পুণ্যতীর্থ ভারতবর্ষ।পুণ্যাত্মা-সাধু-সন্ত-সাধক মহাত্মার দেশ।মায়ের অমোঘ টানে ভক্তকূল যুগ যুগ ধরে ছুটে চলেছে।সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পাহাড় পর্বত বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে পাদপদ্মে পৌঁছে দিয়েছে পুষ্পাঞ্জলি।মায়ের কত লীলা।
তিনি সর্বসৃষ্টির আধার তিনিই বিস্তৃত আদি-মধ্য-অন্তে সৃষ্টির সর্বত্র।তিনিই পরম সত্যের আকর জগৎ মাঝে করেছেন ব্যাপ্ত।কালের প্রবাহে এগিয়ে চলেছেজীবনের নিত্যভাবরাজি।তিনিই সৃষ্টি-স্থিতি পালনকর্তী, তিনিই আদিমাতা।মহাকালের রথচক্র করেছেন ধারণ।একের মধ্যেই অদ্বৈত শক্তির প্রকাশ।
ওড়িশার নৈস্বর্গিক শোভার উৎস গঞ্জাম।পারসী শব্দ গঞ্জামের বাংলা অর্থ বিশ্বের শস্যগোলা।পাহাড় পর্বত নদী অরণ্যে একেবারে মহামিলন ক্ষেত্র এই গঞ্জাম জেলা।এই গঞ্জাম জেলার কুমারী পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করছেন মা তারাতারিণী।
নীল আকাশের গায়ে ঢেউ খেলছে সবুজ টিলা।প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এই মন হয়ে উঠবে নির্মল আনন্দে পরিপূর্ণ।হয়তো এই সবই স্থান মাহাত্বের খেলা।
গঞ্জাম জেলার বহরামপুরের কিছু দূরেই ঋষিকুল্ল্যা নদীতীরে কুমারী পর্বতের চূড়ায় মায়ের অধিষ্ঠান।৫১ পীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবেই প্রসিদ্ধ এই তারাতারিণী মন্দির।মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী মন টানবে দর্শনার্থীদের।মন্দির গাত্রে চোখে পড়বে দশমহাবিদ্যার দশ রূপ।
পুরীতে বিমলা, গুহাটিতে কামাখ্যা, কালীঘাটে কালী আর ওড়িশার গঞ্জামে এই হলো তারাতারিণী।সাধনপীঠ বা শক্তিপীঠের বিচারে দেশের চার গুরুত্বপূর্ণ মহাপীঠের মধ্যে এই তারাতারিণী একেবারেই অন্যতম।পাহাড় চূড়ায় অবস্থান করছেন দেবী।৯৯৯টি সিঁড়ি ভেঙে তবেই মেলে দেবীর দর্শন।এখানেই সতীদেহের স্তন পড়েছিল।
বিভিন্ন প্রকার ভক্ত এখানে আসেন।মা-কে যাতে কারোর নজর না লাগে তাই মা-কে সন্ধ্যায় মহাস্নান করানো হয়।তারপরে সন্ধ্যা আরতি হয়।তারপরে রাত ৮:৩০-৯:০০ পর্যন্ত মায়ের আবার অন্নভোগ হয়।অন্নভোগের পর মায়ের বিশ্রাম নেওয়ার সময়।এই মন্দিরের সবথেকে বড়ো আকর্ষণ আরতি।নামগানে-সংকীর্তনে ভক্তিভবে পূর্ণ হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর।
মায়ের তিনবার আরতি হয়।প্রথমে হয় সকালে ৬:০০ টার সময়।মধ্যাহ্নে অন্নভোগের সময় একবার আরতি হয়।কিন্তু সবচেয়ে দর্শনীয় ও প্রসিদ্ধ আরতি হয় সন্ধ্যে ৭:০০টার সময়।
অষ্টধাতুতে তৈরি মূর্তি।একদিকে তারা ও অন্যদিকে তারিণী মধ্যস্থলে রয়েছে আরও দুই দেবীর অধিষ্ঠান।পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী এখানে সতীর স্তনযুগল পতিত হয়েছিল।ভক্তিভরে মা-কে ডাকলেই মা বিপদ থেকে তাড়ণ বা উদ্ধার করেন।তাই মায়ের অপর নাম সংকটদ্বায়িনী।তারা ও তারিণী দুই দেবী।তারা মা হলেন ভাগ্যের দেবী।ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বহু ভক্ত মাকে ডাকে।তারিণী মা সর্বদুঃখ হারিণী।
