বিরাটনগর অম্বিকাদেবীর মন্দির ৫১ সতীপীঠের অন্যতম


 রাজস্থানের আলবার্ট জেলায় সেরিস্কা টাইগার রিসার্ভড ফরেস্ট।কাঁটাভরা শুকনো ঝোপঝাড় ও পাথুরে ভূমিরূপ এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট।রাজপুতানার এই শুকনো এলাকাতে বাড়ে মিঞার বাস।এই ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রের একদম সীমানা লাগোয়া জায়াগায় সতীপীঠ অম্বিকামাতার মন্দির।রাস্তার দুইধারে শুধুই শুকনো ঝোপঝাড়।রাজস্থান মানেই রাজপুতদের বীরগাঁথা।রাজস্থানের বিরাটনগর।এখান থেকেই শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল।এখানেই হাজার হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুপ্রাচীন সতীপীঠ যা দীর্ঘদিন ধরে ছিল মানুষের চোখের অলক্ষ্যে।

    অজানা,অচেনা, অনামী এক মন্দির।পীঠনির্ণয় তন্ত্রমত অনুযায়ী এই বিরাটপ্রদেশে সতীর বাম পায়ের চারটি আঙ্গুল পড়েছিল।দেবীর নাম অম্বিকা।স্থানীয়রা বলেন অম্বিকা মনসা মাতা।রাজস্থানের অলওয়ার, জয়পুর ও ভরতপুর নিয়ে প্রাচীন বিরাটনগর।মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী এই বিরাট নগরেই এক বছরের অজ্ঞাতবাস কাটিয়েছিলেন পাণ্ডবরা।সোমি গাছে অস্ত্র বেঁধে রেখে বিরাটরাজ্যে প্রবেশ করেন তারা।এলাকার জনশ্রুতি, অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় দ্রৌপদী আসেন এই অম্বিকামাতার মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য।


    কমপক্ষে ৫০০০ বছরের পুরোনো এই মন্দির।রাজা বিরাটের কাছে অজ্ঞাত বাস করেন পাণ্ডবেরা।তখন দ্রৌপদী আসতেন এই মন্দিরে।স্থানীয়দের মতে মহাভারতের পূর্বে এই মন্দিরের স্থাপনা হয়েছিল।কে কবে কিভাবে এই মন্দিরের স্থাপনা করেছিলেন তার কোনো তথ্য নেই।প্রথমে এই মন্দিরের কথা কেউ জানতো না।বর্তমানে সরকার কর্তৃপক্ষ মন্দির সংস্করণের কাজ করছেন।

    পুরাণের প্রমান যাই হোক না কেন সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় এই মন্দিরের স্থান অনেক ওপরে।মরুরাজ্যের সতীপীঠে মহাভারত এভাবে মিশে যাবে এমন কল্পনাও ছিল না।তাই দুচোখ মাইল যতদূর দৃষ্টি গেলো সেই দৃশ্যমানতার দিগন্ত জুড়ে রইলো ওপর বিস্ময়।

    পাহাড় ঘেরা এই বিস্তৃত এলাকাই মহাভারতের মৎসদেশের রাজধানী বিরাট নগর হিসেবে পরিচিত।মহাভারতে কথিত রয়েছে পান্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে এই বিরাট নগরের রাজাই তিনি মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন।সেই প্রাচীনকাল থেকেই একাধিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চোখে এই বিরাট নগর।

    রাজপুতানার শক্তিপীঠে একটি পরিবারই বংশ পরম্পরায় মায়ের সেবা করে চলেছে।যেখানেই সতী সেখানেই শিব।বিরাট নগরের অম্বিকামাতার ভৈরব অমৃতাখ্য।আলবাড়ীর পাপড়িগ্রামে শিব ও সতী দর্শন ভালো হয়।

