কঙ্কালীতলার মাহাত্ম্য


অজয় নদের পাড় ধরে লাল মাটির পথ ধরে বীরভূমের বোলপুর শহর।তিরতিরিয়ে বয়ে চলা বোলপুর বাসীর খুবই আপন কোপাই নদী।এই কোপাই নদীর একদম দক্ষিনে অবস্থান মা কঙ্কালীর।

    বোলপুর শহর থেকে প্রায় ৯কিমি দূরে উত্তর-পূর্বে সবুজের সমারহ।নগরায়নের হাত ধরে এখন অনেক পাতলা।তবুও যা আছে তার সৌন্দর্য্য অপার।লালমাটির আদর আর প্রশান্ত মনোময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে আঁকে-বাঁকে চলা ছোট এই নদী কোপাই।রাঙামাটির দেশে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা।বাংলার ১৩৪৯ সালে এই মন্দির স্থাপিত হয়।তার আগে একচালা খড়ের ছাউনি ঘরে মায়ের পুজো হতো।

    মূল প্রবেশদ্বার পেরোলেই চোখে পড়বে অজস্র ভিড়।পীঠভূমির বুক জুড়ে বসে বিকি-কিনির আসর।প্রেম-ভক্তি -আদর-অনুরাগ একাকার হয়ে যায় সব।প্রবেশপথ পেরিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলে দেখা যায় মাতৃ নামে মুখর এই আকাশ-বাতাস।

    তন্ত্রচূড়ামণিতে ৫১ পীঠের তালিকায় কাঞ্চি নামের জায়গাকে ২৮ তম সতীপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।কঙ্কালীতলা আজকের নাম।প্রাচীন তীর্থ হিসেবে এর নাম ছিল কাঞ্চিদেশ।এখানে দেবী হলেন দেবগর্ভা।তাঁর ভৈরব হলেন রুরু।পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুসারে এখানে দেবীর অস্থি বা কঙ্কাল পড়েছিল।সেই কারণে পিঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা।আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশ পড়েছিল।"কাঞ্চিদেশে পড়িল কাঁকলি অভিরাম।দেবগর্ভা দেবতা, ভৈরব রুরু নাম"।অন্যান্য শক্তিপীঠের মতো এই শক্তিপীঠ নিয়েও শাস্ত্র ও শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।মন্দিরের সেবায়িত ও স্থানীয় তন্ত্রসাধকদের মতে সতীর কটিদেশ পড়ার তথ্য এখানে বেশী জোরালো।    

    সতীর দেহ নিয়ে তান্ডব নৃত্য করাকালীন অবস্থায় বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ খণ্ডিত করে দিয়েছিলেন।শুধুমাত্র কোমর তাই মহাদেবের কাঁধে ছিল।বিষ্ণুদেব সেই কথা মহাদেবকে জানালে মহাদেব মরতে নেমে এসে মায়ের অঙ্গটিকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন।তখন বসুমতী সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে নিচে বসে যায় এবং বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়।তারপর মহাদেব দেবীকে স্তূপাকার করে দিয়ে কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাট থেকে সুড়ঙ্গ পথে গঙ্গাকে নিয়ে আসেন এবং এই গর্তটিকে জলপূর্ণ করে দেন।এই জায়গা সতীকুন্ড নামে পরিচিত।সেই প্রণাম মন্ত্র, "কুন্ড সলিলওবাসিনী বেদগৰ্ভা কঙ্কালীমাতার চরণে নানা পুষ্পাদি সহিত বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলী দেবী কঙ্কালীকায় নমঃ"।



    গুপ্ততন্ত্র সাধনার জন্য প্রসিদ্ধ কঙ্কালীতলা।শক্তিপীঠে এই কুন্ডকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেবী মাহাত্ম্য।কঙ্কালীতলায় দেবী হলেন দেবগর্ভা আর ভৈরব হলেন রুরু।'রু'-শব্দের অর্থ আলো।এই আলো চৈতন্যের অনুভূতির আলো।মন্দির সংলগ্ন কুণ্ডের জলে শিলারূপে অবস্থান মায়ের।

