ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যার ইতিহাস

 


    পূর্ব বর্ধমানের  কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত মঙ্গলকোট থানা এলাকার মধ্যে পড়ে ক্ষীরগ্রাম এখানেই বিরাজমান দেবী যোগাদ্যা।পৌরাণিক বিশ্বাস, মঙ্গোল কোটের ক্ষীরগ্রামের ক্ষীর দীঘিতে পতিত হয়েছিল সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল।সেই থেকেই দেবী পাতালবাসিনী।ক্ষীরগ্রামে ভৈরব ক্ষীরখণ্ডক যোগাদ্যা শ্রামহামায়া বখ্যাংগুস্ট পদমম।ক্ষীরদীঘির অতলেই থাকেন দেবী যোগাদ্যা।মায়ের দেখভাল করেন দীঘির মাছেরাই।এর নেপথ্যে আরো একটি কারণ আছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।অতীতে বহিরাগতদের হাতে বার বার আক্রান্ত হয়েছে এই মন্দির।ভৈরবও রক্ষা পাননি হয়তো দেবীকে অত্যাচারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে দীঘির জলে লুকিয়ে রাখা হতো মূর্তি।সারাদেশে এমন ঐতিহাসিক নিদর্শন কম নেই।

    এখানে দেবী মূর্তি কষ্ঠি পাথরের তৈরী।তিনি দশভুজা সিংহ বাহিনী এবং মহিষমর্দিনী।ক্ষীর দীঘির ভেতর সাদা মন্দিরের ভেতরে জলের মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান।দীঘির পাঁক পরিষ্কার করার সময় আরো এক মহিষমর্দিনী দেবী মূর্তি পাওয়া যায়।নতুন এক মন্দির স্থাপন করে সেখানে তাঁর পুজো করা হয়। মাঝের অংশ বেশ উঁচু আর সেখানেই রয়েছে মায়ের বাড়ি।এখানে মূর্তি শুন্য বেদীতেই মায়ের পুজো হয়।এই বেদীর নিচেই আছে এক সুড়ঙ্গ।এই মন্দিরে দেবীর নিত্য আমিষ ভোগ হয়।

  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার কুব্জিকা তন্ত্র কাব্ব্যে লিখছেন অশোক বনে সীতাকে উদ্ধারে রাবণের ভাই মহীরাবণের হাতে বন্দি হন রাম ও লক্ষণ|ভদ্রকালীর উপাসক মহীরাবণকে বধ করে দুই ভাইকে মুক্ত করেন হনুমান।ঘটিয়ে দেন লঙ্কা কাণ্ড।তারপর এই সুড়ঙ্গপথে  ভদ্রকলীকে নিয়ে চলে আসেন ক্ষীরগ্রামে।পাতালে রেখে দেন দেবীকে।সেই থেকেই তিনি পাতাল বাসিনী।


    পাতালবাসিনী দেবী যোগাদ্যা বছরে মাত্র ছয়বার নিজের অতলজলের এই আওহ্বান থেকে আত্মপ্রকাশ করেন।এর মধ্যে বছরের দুটি দিন ৩১শে বৈশাখ ও ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ তাঁকে দেখার সুযোগ পান সাধারণ পুর্ণার্থীরা আর বাকি দুদিন দেখার সুযোগ পান এই মন্দিরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকা সেবায়িতরা আর বাকি দুদিন তাঁকে দেখতে পান শুধুই যিনি তাঁর পূজার্চনা করছেন সেই পুরোহিত।অর্থাৎ দেবী এখানে নানা রূপে একদিকে যেমন সজ্জিত তেমনি সমান ভাবে চির রহস্যাবৃতা।


