দেবী ফুল্লরার অজানা কাহিনী

 


পৃথিবীর কোনো পথে নরম ধানের গন্ধ।কলমীর ঘ্রান, হাঁসের পালক, স্বর পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রান আর এইসবের মাঝে বাংলার প্রাণ।এই বাংলার বীরভূমের লাভপুরে রয়েছে অন্যতম সতীপীঠ দেবী ফুল্লরার মন্দির।চারিদিক গাছপালায় ঘেরা, বেশ একটা শান্ত ছায়াময় পরিবেশ।লোকালয় থেকে একটু দূরে।ঢুকতেই প্রথমে পড়বে পাকা সিঁড়ি বাঁধানো সরোবর।তার পাস্ দিয়ে একটু এগোলেই দেবী ফুল্লরার মন্দির।তন্ত্রচূড়ামনিতে ৫১ সতীপীঠের ৪৯তম পীঠ লাভপুরের ফুল্লরা।দেবীপুরাণ মতে সতীর অধওষ্ঠ পড়েছিল এখানে।

    পুরাকালে কাশী-বেনারসে মণিকর্ণিকায় যে শ্মশান আছে ওখানে গিরি সম্প্রদায়ের এক সাধক ওখানে তপস্যা করেছিলেন।ওনার নাম ছিল কৃষ্ণানন্দ/কৃষ্ণ দয়ালগিরি।মা অনেকেই প্রথম স্বপ্নাদেশ দেন।মা স্বপ্নাদেশে জানান-''তুই এখানে আয়, এসে আমাকে আবিষ্কার কর, দর্শন কর টের মোক্ষলাভ সম্পূর্ণ হবে''।মায়ের সেই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর তিনি এখানে আসেন তখন এই জায়গা ছিল জলাধার বেষ্টিত দ্বীপের ন্যায়।চারিদিক ঘিরে ছিল জল আর জঙ্গল।বহু কষ্টে তিনি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং কোনো এক পূর্ণিমা  তিথিতে মায়ের যে সাক্ষাৎ জয়দুর্গা রূপ সেই রূপে ওনাকে দর্শন দেন।এখানে যে ওষ্ঠ পড়েছিল সেই ওষ্ঠ শিলায় পরিণত হয়।

    মন্দির চত্বরে পঞ্চমুন্ডীর আসন এখনো বিদ্যমান।এখন তাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।৬৬বিঘা জমি নিয়ে ফুল্লরা মহাপীঠ।মাতৃমন্দিরে প্রাচীনত্বের কোনো ছাপ নেই।সব সংস্কার হয়েছে।১৩০২ বঙ্গাব্দে স্থানীয় জমিদার যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দির নির্মাণ করেন।মূল মন্দিরের সামনে রয়েছে সুবিশাল নাট মন্দির।হোম-যজ্ঞ থেকে শুরু করে মাতৃ আরাধনার নানা পদ্ম এখানে অনুষ্ঠিত হয়।


    নাট মন্দিরের অদূরের রয়েছে জলাশয়।নাম দেবীদহ।দেবীদহকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে যে লোকশ্রুতি রয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে রামায়ণের কাহিনী।পবনপুত্র হনূমান রামচন্দ্রের দেবী দুর্গার অকালবোধন জন্য এই জলাশয় থেকেই ১০৮টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন।

    অধ্যাত্মভূমি ভারতে ধরে আর সংস্কৃতির সংমিশ্রনে গড়ে উঠেছে বহু মন্দির।এমন দেবালয় দর্শনের একটা আলাদা অনুভূতি থাকে।

    বীরভূমের মানুষের বড়োই আদরের এই মা ফুল্লরা।সিঁদুর মাখানো শিলাখন্ডই সতীর অধওষ্ঠ বা নিচের ঠোঁটের প্রতিরূপ।


    শান্তিনিকেতন থেকে ৩০কিমি দূরে অবস্থিত এই জায়গায় মূলত মন্দির কেন্দ্রিক জনপদ।শক্তিপীঠ ফুল্লরা অট্টহাস নামেও পরিচিত।কুব্জিকা তন্ত্র, পীঠনিরুপরম, শিবচরিত প্রভৃতি জায়গাতে অট্টহাসের নাম উল্লেখ আছে।ডঃ দীনেশ্চন্দ্র সেন, ডঃ নিহারঞ্জন দাস এই সমস্ত ঐতিহাসিকরা অট্টহাসের নাম বলে এসেছেন।উড়িষ্যার বিন্দু সাগর তীরেতে যে মন্দির আছে সেখানে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়।সেই শিলালিপিতে লিখছেন বাচস্পতি মিশ্র।এখানে অট্টহাস সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।সেই সময় পাল যুগ বৌদ্ধ প্রভাবিত যার জন্য যারা এই তান্ত্রিক তারা প্রায় বিরল হয়ে গিয়েছিলো।তিনি ঢাকার বিক্রমপুর থেকে ভর্ম রাজবংশ থেকে বেশ কিছু মৈথিল ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে ফুল্লরা মায়ের পুজো করেছিলেন।

