৫১ সতীপীঠের অন্যতম পুণ্যতীর্থ বক্রেশ্বর

 


বীরভূমের লালমাটির পথ পেরিয়ে তপভূমি বক্রেশ্বর।একেবারে তুচ্ছ অতি নগন্য উপকরণের মধ্যেও উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে অজস্র সুন্দরের অঢেল আয়োজন।মূল প্রবেশদ্বার থেকে মন্দিরে যাওয়ার যে পথ তার দুধারে বিস্তৃত দোকান।

    বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমার শহর বক্রেশ্বর।সুপ্রাচীন তপোভূমির এক অঙ্গ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে তিন মাহাত্বের ছটা।সিদ্ধপীঠ, মহাপীঠ এবং বক্রেশ্বরধাম।এক যাত্রায় তিনের পুণ্যার্জনের আকাঙ্খ্যা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন।

    মন্দিরময় বক্রেশ্বর যেখানে একই সঙ্গে শিব ও সতীর অবস্থান।দিনরাত পূজাপাঠ,যাগযজ্ঞ,সাধনা তন্ত্র এখানে চলে আসছে যুগযুগান্তর ধরে।পুরাণশাস্ত্রে কথিত এই মন্দিরের নির্মাণ স্বয়ং বিশ্বকর্মার হাতে।

    বক্রেশ্বরের সঙ্গে জড়িয়ে ঋষি অষ্টাবক্রের কাহিনী।এখানে ঋষি অষ্টাবক্র মুনি যার আট অঙ্গ বাঁকা ছিল, মহাদেবের তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।পিত কহর মুনি ও মাতা হচ্ছেন গার্গী।ঋষি অষ্টাবক্র মুনি পিতার বেদবাক্যের ভুল ধরেছিলেন তাই তার আট অঙ্গ বাঁকা হয়ে যায়।তারপরে ঋষি অষ্টাবক্র কয়েক-হাজার বছর আগে এখানে এসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।তাই তার নামানুসারেই স্থানের নাম বক্রেশ্বর।

    কথিত আছে অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে কাশীতে উপাসনার সংকল্প নেন।কিন্তু কাশির বিশ্বনাথ স্বয়ং তাকে গৌরদেশের গুপ্তকাশী বক্রেশ্বরে গিয়ে সাধনা করতে বলেন।বিশিষ্ট তীর্থভ্রমণ লেখক শিবশঙ্কর ভারতী তার 'ভারতের মন্দিরে মন্দিরে' বইটিতে লিখেছেন, অষ্টাবক্র মুনি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক।মহাভারতীয় যুগকে ভিত্তি করলে ঋষি অষ্টাবক্রের বিদ্যমানতা ও তীর্থ হিসেবে বক্রেশ্বরের প্রসিদ্ধি প্রায় চারহাজার চারশো আটান্ন বছর বলা যায়।

    "জয়ন্তি মঙ্গলাকালী ভদ্রকালী কপালিনী, দূর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বহা স্বধা নমহস্তুতে", এই মন্ত্র যেমন একদিকে উচ্চারণ হচ্ছে সেইরকম আরেকদিকে উচ্চারণ হচ্ছে "ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম।উর্বারুকমিববন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ স্বাহা"।মা মহিষমর্দিনী একদিকে যেমন ভক্তদের তার কৃপায় রক্ষা করছেন অন্যদিকে সেইরকম ত্র্যম্বক তিনি মহামৃত্যুঞ্জয় রূপে সেখানে বিরাজমান।এই কারণে প্রাচীন কাশীর সঙ্গে বক্রেশ্বরের তুলেন করা হয়।সেইকারনে বক্রেশ্বরকে বলা হয় গৌরকাশী।


    বক্রনাথের মন্দিরে ভগবানের চেয়েও উচ্চ আসনে রয়েছে তার ভক্ত।গর্ভগৃহে পিতলের ধাতু মন্ডিত যে শিলা রয়েছে তা অষ্টাবক্রমুনির।এর ঠিক পাশে কিছুটা নিচেই বক্রেশ্বর মহাদেবের ছোট শিলা।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক তথ্যের নিরিখে আজকের বক্রনাথের মন্দির ৭০০ বছরের বেশি পুরোনো।মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা নরসিংহ দেব।বাংলায় সুলতানী শাসনে মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর রাজা দর্পনারায়ণ ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তা সংস্কার করেন।

    সতীর মন পড়েছিল এই বক্রেশ্বরে দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা।বিগ্রহের ঠিক নিচেই রয়েছে মায়ের শিলীভূত রূপ আর ঠিক তার ওপরেই দশভুজা সিংহবাহিনী অষ্টধাতুর দেবী মূর্তি।

    এখানে পড়েছিল ভ্রু মধ্যস্থ মন অর্থাৎ মায়ের ত্রিনেত্র যেখানে থাকে সেই স্থানে যে মন থাকে সেই মন পড়েছিল এই বক্রেশ্বরে।অন্যান্য সতীপীঠে যেখানে সব জায়গাতে আমরা শিলাময়ী মূর্তিতে অধিষ্ঠান করছেন সেখানে বক্রেশ্বরে পিতলের মূর্তিতে মা অবস্থান করছেন।

