শনিদেবের ব্রতকথা

      


 
 ব্রতের নিয়ম- শনিবার সন্ধ্যাকালে ঘরের বাহিরে উঠানে এই ব্রত করিতে হয়।ইহাতে সত্যনারায়ণ পূজার ন্যায় সিন্নি দেওয়া হয়।সারাদিন উপবাসী থাকিয়া সন্ধ্যায় শনিদেবের পূজার শেষে ব্রতকথা শুনিয়া নির্মাল্য প্রসাদ গ্রহণ করিবেন।

        ব্রতের উপকরণ- উৎকৃষ্ট ফল ৫টি, পান,সুপারি, কালোপাড় ধুতি, লোহার আসনাঙ্গুরীয়, মধুপর্কের বাটি, মাষকলাই, কালো তিল, নীল অপরাজিতা ফুল, নৈবেদ্য, মিষ্টান্ন, ধূপ-দীপ, সিন্নির জন্য-আটা, দুগ্ধ, গুড়, কলা, বাতাসা, কালোমাটির ঘট বা লোহার ঘট, পুস্প, গঙ্গাজল ও গঙ্গামাটি ইত্যাদি।

        ব্রতের ফল- এই ব্রত করলে শনিদেব প্রসন্ন হন।সংসারে আপদ-বিপদ, দুঃখ-কষ্ট দূর হইয়া সংসার শান্তিময় হয়।শনিদেবের কৃপায় সর্বপ্রকার গ্রহদোষ কাটিয়া যায়।

        পূজাবিধি- আচমনাদি সমাপন করিয়া স্বস্তি বাচন ও সংকল্প করিয়া গণেশাদি পঞ্চদেবতার পূজান্তে যথাবিধি ঘটস্থাপনাদি করিয়া শনিদেবের ধ্যানান্তে যথাশক্তি উপাচারে পূজা করিবেন।

        ধ্যান- ওঁ সৌরাষ্ট্রং কাশ্যপং শূদ্রং সূর্য্যাস্যং চতুরঙ্গুলম্।কৃষ্ণং কৃষ্ণাম্বরং গৃধ্রগতং, সৌরিং চতুর্ভুজম্।উদ্ববাণং শূলং ধনুর্হস্তং সমাহৃয়েৎ।যমাধিদৈবতং দেবং প্রজাপতি প্রত্যধিদৈবত্যম্।

        পূজামন্ত্র- ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায় নমঃ।

        প্রণাম মন্ত্র- ওঁ নীলাঞ্জনচয়ং প্রখ্যং রবিসূতং মহাগ্রহম্।ছায়ায়া গর্ভসম্ভুতং বন্দে ভক্ত্যা শনৈশ্চরম্।

অতঃপর নবগ্রহ, দশদিকপাল, ছায়া, সর্বাণী, কালী, শিব, যম ও প্রজাপতির পূজা করিয়া পরে শনির পঞ্চোপচারে পূজা করিবেন।শেষে--"ওঁ গৃধ্রায় নমঃ" মন্ত্রে গৃধ্রের পূজা করিবেন।

