গয়া-গঙ্গা-প্রভাষাদি-কাশী-কাঞ্চি কেবা চায়।কালী কালী কালী বলে আমার অজপাজতি ফুরায়।
বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা।এখানে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী।গোমতী নদীর তীরে উদয়পুরে জাগ্রত এই সতীপীঠ দশমহাবিদ্যার অন্যতম বলে স্বীকৃত।৫১ পীঠের এক পীঠ।পীত নির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী ত্রিপুরায় দেবীর ডান পা পড়েছিল।ত্রিপুরায়ং দক্ষমাদ দেবী ত্রিপুরসুন্দরী ভৈরব স্ত্রীপুরুষেশ্য সর্বাভীষ্ট প্রদায়ক।
ত্রিপুরার উদয়পুর শহর থেকে চার মাইল দূরে একটি টিলার ওপর ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির।সারাবছর অসংখ্য পুর্ণার্থী এখানে দেবী দর্শনে আসেন।
মা সবসময় জাগ্রত।ত্রিপুরাবাসী এমনকি সনাতন ধর্মের সকল মনস্কামনা পূরণ করে।শুধুমাত্র ত্রিপুরা নয় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন ও অতি ভক্তিভরে পুজো দেন।একাংশের মতে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে বৌদ্ধ প্রভাব সুস্পষ্ট।বৌদ্ধ প্যাগোডার মতো মন্দিরের চারটি চালা কিন্তু পূজার বেদী বৃত্তাকার।
ইতিহাস বলে ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য স্বপ্নাদেশ পেয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে দেবীকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন।সেই তথ্য উজ্জ্বল হরপে লিপিবদ্ধ।এই মন্দির ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত।এখানে সতীর ডানপায়ের গোড়ালি পড়েছিল।১ মিটার ৫৭ সেন্টিমিটার তার উচ্চতা।ষোড়শী কালী মূর্তি গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের মালা।
দেবীকে চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরায় আনার কাহিনীটিও চমকপ্রদ।প্রথমে বিষ্ণুমন্দির তৈরী করিয়েছিলেন রাজা ধনমানিক্য।মন্দির কিছুটা তৈরী হওয়ার পর রাজা স্বপ্ন দেখলেন।তাঁকে দেবী এসে বলছেন "চট্টগ্রামের সদর ঘাটের এক বৃক্ষের মুলে আমি অধিষ্ঠিত রয়েছি, সেখানে মগেরা আমাকে পুজো করে।আমাকে উদ্ধার করে তোমার নতুন মন্দিরে বসাও"।এমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে তৎপর হোন রাজা ধনমানিক্য।তারপরেই বিষ্ণুমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী।
এখানে একটি শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত আছে।প্রতিদিন এখানে পুজো হয়।একটি শাক্ত ও আরেকটি শৈব।দুটো শক্তির মিশ্রণ এখানে।তাই খুবই শক্তিশালী।নারায়ণ ও নারায়ণী একই আসনে রয়েছেন ৫১ পীঠের এই পীঠে।চট্টগ্রাম থেকে আনা এই বিগ্রহ কতদিনের পুরোনো কেউ তা জানে না।উদয়পুরে আনার আগে চট্টগ্রামে কবে এই মূর্তি তৈরী হয়েছিল তার উত্তর আজও অধরা।