    সতীর ভ্রূসন্ধি বা মনস্থান পড়েছিল বলে ভারতবর্ষের ৫১ সতীপীঠের মধ্যে বক্রেশ্বরকে গণ্য করা হয়।তন্ত্রের ভাষায় ওই মনস্থানকে আজ্ঞাচক্র বলে।বাংলাদেশের দেবী ঢাকেশ্বরী সাথে বক্রেশ্বরের মহিষাসুর মর্দিনী রূপের মিল রয়েছে।পীঠমালা, কালিকাপুরাণ ও তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে বক্রেশ্বরের উল্লেখ আছে।দেবী মন্দিরে বেদীর ওপরে ভ্রূসন্ধির প্রাচীন কালো পাথর রক্ষিত আছে।জনশ্রুতি খাকি সম্প্রদায়ের এক মহাত্যা যিনি খাকিবাবা নাম খ্যাত তিনি বেদীতে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন।

    বক্রেশ্বরে আরও একজন বিদ্যমান।আমরা জানি মা সতীর সঙ্গে তার ভৈরব থাকেন।কিন্তু বক্রনাথ মহিষমর্দিনীর ভৈরব নন।মহিষমর্দিনীর ভৈরব হলেন বটুকনাথ ভৈরব।মাতৃ মন্দিরের একদম গায়েই বটুকনাথ ভৈরবের অধিষ্ঠান।একটুখানি পাতালে প্রবেশ করলে তবে দর্শন মিলবে তাঁর। মা এখানে সাত্বিকভাবে পূজিত হয়।এখানে মায়ের কোনো আমিষভোগ চলে না।মায়ের মন্দিরে বলিও দেওয়া হয় কিন্তু তা ভৈরবের উদ্দেশে।

     ৫০০বছর আগে বক্রেশ্বর ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা নির্জন ভূমি।চৈতন্য ভাগবতে তা প্রমান মেলে।কাটোয়ায় সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভু শ্রীচৈতণ্য বলেছিলেন, "বক্রেশ্বর আছেন যে বনে তথায় যাইনু মুঁঞ্চি থাকিমু নির্জনে"।সেই সময়টায় তান্ত্রিক ভৈরবী অঘোরপন্থীদের দাপট ছিল বক্রেশ্বরে।শ্মশান আর জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে বসতো তন্ত্রচক্র।



      মহাপীঠ বক্রেশ্বর কে বেষ্টন করে রয়েছে সাতটি উষ্ণপ্রস্রবন ও একটি শীতল জলের কুন্ড।মাটির নিচ থেকে জলের নিরন্তর বিচ্ছুরণ হ্যা চলেছে।সোডিয়াম,পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, বা-কার্বনেট কী নেই এখানকার জলে।একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে আছে ধর্ম ও বিজ্ঞান।মন্দির প্রাঙ্গনে ছড়ানো ছিটোনো এমনই সাত সাতটা কুন্ডে রয়েছে রাসায়নিক খনিজের অনন্ত সম্ভার।

    কুন্দের সঙ্গে জড়িয়ে পৌরাণিক কাহিনী।শরীরের আট জায়গা বেঁকে যাওয়ার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে শিবের সাধনা করেন ঋষি অষ্টাবক্র।তপস্যায় তুষ্ট মহাদেবের নির্দেশে সমস্ত তীর্থের জল সুড়ঙ্গ পথে এসে ঋষির যন্ত্রণার জ্বালা নিরাময় করে।অষ্টাবক্রের শারীরিকজ্বালার সংস্পর্শে আসা জল থেকে বিভিন্ন তপ্ত কুণ্ড সৃষ্টি হয়।   

    বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী মাটির নিচে থাকা জল যখন তপ্ত আগ্নেয় শিলার কাছে অবস্থান করে এবং মাটির উপরে উঠে আসে তখনি এমন দৃশ্য দেখা যায়।অগ্নিকুন্ডের জলের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট।এই জলে এমন  বহু খনিজ পদার্থ আছে যা খেলে অম্ল রোগ সারে।তাই এই জল বিক্রিও হয়।অগ্নিকুন্ডের জলে হিলিয়াম গ্যাস এর সন্ধান পাওয়া গেছে।পাশেই রয়েছে তার গবেষণাগার।সৌভাগ্য কুন্ডের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি।শীত পড়লেই গরম জলে স্নানের মজা নিতে পর্যটকরা এখানে এসে হাজির হন।

    সৌভাগ্য কুন্দের পাশেই রয়েছে এক বিশাল প্রাচীন কালী মন্দির।খাকিবাবার শিষ্য পূর্ব বর্ধমানেই দাঁইহাট গ্রামের হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মহাশিবরাত্রি, দুর্গাপুজো ও শ্রাবণ মাস এই হচ্ছে বক্রেশ্বর ধামের বিশেষ উৎসব।

    এ যেন অনাদিকালের ঘুম ভাঙ্গানোর জায়গা।সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম।সন্ধ্যাকালে জেগে উঠছে এ যেন এক অন্য বক্রেশ্বর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