        ব্রতকথা- শ্রীহরি নামেতে এক ছিল যে ব্রাহ্মণ।নিত্য ভিক্ষা করি করে উদর পূরণ॥দিবা রাত্র কৃষ্ণনাম জপে অকপটে।অন্তরে সদাই সুখী অন্ন নাহি পেটে॥হেনকালে তার এক পুত্র জন্মিল।পুত্রমুখ দেখি দ্বিজ বিষাদে ভাসিল॥ভিক্ষা করি দ্বিজসেবা পুত্র রক্ষা করে।সুমঙ্গল বলি নাম রাখিল পুত্রেরে॥অত্যন্ত মেধাবী পুত্র সবে গুন গায়।অল্পদিন মধ্যে শিশু শিখে সমুদয়॥শাস্ত্র আলোচনা করি শাস্ত্রজ্ঞ হইলো।পন্ডিত বলিয়া তাকে সকলে জানিলো॥মনে মনে সমঙ্গল হরিকে ডাকিল।গৃহ ছাড়ি নানা তীর্থে ঘুরিতে লাগিল॥আচম্বিতে এক স্থানে করিল শ্রবণ।পিত-মাতা পরলোকে করেছে গমন।।শুনি তাহা গয়াধামে করিয়া গমন।বিষ্ণুপাদ-পদ্মে শিশু করিল অর্পণ॥কালবশে ঘটে যাহা কে করে খণ্ডন।শনির দৃষ্টিতে পরে দ্বিজের নন্দন॥ভ্রমিতে ভ্রমিতে দ্বিজ যায় বহুদূরে।শেষে উপস্থিত হয় বিদর্ভ নগরে॥রাজার সভায় দ্বিজ উপস্থিত হইলো।ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা অভ্যর্থনা করিলো॥রাজার নিকটে দ্বিজ দেয় পরিচয়।সুমঙ্গল নাম মোর ওহে মহাশয়।।অতি দুঃখী হই আমি নাহি পিতা-মাতা।নানা দেশ ভ্রমি আমি থাকি যথা তথা॥শ্রীবৎস রাজন বলে, চিন্তা দূর কর।আমার আশ্রয়ে থাকি মোর কৃপা কর॥শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত তুমি বুঝি অনুমানে।শাস্ত্রপাঠে তুষ্ট কর সভাসদগনে॥দুই পুত্র আছে মোর শুন'হে ব্রাহ্মণ।পড়াইব তব কাছে করিয়াছি মন॥রাজার বাক্যতে দ্বিজ সন্তুষ্ট হইলো।রাজার আশ্রয়ে বাস করিতে লাগিলো॥দুই রাজপুত্রে দ্বিজ অতি যত্ন করে।নিত্যই পড়ায় দ্বিজ রাজার কুমারে॥এইরূপে কিছুদিন বিগত হইল।পড়ুয়া বেশেতে শনি উপস্থিত হইল॥শনিরে জিজ্ঞাসে দ্বিজ, শুনো বাছাধন।কিবা হেতু হেথা তব হয় আগমন॥শনি বলে, এনু শাস্ত্র অধ্যয়ন তরে।দ্বিজ বলে, যত্ন করে পড়াব তোমারে॥অল্পদিন মধ্যে শনি সুপন্ডিত হইলো।সুমঙ্গল পরিচয় জানিতে চাহিল॥শনি বলে, পরিচয় জীব দিবো আর।শনৈশ্চর নাম মোর সূর্যের কুমার॥সুমঙ্গল বলে যদি দেখা দিলে মোরে।কিসে দুঃখ দূরে যাবে বল হে আমারে॥আমার উপরে আছে তোমার কটাক্ষ।কিসে যাবে বল প্রভু হইয়া স্বপক্ষ॥শনি বলে, ভোগকাল ছয় মাস আছে।দশদণ্ড মধ্যে যাবে না আসিবে কাছে॥সপ্তম দ্বিবসে গিয়া ভাগীরথীর তীরে।একান্ত মনেতে দ্বিজ ভজে মুরারীরে॥এত বলি শনিদেব অন্তর্ধান হইলো।সুমঙ্গল আর তার দেখা না পাইলো॥শনি আজ্ঞামতো দ্বিজ গিয়া গঙ্গাতীরে।নারায়ণে ভজে দ্বিজ একান্ত অন্তরে॥দশদণ্ড পূর্ণ হইলো মনেতে বিচারি।উঠি দাঁড়াইল দ্বিজ বলিয়া শ্রীহরি॥কিন্তু দশদণ্ড পূর্ণ না হয় তখন।তার পূর্বে চলে আসে আপন ভবন॥তাহা দেখি শনিদেব কূপিত হইলো।দুই রাজপূত্রে শনি হরণ করিল॥পুনঃমায়া বলে দুই শিশু মুণ্ড গড়ি।দ্বিজর নিকটে শনি যান তাড়াতাড়ি॥হেথা দ্বিজ চক্ষু বুঝি শ্রীহরিরে স্মরে।মুণ্ড দুটি ফেলে তার ঊরুর উপরে॥হেথা নিদ্রা যোগে রাজা দুঃস্বপ্ন দেখিলো।