    কঙ্কালীতলায় আগে কোনো মন্দির ছিল না।শুধুমাত্র ওই জলাশয়টি ছিল।এই সতীকুন্ডের জল কখনোই মরে না।পুরাণ মতে মহাদেব সতীদেহের এই অংশটিকে সুরক্ষিত করে দিয়েছেন।লোকশ্রুতি কুন্দের মধ্যে কয়েকটি প্রস্তর খন্ড রয়েছে।যেগুলিকে সাধক দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।ওই প্রস্তর খণ্ডগুলিকে কুড়িবছর অন্তর কুন্ড থেকে তোলা হয়।পুজোর পর সেগুলিকে আবার কুন্ডের জলের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়।পুরাণমতে এই সতীর শেষ অংশ ছিল তার চৈত্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ শেষ দিনে এখানে মহাপুজো হয়।মেলা বসে ও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।ছাগ বলি, অন্নদান, বস্ত্রদান ও বহু দেশদেশান্তরে লোক মায়ের দর্শনে ছুটে আসে।

    কঙ্কালী পীঠের মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই।রয়েছে শ্মশানকালীর বড় এক বাঁধানো ছবি।দেবগর্ভার উদ্দেশ্যে এই ছবিতেই নিত্য পুজো হয়।এখানে মা-কে ঘটে-পটে পুজো করা হয়।শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুকুল দে এই পট টি এঁকেছিলেন।

    সতীকুন্ডে শায়িত মহাদেবের রক্ষকের ভূমিকায় বিরাজ করছেন কঙ্কালীতলার ত্র্যম্বক।পীঠভূমির প্রাঙ্গনে যে বটগাছ রয়েছে তার শীতল ছায়ায় রুরু ভৈরবনাথের মন্দির।মহাদেব নিজের জটা ছিড়ে রুরু ভৈরবকে সৃষ্টি করছিলেন মায়ের প্রহরী হিসেবে।

    পর্যটকদের সাথে এই শক্তিপীঠ স্থানীয়দের কাছেও খুব প্রিয়।বটগাছ, আম, কালোজাম ও বাবলা বনের এই এক বাহারি সমাবেশ।বহু পূর্বে তপোবনের মতো পরিবেশ ছিল কঙ্কালীতলায়।অজয় উপত্যকার এই তীর্থভূমিতে পা রেখেছিলেন জৈন ধর্মগুরু মহাবীর।মহাবীরের জন্ম গৌতমবুদ্ধের জন্মের কয়েক বছর আগে।৭২ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।ঐতিহাসিকদের অনুমান সেই হিসেবে আড়াই হাজারের বেশি সময়ের আগে কঙ্কালী পীঠে এসেছিলেন মহাবীর।কথিত আছে এককালে ঋষি কঙ্খলের আশ্রম ছিল এখানে।

    দক্ষিণভারতের কাঞ্চিপুরমকে অনেক মানুষ সতীপীঠ মনে করেন আবার বর্ধমানের কাঞ্চননগরে দামোদরের পারে কঙ্কালেশ্বরীর মন্দির আছে।অনেকে ওটাকেও সতীপীঠ মনে করেন।কিন্তু সমস্ত দাবি নস্যাৎ করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে একমাত্র কঙ্কালীতলাই হচ্ছে সেই সত্যি পীঠের অন্যতম পীঠ।কারণ এখানে একমাত্র রুরু ভৈরবের মন্দির আছে আর কঙ্কালীপীঠের সঙ্গে রুরু ভৈরবের নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।

    এই স্থানের নাম কাঞ্চিদেশ হওয়ার এক ইতিহাস রয়েছে।সেই সময় পাল রাজাদের রাজত্বকালে চোল বংশের কিছু সৈনিক এখানে এসেছিলেন।এই স্থানে এস তারা একটি মন্দির নির্মাণ করেন।সেই শৈব মন্দিরের নাম দিয়েছিলেন কাঞ্চীশ্বর।সেইখান থেকে এর নাম হয় কাঞ্চিদেশ।

     সন্ধ্যে হলে বদলে যায় পরিবেশ।তন্ত্র-মন্ত্রের অভিচারিক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হতে লাগে কঙ্কালীতলা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