মানবরূপী ভগবান বিষ্ণুর সর্বোত্তম লীলা ছিল রাসলীলা।কার্তিক মাসের পূর্ণিমার রূপবতী সেই রাতে অজস্র গোপী ও শ্রী রাধা সহকারে অপ্রাকৃত এক নৃত্যে রত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
সকল বিশ্বজিবির অন্তরে যিনি অধ্যক্ষ বা বুদ্ধিপ্রভৃতির সাক্ষী তিনি পরমাত্মা আজকে ক্রিয়া তরে লীলাবিগ্রহধারী।সকলের অন্তরের অন্তরতম রূপে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান।তার কেউ পর নেই।কি পুরুষ, কি নারী সকলেরই হৃদয় বিহারী তিনি।তার এই লীলা আত্মার সঙ্গে আত্মার বিহার।নিজের সঙ্গে নিজেরই খেলা।এই খেলা বিশ্ব জুড়ে চলছে প্রতিনিয়ত।তার এই বৈচিত্রময় প্রকাশ রাসলীলা।গোপীদের ব্রতসাধন দীর্ঘদিনের তপস্যা এবং হৃদয়ে পুঞ্জীভূত অনুরাগের ফলে তাদেরকে অনুগ্রহ করবার জন্যই শ্রীকৃষ্ণ এই রাসলীলা করেন।
বর্তমানে আমরা একবিংশ শতকের সভ্য মানুষ।আত্মসুখের আয়োজনে আমরা সদা তৎপর এবং উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মানুষ।সবকিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়।আমরা ছুটে চলেছি বিশ্ব বিজয়ে।চলছে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা।চাহিদা বেড়েছে ভোগ্য বস্তুর।আমরা ভুলে গেছি আত্ম অনুসন্ধানের যথার্থতা।
অনুসন্ধিতছু মন নিয়ে জানতে চাই শ্রী ভগবানের রাসলীলার রহস্য।অথচ মন ছুটে চলে জড়জাগতিক বিকৃত কদর্য রসের দিকে কিন্তু এর বাইরেও যে জগৎ আছে তা কি আমরা জানি।জগতের কেউ সুখী নয়।সুশোভিত চির বিকাশমান পুষ্পেরমতো জীবনের আরেকরূপ যথার্থ বাস্তব জীবন।যা শাশ্বত জরা-ব্যাধি ও মৃত্যুহীন।এই যোবনেই তা লাভ করা সম্ভব।
জ্যোতির বিজ্ঞানের বিশেষ সংখ্যাতত্ত্বের গণনা অনুসারে আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে শ্রীধাম বৃন্দাবনের ধেরসমীরে যমুনা তীরে বংশীবট বলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজাঙ্গনাদের সাথে অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেছিলেন।এই রাসনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল কার্তিক মাসের পূর্ণিমার মোহিনী রাতে।সেই রাতে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি সুসজ্জিত হয়েছিল অপরূপ সাজে।পূর্ণ চন্দ্রের স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে গগনমণ্ডল ছিল উদ্ভাসিত।বৃক্ষলতা, গুল্মাদি, পশুপক্ষী উন্মুক্ত হয়েছিল ভগবানের রাসলীলা দেখার জন্য।শ্রীকৃষ্ণের নরলীলা সমূহের সর্বোত্তম হলো রাসলীলা।এই রাসলীলা ছিল সম্পূর্ণ চিন্ময় এবং বেশ কিছু মতবাদ অনুসারে সেই সময় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ছিলেন কিশোর।
শ্রীকৃষ্ণ কেবলই আনন্দময়।বৃন্দাবনের সকলেই আনন্দময়।পশুপক্ষী, বৃক্ষলতা, জলস্থল, গাভী-গোবৎস, গোপবালক-গোপিবালিকারা সবাই কৃষ্ণপ্রেমে আনন্দময়।শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবেসে তারা পরম আনন্দে মগ্ন।ভগবানের ভগবত্যার নির্যাস হলো মাধুর্যরস।যা পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়েছে দ্বাপর যুগের শেষে কৃষ্ণলীলায়।
শরতের শেষে বিশ্বপ্রকৃতি যেন আনন্দমগ্না যমুনাপুলিন শরৎজ্যোসনা দ্বারা বিধৌত।এ যেন আধ্যাতিকতার আড়ালে এক অসামান্য প্রেম কাহিনী।প্রেমের সর্বোচ্চ উচ্চতায় মনের বন্ধনহীন ডোরি যেন উপজীব্য।ভালোবাসা এখানে শারীরিক কোনো চাহিদা নয়।এক মিলনের ইতিখ্যা মাত্র।আর এই মিলন পুরোটাই আধ্যাত্মিক।এই কারণে আজও কার্তিক পূর্ণিমায় বার বার ফিরে আসে রাসলীলায় অসামান্য প্রেমকাহিনী।
দুর্গাপুজোর মতো এতো জাঁকজমক না থাকলেও হিন্দুদের অন্যতম বড় উৎসব রাস।তবে অঞ্চল বিশেষ রাসের প্রভাব এবং জমক বিশাল রকমের।রাষ্ শব্দের উৎপত্তি রস থেকে।মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাসের ক্ষণ।রাস মানে আনন্দ দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম।হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী রাসপূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনধামে রাসলীলা বিলাস করেন।তাই রাসপূর্ণিমাতেই পালিত হয় রাসলীলা।দিনটিতে বৃন্দাবনের গোপীদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন।এই লীলা মানে নৃত্য।বৃন্দাবনের গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের এই লীলা।কথিত আছে গোপীরা নাকি এই দিনটিতে অপেক্ষা করেন কৃষ্ণের ডাকের জন্য।কতক্ষনে তাদের প্রানপ্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণ লীলার জন্য ডাক দেবে তা শোনার জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকেন গোপীরা।