চট্টগ্রাম ইতিবৃত্ত নামক এই গ্রন্থে এই বিগ্রহ প্রাপ্তির আরেকটি কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে।তাতে বলা হয় এক ধোপার গরু ছিলো কামধেনু।ওই কামধেনু নির্দিষ্ট সময়ে জঙ্গলে যেতো।একদিন ধোপা কামধেনুর পেছন পেছন গিয়ে দেখলেন সে শিবলিঙ্গের উপর দুগ্ধধারা বর্ষণ করছে।শিবলিঙ্গের পাশেই একটি দেবী মূর্তি।গভীর জঙ্গলে এমন অভাবিত দৃশ্যের দর্শন পেয়ে ধোপা ব্রাহ্মণ ডেকে মূর্তির পূজা করান।
তান্ত্রিক মতে এখানে পুজো হয়।ষোড়শ মায়ের জিহ্বা লুপ্ত এই মা মায়াশীল মুক্তি এবং কোস্টিক পাথরের।যেহেতু দেবীপীঠ তাই এখানে বলিপ্রথা প্রচলিত।বহুপ্রাচীনকাল থেকে এখানে বলিপ্রথা চলছে।বিশেষ করে উপজাতি অংশের মানুষ এই প্রথায় খুব বিশ্বাসী।একমাত্র দশমী তিথি ছাড়া প্রতি মাসে দুটি দশমী তিথি থাকে ওই তিথি গুলি ছাড়া প্রত্যেকদিনই বলি হয়।প্রতি অমাবস্যায় ১টি মহিষ ও ৫টি পাঁঠা এবং দীপাবলিতে ২টি মহিষ ও ১০টি পাঁঠা বলি হয়।
ত্রিপুরাসুন্দরী দশমহাবিদ্যার ষোড়শী দেবী।চন্দ্রের ষোড়শ কলার সঙ্গে তাঁর রূপের তুলনা।শোনা যায় এমন সুন্দর্যময়ী দেবীর সামনে একসময় নরবলির ব্যবস্থা ছিল।
অতীতে মহারাজাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল এই ত্রিপুরা।দীর্গ ১৩০০ বৎসর এখানে রাজ্ করেন ত্রিপুরা রাজারা।আগরতলার প্রাণকেন্দ্রের রাজপ্রাসাদ ত্রিপুরাবাসীর ঐশ্বর্য আজও বহন করে নিয়ে চলেছে।এই প্রাসাদ থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছেন মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী আর এই ত্রিপুরা রাজাদের কুলদেবী ছোটমা।
ত্রিপুরাসুন্দরীর গর্বগৃহে রয়েছেন রাজবংশের কুলদেবী ছোটমা।২ফুট লম্বা চতুর্ভুজা মূর্তি সবসময় বস্ত্রখন্ডে আচ্ছাদিত থাকে।ত্রিপুরার আরেক রাজা কল্যাণমানিক্য জলকষ্ট দূর করতে মন্দিরের সামনেই একটি বোরো দীঘি খনন করান।ওই দীঘি কল্যাণসাগর নামে পরিচিত।শিলালিপি অনুযায়ী এই কল্যাণমাণিক্য দীঘি খনন করার সময়ই ছোটমায়ের এই মূর্তি লাভ করেন।প্রচলিত বিশ্বাস এই ছোট মা-ই প্রকৃত ত্রিপুরেশ্বরী।কারণ মূর্তিটি বেশ প্রাচীন।
যেকোনো শুভ কাজের সূচনায় প্রথম পুজো পায় দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী।মায়ের পুজোর প্রধান উপকরণ হলো প্যাড়া।এই প্যাড়ার বিশেষত্ব হলো ভারতবর্ষের কোথাও পাওয়া যায় না।এই প্যাড়ার স্বাদ এবং আকার অন্যান্য প্যাড়ার তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা।
অপার বিশ্বাস নানারকম জনশ্রুতি।ইতিহাস পুরাণ আর লোককথার মেলবন্ধনে এক অসাধারণ তীর্থ এই ত্রিপুরেশ্বরী। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ এখানে আসেন এবং ভক্তিভরে মায়ের পুজো দেন।এখানে এখনো গরুর প্রথম দুধ মা কে দেওয়া হয়।হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই মা কে বাড়ির গরুর প্রথম দুধটা দিয়ে যায়।
সন্ধে হলেই শুরু হয় মায়ের সন্ধ্যাআরতি।কালী নামে ডুব দেয় চরাচর।
0 মন্তব্যসমূহ