওয়া ময়ূরের পালকটি।এর কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় ময়ূরমূর্তধারী।বেশিরভাগ ভক্তের কাছে ময়ূরের এই পালক প্রায় ততটাই প্রতীকী বা দর্শনীয় যতটা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।শ্রদ্ধার সাথে ভক্তরা তাই শ্রীকৃষ্ণকে মর্ম মুকুটধারীও বলে থাকেন।

    তখন বালক গোপাল বৃন্দাবনের রাখাল রাজা।একদিন বিকেলে তিনি গোবর্ধন পর্বতের পাদদেশে সঙ্গীদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন গো-চারণে।কিছুক্ষনের মধ্যে তার সঙ্গীরা তথা বলরাম,সুবল, সুধাম, প্রভৃতির বৃক্ষের কোমল ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।দুস্টু গোপাল পরিকল্পনা করলেন তাদের নিদ্রা ভঙ্গ করার।সেই সাথে ঘুমন্ত গাভীদেরও।এবার কৃষ্ণ তার ঠোঁটের অমৃত বাঁশিতে প্রদান করলেন।গম্ভীর অথচ ধীর ছন্দযুক্ত এক সুমধুর রাগ বাসি থেকে নির্গত হতে লাগলো।এই বিস্ময়কর তরঙ্গ গোবর্ধন পর্বতের আসে পাশের সমস্ত ময়ুরকে মোহিত করে তুলেছিল।তাদের হৃদয় খুশিতে গাইতে শুরু করলো এবং তাদের নিজস্ব সংগীতে আকাশ, বাতাস পরিপূর্ণ করে তুললো।মোহনবাঁশি হতে নির্গত এই আননাদিত শব্দ তরঙ্গ ময়ূরদের নৃত্য করতে উৎসাহিত করলো।কৃষ্ণ যিনি সমস্ত শিল্প কলার উৎস তাদের নৃত্যে খুশি হলেন এবং তাদের দিকে মৃদু হেঁসে উৎসাহিত করলেন।তারাও আনন্দে চিৎকার করে উঠলো এবং তা সমস্ত পর্বতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।একসময় তাদের ধ্বনি প্রতিধ্বনি প্রভেদ শূন্য হয়ে গেলো এবং তারা উত্তেজনায় তাদের পেখম ঝাপটিয়ে লাফাতে লাগলো।যখন ময়ূরেরা নৃত্য করছিলো তখন ময়ূরের রাজা শ্রীকৃষ্ণের চরণ কমলের দিকে এগিয়ে গেল এবং তার পবিত্র চরণ স্পর্শ করে একটা শব্দ করলো।কৃষ্ণ বুঝলেন ইটা ময়ূরের রাজার ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং অনুরোধ যাতে তিনিও তাদের সাথে নৃত্যগীতে রত হন।শ্রীকৃষ্ণ তাদের এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং তাদের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন।ময়ূরদের মতো তিনিও নৃত্য শুরু করলেন।ধীরে ধীরে লয় বাড়ালেন এবং ময়ূরেরাও তাদের পদসঞ্চালনার সাথে তালে তাল মেলাতে লাগলো।শ্ৰীকৃষ্ণ তাদের সাথে নৃত্য করায় তাদের পরম সুখ দ্বিগুন বেড়ে গেলো।এতো অভিভূতকারী ছিল এই অনুভূতি যে কয়েকতা ময়ূর মূর্ছিত হয়ে পড়লো।গোবর্ধন পর্বতের সমস্ত পশু এবং রাখালগন জাদুমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।তারা যেন শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যের দৃশ্য দেখে চোখ সরাতে অসমর্থ হয়ে পড়লেন।শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিও তার প্রভুর ব্যতিক্রমী ক্রিয়াকান্ড দেখে নিজেই গাইতে শুরু করলো।গোবর্ধন পর্বতের চূড়া, স্বর্গ এবং পাতাললোক থেকেও দৃশ্যমান ছিল এই চমৎকার দৃশ্য।অনেক্ষন ধরে নৃত্য করে ক্লান্ত ময়ূরদল নৃত্য থামায়।এরপর শ্রীকৃষ্ণ নিজে লয় ও ছন্দে নৃত্য শুরু করে।কয়েকদিন পর তিনি যখন থামলেন চারিদিকে এক মনোরম নিস্তব্ধতা বিরাজমান হলো।ময়ূরের রাজা খুব বিনয়ের সাথে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে বললো আপনি আমাদের এক আনন্দ পূর্ণ উৎসব উপহার দিয়েছেন।যেজন্য আমরা উপনার নিকট চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো।আমাদের কর্তব্য আমরা আপনাকে গুরুদক্ষিণা দেই।তাই আমি অনুরোধ করছি আপনি আমাদের একমাত্র সম্পদ আমাদের পালক গ্রহণ করুন এবং এটাকে আপনার মুকুটের সজ্জ্যা হিসেবে পরিধান করুন।