রাসলীলায় যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তার নাম রাসনৃত্য।মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস,দিব্যরাস ও নিত্যরাস এই পাঁচভাগে বিভক্ত রাসলীলা।প্রেম রসের এই পঞ্চলীলায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মহারাসে।এই পর্যায়ে রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার অভিসার, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রাস আলাপ, কৃষ্ণ নর্তন, রাধা নর্তন, গোপীদের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান-প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি ও গৃহগমন।
বাংলাদেশী মনিপুরী আদিবাসীদের সৰ্বকৃষ্ট উৎসব রাসনৃত্যন।এটি মনিপুরী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মূর্ছনা যাকে বলে এক শৈল্পিক সৃষ্টি।এদের রাসনৃত্যে কৃষ্ণ ও রাধার ভূমিকা দেওয়া হয় পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের, আর গোপীদের ভূমিকায় তরুণীরাই নৃত্য পরিবেশন করে।বাংলাদেশী মনিপুরী আদিবাসীদের বিশ্বাস শিশুদের মধ্যেই থাকে দৈব কান্তি।কিন্তু পাঁচ বছর অতিক্রম করলেই সেই দৈবকান্তি রূপ হারিয়ে যায়।রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পরিচিতি পায় বাংলাদেশী মণিপুরীদের এই উৎসব।বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি ও মৈথৈ কবিদের পদাবলী থেকে রাস উৎসবের গীত গাওয়া হয়।১৯২৬ সালের সিলেটে বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশী মনিপুরী আদিবাসীদের রাস নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন।এই নাচের কোমল আঙ্গিক এর কবিমনকে আলোড়িত করেছিল ভীষণভাবে।পরবর্তীকালে এই মনিপুরীদের এই রাস নৃত্যকে নিজের সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনায় ঠাঁই দেন রবীন্দ্রনাথ।আর এইভাবেই আরো বিশাল জনসমষ্টির কাছে পাছায় বাংলাদেশী মণিপুরিদের আদিবাসী রাসনৃত্যের মাহাত্ম্য।
নবদ্বীপ ও কোচবিহারের রাসমেলা রাজ্যের সবচেয়ে বড় দুটি রাসমেলা।কোচবিহারের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ৩০০ বছর আগে নবদ্বীপে রাস উৎসবের শুরু।অন্যদিকে কোচবিহারের রাজ্ পরিবারের পৃষ্টপোষকতায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে রাশ উৎসব পালন শুরু হয়।আজও এই দুই স্থানে রাষ্ প্রত্যক্ষ করতে দেশ বিদেশ থেকে বহু মানুষ সমবেত হন।
বিশ্ব প্রকৃতির মনোমুগদ্ধকর পরিবেশে পুর্ণিমার রাতে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বংশীবাদন শুরু করলেন।মনপ্রাণ হরণকারী বংশীধ্বনি শুনে ব্রজগোপিকারা তাদের পতিপুত্র,গৃহকর্ম, জাতি, কূলমান সব পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মহামিলনের জন্য রাসস্থলীতে ছুটে এসেছিলো।ভগবানের সঙ্গে মিলনের জন্য এইরূপ ব্যাকুলতাই মানুষকে চরম সার্থকতা এনে দেয়।কৃষ্ণঅনুরাগে রঞ্জিত হয়ে ওঠাই ছিল ব্রজবালাদের একমাত্র সাধনা।শ্রীকৃষ্ণ নৃত্যানুষ্ঠানের উপযুক্ত স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করে মল্লিকা, জুঁই ও অন্যান্য অতন্ত্য সুগন্ধিযুক্ত পুস্প দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করেছিলেন।অপ্রাকৃত রাসনৃত্য শুরু হলো।রাস মণ্ডলীতে দুই গোপী তার মধ্যে কৃষ্ণ।যতগোপী তত কৃষ্ণ।রাসরসের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।এই চির আনন্দ খেলার বিরাম নেই।চলছে নিরন্তর নিরবিচ্ছিন্ন।
শ্রীধাম বৃন্দাবনে চার শ্রেণীর ব্রজলাল নাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ রাস নৃত্য করেছিলেন।তাদের মধ্যে ছিলেন নিত্যসিদ্ধ গোপকন্যারা।যারা ছিলেন শ্রীমতি রাধারাণীর কায়ব্যূহ।অন্য শ্রেণী ছিল দেবকন্যারা।যারা নৃত্যসিদ্ধদের সঙ্গের ফলে নৃত্যসিদ্ধ স্তর লাভ করেছিলেন।আরেকশ্রেণী ছিল মূর্তিমান শ্রুতিরা।যারা তপস্যা করে গোকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তারাও ছিলেন সাধনা সিদ্ধ।আর ছিলেন ঋষিরা যারা দণ্ডকারণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে দেখে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন।ব্রজবালারাও যমুনার তীরে একমাস ব্যাপী কাত্যায়নীর ব্রত করেছিলেন।তারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করতে চেয়েছিলেন।ব্রজবালাদের এই মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যই এই রাসনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল।রাসনৃত্যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অসংখ রূপে বিস্তার করে প্রত্যেক গোপীদের সঙ্গে যুগপদ ভাবে নৃত্য করেছিলেন।রাসপূর্ণিমার রাতটি ছিল ব্রহ্মরাত।মানুষের কাছে যা চারশত বত্রিশ কোটি বছর।রাস পূর্ণিমার চাঁদ যেন বিরহ কাতর সখার প্রতিরূপ।দীর্ঘ অসনদর্শনে সখার মন আজ বিরহ কাতর।প্রাণ প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খায় তার মন ক্ষত বিক্ষত।
0 মন্তব্যসমূহ