    মন্দির থেকে দূরের দিকে তাকালে দেখা যায় ভীম পাহাড়।আর ঠিক তার নিচেই রয়েছে ভীমের গুহা।নিজেদেরকে সবার অলক্ষ্যে রাখার জন্য মনসা মাতার মন্দিরে তপস্যা করেছিলেন পাণ্ডবরা।আর সেই সময় ভীম আশ্রয় নিয়েছিলেন এই পাহাড়ের গুহাতে।ভীমের তৈরী এই গুহাই হয়েছিল তখন পাণ্ডবদের আশ্রয়স্থল।

    কৌরবদের শর্ত ছিল অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন কেউ যদি পাণ্ডবদের চিনে ফেলে তাহলে আবার ১২ বছরের বনবাস।স্থানীয়দের ভাষায় অম্বিকামাতা পাণ্ডবদের সফল অজ্ঞাতবাসের আশীর্বাদ দিয়েছিলেন।দেবীর অভয় নিয়ে ছদ্মবেশে বিরাটরাজের সভায় কাজে নিযুক্ত হন।যুধিষ্ঠির 'কঙ্ক' নামে সভাসদ হন।ভীম 'বল্লভ' নামে পাচকের কাজ নেন।অর্জুন 'বৃহন্নলা' নাম নিয়ে নৃত্যশিক্ষা দিতে শুরু করেন।নকুল 'গ্রন্থিক' নাম নিয়ে অশ্বশালার প্রধান নিযুক্ত হন।সহদেব 'তন্ত্রিশাল' নামে গো-শালার দায়িত্ব পান।আর দ্রৌপদী 'সৌরেন্দ্রী' নাম নিয়ে রানী সুদেষ্ণার সহচরী নিযুক্ত হন।

    ধর্ম-পুরাণ-মহাকাব্য মরুরাজ্যের বিরাটনগর যেন বৈচিত্রের ত্রিবেণী সম।সেলুকাশ কি এমনি বলেছিলেন, "কী বিচিত্র এই দেশ"।

    পুরাণ ছেড়ে ইতিহাসের পটভূমিতে এলে দেখা যায় এখনো ঝলমল করছে মৎস্যদেশের বিরাটনগর।গুপ্তসতীপীঠে এসেছিলেন সম্রাট অশোক।এই স্থান মাহাত্বের টানে সেই সময় ছুটে এসেছিলেন তিনি।শক্তিপীঠ পাহাড়ের পাদদেশ অভিভূত করেছিল তাকে।এই স্থানের পাথরে লিখে গিয়েছিলেন তার বাণী।ভীম পাহাড়ের নিচে অশোক শিলালিপি এখনো দেখা যায়।

    মৌর্য যুগে অশোক এবং মোঘল আমলে আকবর।দিল্লী থেকে রাজপুতানা যাওয়ার পথেই পরে বিরাটনগর।রাজপুতদের বাগে আন্তে বেশ কয়েকবার এখানে আস্তে হয়েছে আকবরকে।মরু রাজ্যের পাহাড় ঘেরা এই জায়গা তামাম হিন্দুস্থানের বাদশার এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে থাকার জন্য তিনি একটি মহলও বানিয়েছিলেন।

    জঙ্গল থেকে জনপথ সভ্যতার এটাই নিয়ম।কিন্তু এখানে যেন উলট-পুরাণ।যে জায়গায় একসময় সম্রাট অশোকের শিলালিপি তৈরী হয়েছিল, যে জায়গা একসময় ইতিহাসের সাক্ষী রয়েছিল সেই জায়গা আজকে ইতিহাসের এতো পাতা ওল্টানোর পরেও এখনো তার ভয়াল ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে বেরোতে পারেনি।

    সন্ধ্যা আরতির ঘন্টার ধ্বনিতে ধ্বনিত হয় সতীপীঠের প্রাঙ্গন।আর বিরাটনগরের চরাচর ঢেকে যায় ভয়াল ভয়ঙ্কর আদি অন্ধকারে।স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস যখন তারা ঘুমিয়ে পড়েন তখন এই বিরাট নগরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেবতারা জাগ্রত থাকেন।এই দেবতারাই ভয়াল ভয়ঙ্কর হিংস্রতার হাত থেকে প্রতিদিন বাঁচিয়ে রেখেছে এখানকার মানুষকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