    বর্ধমান জেলার তিন জায়গা সতীপীঠ হিসাবে প্রসিদ্ধ তার মধ্যে সবথেকে জাগ্রত ও জনপ্রিয় পীঠ এই যোগাদ্যাই।বছরের মাত্র ৬টি দিন পাতাল থেকে মর্তে উঠে আসেন দেবী।ক্ষীরদীঘি থেকে তোলা হয় মাতৃ প্রতিমা।মঙ্গলকোট কৈচরের ক্ষীরগ্রাম যোগাদ্যা।কথিত আছে মা এখানে পাতালে জলের নিচে অতলস্পর্শী হয়ে।আর যে মা মন্দিরে পূজিত হন সেটি প্রতিরূপ মাত্র।আসল মূর্তি শুধু ৩১শে বৈশাখ আত্মপ্রকাশ করে।আর তখন গোটা এলাকা তৈরী হয় আনন্দঘন মেলার পরিবেশ যা সতীপীঠ হওয়ার পাশাপাশি এই গোটা জায়গাকে একটু অন্যভাবে মাহাত্ম দিয়ে থাকে।

    ৩১শে বৈশাখ প্রায় ১লক্ষ মানুষ মায়ের দর্শন পান।এখানে একটা ধর্মীয়ভাবে বা সামাজিক ভাবে একটা খুব সুন্দর পরিবেশ তৈরী হয়।সমস্ত ধর্মের মানুষ এখানে আসেন।এখানে এই উপলক্ষে একটি বড় মেলা বসে।সমস্ত মানুষ সেই মেলাটাকে এবং পুজোটাকেও সমান ভাবে উপভোগ করেন।  

     লোককথা আরো আছে।কথিত আছে এই ক্ষীরদীঘিতেই তদানীন্তন পুরোহিত স্বয়ং মা অনার্যদেবীর দেখা পান।এই অনার্যদেবীকে আর্যমতে পুজো শুরুকরেন এখানকার জমিদার হরিদত্ত।সেই থেকে দত্ত পরিবারই এই মন্দিরের বিগ্রহরূপে দেবীর আরাধনা করে আসছে।



    সারাবছরই মন্দিরে হাজারো ভক্তের সমাগম।নিত্যপুজোয় প্রতিদিনই থাকে ভোগের ব্যবস্থা।মন্দিরে দেবী দর্শন সেরে মায়ের ভোগ খেয়েই বাড়ি ফেরেন দর্শনার্থীরা।বসে খাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।ক্ষীরগ্রামে দুর্গাপুজো হয় না।পূজিতা হন দেবী ভদ্রকালী।বোধনের দিন গ্রামের ডোম সম্প্রদায়ের কোনো একজন সদস্য দেবীকে বুক চিরে রক্ত দেন।সেই দানের পর শুরু হয় দেবীর আরাধনা।

  এই গ্রামে মাঘ মাসে পালিত হয় আরো এক রীতি।গোটা মাঘ মাস দেবী তাঁর সখি সঙ্গীদের নিয়ে নৃত্য করেন ওই মন্দিরের ভেতরে।সেই কারণে এখানে যারা মায়ের ঢাকি তারা রাত্রিবেলায় ওই দুয়ারের ভেতর একটা পা আর বাইরে একটা পা দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় বিভিন্ন তালে ঢাক বাজান।এটার নাম নিশিঢোম্বর এবং মা-ও এর তালে তালে নৃত্য করেন।