পাত্র মিত্র লয়ে রাজা গঙ্গাতীরে গেলো॥দেখিয়া দ্বিজের কোলে পুত্র মুণ্ডদ্বয়।হাহাকার করি রাজা ধুলায় লুটায়॥রাজাদেশে দূতগণ বাঁধে ব্রাহ্মণেরে।শৃঙ্খলে বন্ধন করি রাখে কারাগারে॥কারাগারে বসি দ্বিজ কাঁদিতে লাগিল।বিপদহন্তা মধুসূদনে স্মরিতে লাগিল॥অতঃপর ঘটে এক বিচিত্র ঘটন।দশদণ্ড বেলা পূর্ণ হইল যখন॥শোকেতে কাতররাজ ছিল যেখানে।হেনকালে দুইপুত্র আসিল সেখানে॥রাজা বলে, কথা ছিলে হৃদয়ের ধন।শয্যা পরে ছিনু পিতা করিয়া শয়ন॥পুত্রদের বাক্যে রাজা আশ্চর্য হইলো।আদ্য অন্ত কিছু তার বুঝিতে নারিল॥ব্রাহ্মণের কথা এবে পড়ে গেল মনে।না বুঝিয়া কত কষ্ট দিনু সে ব্রাহ্মনে॥রাজাদেশে দুটি গিয়া অনিল বিপ্রেরে।জীর্ণ শীর্ণ কলেবর কাঁদেন কাতরে॥বিনয় বচনে রাজা করে তার স্তুতি।সব অপরাধ ক্ষমা কর মহামতি॥কৃপা করি কর মন সন্দেহ ভঞ্জন।তব ক্রোড়ে কার মুণ্ড করেছি দর্শন॥দ্বিজ বলে, মহারাজ কিছুই না জানি।শনি কোপে কষ্ট পাই এইমাত্র মানি॥রাজা বলে যদি পাই শনির দর্শন।ষোড়শোপচারে তাঁর করিব পূজন॥নৃপবাক্য শুনি দ্বিজ করিল গমন।শনির নিকটে সব করে নিবেদন॥শুনিয়া সব কথা শনিদেব এলো।শনিদেবে দেখি রাজা প্রণাম করিল॥রাজা বলে যদি প্রভু এল কৃপা করে।পূজার বিধান তবে বলো প্রভু মোরে॥শনি বলে, পূজাবিধি শুনহে রাজন।যেরূপে করিবে মোর পূজা আয়োজন॥শুদ্ধভাবে শুদ্ধমনে আমার বারেতে।করিবে আমার পূজা একান্ত মনেতে॥নীলবস্ত্র কৃষ্ণতিল আর তৈল দিবে।মাষকলাই আর মোষ সংগ্রহ করিবে॥কৃষ্ণবর্ণ ঘটে এক করিয়া স্থাপন।পঞ্চজাতি ফল-ফুলে করিবে অর্চন॥এই মোর পূজা বিধি করিলাম সার।ভক্তিই প্রধান জেনো কি কহিব আর॥পূজা শেষে ভক্তিভরে করিবে প্রনাম।নবগ্রহ স্তোত্র পাঠে লইবেক নাম॥আমার প্রসাদ খাবে করিয়া যতন।সর্বপাপ দূর যাবে আমার বচন॥অভক্তি করিয়া যেবা প্রসাদ খাইবে।অল্পদিনে শমনের ভবনে সে যাবে॥আমার পূজায় যেবা করে অনাদর।চিরকাল দুঃখ পেয়ে হইবে কাতর॥এতো বলি শনিদেব হন অদর্শন।ভক্তিভরে করে রাজা শনির পূজন॥প্রতি শনিবারে পূজা করে নৃপবর।বিপ্রগনে দান দিয়া তুষিল বিস্তর॥নৃপ-পাশে সুমঙ্গল বিদায় লইয়া।শনিদেবে পূজা করে গঙ্গাতীরে গিয়া॥এইরূপে পূজা প্রচারিল শনিদেবে।যাহার যেমন সাধ্য সেভাবে পুজিবে॥শনির মাহাত্ম্য যত কে বর্ণিত পারে।কিঞ্চিৎ রচিত হলো শনিদেবের বরে॥সর্বদা শনির পদ থাকে যার মনে।উদ্ধারে বিপদ হতে পড়িলে শমনে॥শনির পাঁচালি যেবা রাখিবে ভবনে।কখনও না পড়ে বিপদ বন্ধনে॥শনি প্রণমিয়া যেবা নিজ কার্যে যায়।সমাদর করে তারে রাজার সভায়॥স্কন্দ পুরাণের কথা অন্যথা না হয়।যথাবিধি ব্যাসবাক্য কভু মিথ্যা নয়॥শুদ্ধাশুদ্ধ জ্ঞানহীন বলে নিবারণ।ভূমিতে লুটিয়া বন্দী শনির চরণ॥এতদূরে এই গ্রন্থ সমাপণ করি।শনৈশ্চর প্রীতে সবে বলো হরি হরি॥

                                            --- অথ শনিদেবের ব্রতকথা সমাপ্ত ---  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