    এরপর পরমানন্দের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে রাজা অনেকগুলো স্বর্গীয় পালক ত্যাগ করলেন।প্রার্থনা করলেন তিনি যেন এই পালক শিরোভূষণ করেন।শিরোধার্য হলো প্রার্থনা।শ্রীকৃষ্ণ মুকুটে স্থান দিলেন ময়ূর পুচ্ছ বা শিখীপাখাকে।তিনি হলেন শিখিধারী শ্রীকৃষ্ণ।সেই থেকেই তার মস্তকে শোভা পে ময়ূর পালক।বলা হয়, প্রাথমিক সাতটি রঙের সবকটি উপস্থিত থাকে ময়ূরের পেখমে।তাই মানা হয় শ্রীকৃষ্ণ এটি পরিধান করে জীবনের সব রং ধারণ করার প্রতীক হয়।অন্যভাবে বলা হয়, এই সাতটি রং শ্রীজনের প্রতীক।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সারাবিশ্বকে ধারণ করে আছেন।তার সেই অপার লীলা ও মহিমায় আমরাও আচ্ছন্ন।তার নানান রুপ নানান দর্শন ও ব্যক্তিত্ব আমাদেরকে মোহিত করে রাখে।শ্যামের মুকুটে সেই সাতরঙা ময়ূর পুচ্ছে লেখা থাকে শ্রীরাধিকার নাম।

    দ্বিতীয় মতবাদটি শ্রীরামকে ঘিরে।ক্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরাম এই পৃথিবীতে পদার্পন করেন।প্রচলিত আছে যে একবার শ্রীরাম ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।এইসময় একদল ময়ূর পেখম দিয়ে তার চলার পথটি পরিষ্কার করে দেয়।ভগবান শ্রীরাম তাদের এই নিঃস্বার্থতা ও নিষ্ঠা দেখে খুবই প্রসন্ন হন।তখন তিনি কথা দিয়ে যান যে দ্বাপর যুগে তিনি আবার আবির্ভুত হবেন এবং তখন ময়ূরদের প্রতি সম্মান জানাতে তিনি এই পালক নিজের মাথায় ধারণ করবেন।তাই যখন তিনি শ্রী কৃষ্ণ রূপে ধরে আবির্ভুত হন তখন নিজের দেয়া পূর্বযুগের কথার সম্মান রাখতে তিনি নিজের মাথায় ময়ূরের পালক ধারণ করেন।

    তৃতীয় মতবাদ অনুসারে, ভগবান বিষ্ণুকে দেবী পার্বতীর ভাই হিসেবে মানা হয়।লোককথা অনুযায়ী বিষ্ণু বিয়ের সম্পর্কে দেবী পার্বতীকে দেন করেন মহাদেবকে।তাই এদিক থেকে দেখতে গেলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কার্তিকের মামা হন।শ্রীমান কার্তিকের বাহন হলো ময়ূর।তাই মানা হয় যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ময়ূরের পেখম নিজের মাথায় সাজান যাতে কার্তিক যিনি আবার দেব সেনাপতি তার সমস্ত প্রয়াস যেন সার্থক হয়।

    এছাড়াও আরও একটি মতবাদ প্রচলিত শ্রীকৃষ্ণের ময়ূর পেখম পরিধান নিয়ে।আর সেটি ঘটেছিলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনলীলা সমাপ্ত করে মথুরায় প্রত্যাবর্তন করার সময়।এই সময় শ্রীরাধিকা সহ বৃন্দাবনের সবাই শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবন ত্যাগ করতে বাধা দেন তাই শ্রীকৃষ্ণ লীলার ছলে সাপের রূপ ধরে যমুনা পার করেছিলেন।তখনই রাধারানী কৃষ্ণের ছল বুজতে পারেন তাই তিনিও ময়ূর সেজে কৃষ্ণের মাথায় কামড়ে ধরেন।তখন কৃষ্ণ বলেন "ও রাধে আমি তোমার ভক্তি ও প্রেমের কাছে হেরে গিয়েছি।কিন্তু আমায় মথুরায় প্রত্যাবর্তন অবসম্ভাবী।তাই আমি তোমাকে একটি বর দিতে চাই।আর তা হলো তুমি আমার মাথায় এই ময়ূরের পেখম হয়েই থেকে যাবে এবং তুমি যেহেতু আমার রাগিনী শক্তি সেহেতু আমি এখন থেকে চিরকাল আমার বামপাশে ময়ূরের পেখম ধারণ করবো"।সেইথেকেই ময়ূর রুপী রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের মাথার বামপাশে স্থান পান।

    তবে প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি, ধেনু, ত্রিভঙ্গ শরীর ও সুদর্শনচক্রের মতো তার মাথার ময়ূর পেখমটাও আমাদের কাছে এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুষঙ্গ।যাকে ছাড়া আমরা জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কল্পনাও করতে পড়ি না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