    দেবী যোগাদ্যাকে নিয়ে ক্ষীরগ্রামে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে,"যার ভয়ে পালাও তুমি সেই মা যোগাদ্যা আমি"।কথিত আছে এখানকার রাজা হরিদত্তকে দেবী স্বপ্নে নরবলি দিয়ে নিত্য পূজার আদেশ দেন।এরপর রাজা ৭দিনে পর পর নিজের সাত পুত্রকে বলি দেন।তারপর গ্রামের প্রত্যেককে একটি করে পুজোর পালা বেঁধে দেন।সেইরকমই একদিন পুজোর পালা পড়ার আগের রাতে স্ত্রী পুত্রকে  নিয়ে ক্ষীরগ্রাম থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন এক পূজারী।ক্ষীরগ্রামের সীমানায় গিয়ে তিনজন ক্লান্ত হয়ে এক বিরাট গাছের তলায় শুয়ে পড়েছিলেন এবং ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।ব্রাহ্মণ স্বপ্নে এক বুড়িকে তার দিকে আস্তে দেখে। "তা বাবা এই অন্ধকার মধ্য রাত্রিতে তোমরা মাঝ মাঠে তিনটি প্রাণী এখানে ঘুমিয়ে আছো কেন? আর বলনা বুড়িমা এই ক্ষীরগ্রামে এক রাক্ষসী এসেছে তাকে নাকি দৈনিক একটা করে নরবলি দিয়ে পুজো করতে হবে।রাত পোহালেই আমার পালা আমার ছেলেকে দিতে হবে তার থেকে আমি ক্ষীরগ্রামের সীমানা পেরিয়ে চলে যাই।তখন সেই বুড়িমা বলছেন আমিই তো সেই যোগাদ্যা।যার ভয়ে পালাও তুমি সেই মা যোগাদ্যা আমি"।মা খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন তুই টের বাড়ি ফিরে যা।আমি আজ থেকে আর নরবলি নেবো না।

    এখানে আরো এক কাহিনী আছে মা যোগাদ্যার শাঁখা পরাকে কেন্দ্র করে।যুবতী সধবার বেশে উনি ঘাটে বসে স্নান করছিলেন।সেই সময় পাশের গ্রাম থেকে (খুব সম্ভব গোবর্ধনপুর)শাঁখারি শাঁখা বিক্রি করতে এসেছিলেন।তখন মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাবা তোমার ওতে কি আছে?আমার শাঁখা আছে মা।তা আমাকে শাঁখা পরিয়ে দিয়ে যাও।কিরকম শাঁখা পরবে মা? মা উত্তরে বলে তোমার কাছে ভালো যে শাঁখা আছে আমাকে দাও।পাঁচ টঙ্কা দাম! তিনি ভয়ে ভয়ে শাঁখা পরালেন।মা শাঁখার দাম! মা উত্তরে বলে ওই যে মন্দিরের চূড়া দেখতে পাচ্ছ ঐখানে আমার বাবা আছে তাকে গিয়ে বলো তোমার মেয়ে শাঁখা পরেছে।শাঁখারি খোঁজ খবর করে ঠাকুর মশাইয়ের বাড়ি যায়।ঠাকুরমশাই উত্তরে বলে আমার সাত কূলে কোনও মেয়েই নেই।শাঁখারীকে নিয়ে ঠাকুর মশাই দেখতে এলেন কোন মেয়ে শাঁখা পরেছে? ঘটে এস দেখেন কেউ নেই।তখন মা দুটো হাত শাঁখা পরা পর্যন্ত দেখালেন।হাত যখন দেখালেন ঠাকুরমশাই তখন শাঁখারির পা জড়িয়ে ধরলেন।আমরা পুরুষানুক্রমে বছরের পর বছর পুজো করেও যা করতে পারলাম না।তুই সেই মা-কে শাঁখা পরিয়েছিস।তার মানে ভাব তুই মায়ের কত বড় ভক্ত।

    ইংরেজি ভাষায় প্রথম মহিলা কবি তরু দত্ত একসময় এই মা যোগাদ্যাকে নিয়ে একটি কবিতাও লেখেন।মা যোগাদ্যার মহিমার কথা বহুদিন থেকে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে।মূর্তিহীন দেবী সাধনার পাশাপাশি নতুন করে উদ্ধার হওয়া মূর্তিতেও এখন নিয়মিত পুজো হয়।দুই মন্দিরকে ঘিরে মা যোগাদ্যার কিংবদন্তিতে আজও মজে আছে গোটা ক্ষীরগ্রাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