হাজার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে তারাতারিণী মন্দিরে।এই হাজার সিঁড়ি নিয়েও রয়েছে পৌরাণিক উপাখ্যান।রয়েছে সংকট মোচন দেবীর লীলা কাহিনী।লোকশ্রুতি সমুদ্র যাত্রাকালে তারাতারিণী দেবীর এক ভক্ত বিপুল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।কালো আকাশ, ঝোড়ো বাতাসে উত্তাল সমুদ্র।খ্যাপা ঢেউয়ের দোলায় ডুবতে বসেছে জাহাজ।উপায় না দেখে মায়ের শরণাপন্ন হন ওই বণিক।আর তখনি সংকটদ্বায়িনী রূপে দেখা দেন মা।ভক্তের ডাকে সারা দেন সংকটদ্বায়িনী তারাতারিণী।মায়ের বরাভয়ে শান্ত হয় সমুদ্রের জল।জাহাজে থাকা মনি-মানিক্য-মুক্ত-রত্নরাজি খরচ করে পাহাড় কেটে মন্দিরের হাজার সিঁড়ি বানিয়ে দেন ওই বণিক।
তারাতারিণী মন্দিরের গা বেয়ে নামলেই তীরতীয়ে বয়ে গেছে শান্ত-সমাহিত ঋষিকুল্যা নদী।নদীর সঙ্গেও রয়েছে দেবীর নিবিড় সম্পর্ক।ধ্যানস্তব্ধ শান্ত সমাহিত ঋষির মতো পুণ্যতোয়া ঋষিকুল্ল্যা নদী।যুগ যুগ ধরে ওড়িশা বাসীর বিশ্বাস বড়োই আদরের ধন এই ঋষিকুল্ল্যা।একদিকে পাপহারিণী মা তারাতারিণী দেবী অন্যদিকে পবিত্র এই ঋষিকুল্ল্যা নদী।মানুষের সঙ্কট মোচনের জন্য এই দুজনকেই একমাত্র পথ হিসেবে ভাবেন এই ওড়িশার গঞ্জাম জেলার মানুষ।
গঙ্গার থেকেও প্রাচীন এই নদী এমনটাই বিশ্বাস ভক্তকুলের।ঋষিকুল্ল্যা ও মায়ের এক এক নিবিড় সম্পর্ক আছে।মা যখন পাপের বিনাশ করতে চেয়েছে এই ঋষিকুল্ল্যা নদীর জলে ডুবিয়ে বিনাশ করেছে।
মন্দিরে ঢোকার মুখেই রয়েছে ঘন্টা।ঘন্টা বাজিয়ে মায়ের কাছে মনস্কামনা জানান ভক্তরা।বাইরেই দেবীর বাহন সিংহ।দেবীর পুজো দিতে আসা ভক্তকুলের আদর পান সিংবাহিনীও।আর মন্দিরের তলদেশে ভৈরবের বাস।সে পথ বড় দুর্গম।শৈব পীঠ অর্থাৎ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বা পঞ্চমহাদেব মায়ের ভৈরব।ঐস্থান খুব বড় তন্ত্রপীঠ।মায়ের কাছে যেসমস্ত মনোস্কামনা নিয়ে ভক্তগণ আসে মা সব মনোস্কামনা পূর্ণ করে।
কুমারী পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করছেন মা তারাতারিণী তার থেকে একদম সরাসরি নীচে অবস্থান করছেন সোমেশ্বর মহাদেব।
"সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়ণী নমহস্তুতে।সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানাং শক্তিভুতে সনাতনী।গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণী নমহস্তুতে"।ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,"সংসারে যে তাকে ডাকে সে বীরপুরুষ।যে সংসারত্যাগী সে তো ঈশ্বরকে ডাকবেই।তার সেবা করবেই, তাতে আর বাহাদুরী কি আছে?সংসারে থেকে যে ডাকে, বিশ মণ পাথর ঠেলে যে দেখে সেই তো ধন্য, সেই বাহাদুর, সেই বীরপুরুষ।ঈশ্বর তাঁর প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট হন"।তাই সংসার যজ্ঞের হাজারো কাজ ফেলে এই ভক্তকুল ছুতে আসেন মায়ের অমোঘ টানে।
কুমারী পর্বতের গায়ে সন্ধ্যা নামছে।আকাশের গায়ের কালো পর্দা টেনে দিচ্ছেন বিধাতা।সামগানের মন্ত্রে প্রদীপ শিখায় উদ্ভাসিত তারাতারিণীর মন্দির।মন্ত্রের পবিত্র সুর মিলিয়ে যায় ঋষিকুল্ল্যা নদীর গা বেয়ে দূর পাহাড়ের সীমানায়।বরাভয় নিয়ে জাগ্রত তারাতারিণী।
0 মন্তব্যসমূহ