     অট্টহাস সেটাকেই বলা হয় যে অট্টহাসে দেবীর নাম ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশ।৫১ মহাপীঠ মানেই ভৈরব।এখানে ভৈরব বিশ্বেশ।এখানে মাকে ভক্তি ভোরে পুজো দেওয়ার পরে ভৈরবকেও একইভাবে মনোস্কামনা জানাতে হয়।মা আদেশ দেন ভৈরব সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন।পুরাণেও সেই তথ্যই রয়েছে।তাই এখানে ঘোড়া বাঁধা, ঢিল বাঁধা ইয়াদি হয়।

    বীরভূমের প্রাচীন ফুল্লরা পিঠ একসময় ছিল তান্ত্রিকদের আভিচারিক ক্রিয়াক্ষেত্র।নির্জনতার কারণে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাধকরা এসে আসন পেতেছেন।পঞ্চমকার সাধনের যোগ্য স্থান এই ফুল্লরা সতীপীঠ।অতীতে ভৈরবী তন্ত্রমন্তের আসর বসত।আজও যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সাধক সন্যাসীরা সাধনার জন্য ভিড় করেন এই ফুল্লরার স্থানে।

    সবথেকে বড় সিদ্ধি হলো বাক সিদ্ধি যা ফুল্লরা পীঠেই হয়ে থাকে।এখানে নানান রকমের কর্মক্রিয়া  হয়েছে।তন্ত্রভুমি ফুল্লরাতে আগে নিয়মিত শিবাভোগের চল ছিল।

    দেবীর মাহাত্ম্য তো নানা ভাবে প্রকাশিত হয়।এখানে ছিল শিবভগের ব্যবস্থা।দুটি শিয়াল এসে ভোগের প্রসাদ খেত তবেই মায়ের পুজো হতো।এটা নিয়েও অনেক গল্প রয়েছে।প্রতিদিন এখানে অন্নভোগের ব্যবস্থা রয়েছে।দেবীকে রোজ মাছের ত্বক নিবেদন করা হয়।সামান্য প্রনামীর বিনিময়ে যে কেউ প্রসাদ পেতে পারেন।আমিষ এবং নিরামিষ দুই রকম ভোগই হয়।প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয় ফুল্লরায়।মাঘী পূর্ণিমাতে বিরাট মেলা বসে।১৫দিন ধরে চলে উৎসব।শেষ হয় শিবরাত্রিতে।আউল-বাউল-পীরদরবেশের গানে মুখর হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন।

    পীঠভূমি বীরভূম।প্রাচীন ঋষিদের আরাধ্যদেবী গৌরির দেশ।তন্ত্রসাধকদের পরম্পদ সন্ধানের সাধন ক্ষেত্র।চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে বীরভূমে সাক্ত ধর্মের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে বীরাচারী সন্যাসীর গৌরিকে পরিত্যাগ করে গৌরের অনুগামী হতে পারেননি।চৈতন্য লীলাকীর্তনকারী বামনদাসের লেখা পদে তার প্রমান মেলে।বীরভূম সম্পর্কে মহাপ্রভুর মুখ দিয়ে সেখানে বলানো হয়েছে ভক্তিশূন্য সর্বদেশ নাজানে কীর্তন কারো মুখে নাহি কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ।

    বীরভূমের বিরচন্দ্রপুরে জন্মগ্রহণ করেও বৈষ্ণব প্রভু নিত্যানন্দ ভক্তিরসের জোয়ারে সাক্তদের ভাসাতে পারেননি।লালমাটির পীঠস্থানগুলিতে বৈষ্ণবদের প্রবেশাধিকার অতীতে ছিল না।তবে এখন আর সেইসব নেই।মহাবৈষ্ণবী ফুল্লরার দরবারে ওঠে হরিনামের বোল।

    এই লাভপুরেই কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম।বরেণ্য সাহিত্যিকের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে গড়ে উঠেছে সংগ্রহশালা।ফুল্লরা মন্দিরের অদূরেই রয়েছেতারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মা ফুল্লরার কাহিনী।বিয়ের পর কয়েকবছর নিঃসন্তান থাকায় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মা শ্রীরামজী গোঁসাই নামের সাধকের কাছে যান।তার নির্দেশে দুর্গাপুজোর পর চতুর্দশীতে তারাপীঠে পুজোদিয়ে দেবী ফুল্লরার কাছে ব্রত উৎযাপন করেন।তারপরে গর্ভবতী হন এবং এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।মা তারার নাম সন্তানের নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর।তারাশঙ্কর সাহিত্যে মা ফুল্লরা, ফুল্লরা সতীপীঠের প্রচুর উল্লেখ রয়েছে।

    বৈচিত্র্যেভরা এক পীঠভূমি।জেক ঘিরে  আবর্তিত হচ্ছে তিনি হলেন দেবী ফুল্লরা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