বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খন্ড সীমানার কাছে নলহাটি শহর আর এখানেই বিরাজ করছেন দেবী নলাটেশ্বরী।
অতীতের নলহাটি ও কালিন্দীপুর গ্রাম নিয়ে আজকের নলহাটি শহর।ছোটনাগপুর মালভূমির গন্ধ মাখা এই ভূখণ্ড বহু প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।সনাতন ভারতের আধ্যাত্বিকতার সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে যুক্ত নলাটেশ্বরী মন্দির।শক্তিপীঠের মাহাত্ম কথার সাথে জড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট কাহিনী।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পশ্চাৎপট আর রয়েছে বহু রকম জনশ্রুতি।
হাওড়া থেকে গণদেবতা এক্সপ্রেস সকাল ৬:০৫ মিনিটে ছাড়ে, সকাল ১০:৩০ মিনিটে নলহাটি, শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সকাল ৬:২৫ মিনিটে ছাড়ে, সকাল ১০:৩০ মিনিটে রামপুরহাট, শিয়ালদা থেকে মা তারা এক্সপ্রেস সকাল ৭:২০ মিনিটে ছাড়ে, দুপুর ১২:১৫ মিনিটে রামপুর হাট।রামপুরহাট স্টেশনের বাইরে থেকে অটো, টোটো বা টেম্পো ধরে নলাটেশ্বরী মন্দির।
এটি ৫১ পীঠের এক পীঠ নলাটেশ্বরী।দক্ষযজ্ঞের সময় বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে দেবীর দেহ ৫১ খন্ড হয়েছিল।তখন ৫১ খন্ডের মধ্যে একটি খন্ড এখানে পড়েছিলো এই ছোট্ট পর্বতে।পর্বতে পড়ার জন্য মা পার্বতী রূপে আবির্ভূত হোন।তারপরে পার্বতী রূপটাকে রানী ভবাণী দক্ষিণাকালী রূপে প্রতিষ্ঠা করান।সেই থেকে কালী রূপে সারাবছর পুজো হয় এবং দুর্গাপুজোর চারদিন দূর্গা রূপে পুজো হয়।
পুরাণে বীরভূমকে বলা হত কামকটি।'কা' শব্দের অর্থ মহামায়া, 'মাকটি' শব্দের অর্থ দুর্গ অর্থাৎ বীরভূমকে বলা হয় মহামায়ার দুর্গ।বীরভূম জেলায় পাঁচটি সতীপীঠ আছে এছাড়া অনেক শৈব পীঠও আছে।শাক্ত, বৈষ্ণব এবং তন্ত্রের যে মেলবন্ধন সেটা একমাত্র বীরভূমের এই পঞ্চ সতীপীঠ এবং সিদ্ধ পীঠ গুলিতেই দেখা যায়।নলহাটির পিতনির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী এটি ১৮ নম্বর সতীপীঠ।মতান্তরে, এখানে মায়ের ললাট পড়েছিল আবার কোনো জায়গায় বলা হয় শিরনালি পড়েছিল।এমনিতে বলা হয় নলহাট্টাং নলাপাতা ভৈরব যোগীশ তথা তত্রোসা কালীকা দেবী সর্ব সিদ্ধি প্রদায়িকা।এই পীঠে সবই মায়ের সবই কালীর সেই কারণে বলা হয় কালিকায়ই বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যই ধিময়ী তন্যঘরে প্রতদ্বয়া।কালী অর্থাৎ যিনি কালকে হরণ করেন সেই কালী এখানে বিরাজমান।ভক্তের মনোবাসনা তিনি পূর্ণ করে চলেছেন।
বীরভূম কথাটি এসেছে বিরাচার থেকে।এই বীরাচারের সবকটি আচার-ই এখানে পালন করা হয়।তার মধ্যে বলিপ্রথাও আছে, পঞ্চমকার দিয়ে তন্ত্রের যে সাধনা সেই সাধন পদ্ধতিও আছে।সেই কারণে মা কালীর কাছে সবাই আসে ভক্ত শিষ্য পঞ্চসতীপীঠ এই বীরভুমে।এই বিখ্যাত বীরভূমের মাটি এহানে সমস্ত ভক্ত শিষ্য তার সমস্ত মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য মায়ের দরবারে আসে।
নলহাটির ছোট্ট টিলার পূর্বে অবস্থান এই মা নলাটেশ্বরী।সিঁদুর চর্চিত এই মুখমন্ডলের ঠিক নিচের দিকে রয়েছে মহা সতীর কণ্ঠনালী।একমাত্র ভোরবেলায় মায়ের স্নান ও সিঙ্গারের সময় এই কণ্ঠনালীর দর্শন পাওয়া যায়।
প্রাচীন মায়ের মূর্তিতে চোখ বা জিহ্বা ছিল না।খ্রীষ্ট বসাক নামের এক স্বর্ণকার চোখ, ভ্রু, জিহ্বা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।মা নলাটেশ্বরী-এর নাম অনুসারে এই জায়গার নাম নলহাটি আবার মতান্তরে নল রাজাদের জন্য এই জায়গার নাম নলহাটি।বিতর্ক রয়েছে অনেক এই বিষয়ে।মন্দিরের মধ্যে যে নলা আছে তাতে যত পরিমান জল ঢালা হোক না কেন জলের উচ্চতা সবসময় সমান থাকে।এটি এখানকার এক আশ্চর্য।সতীদেহের ৫টি খন্ড বীরভূমে পতিত হয়।তার প্রমান পাওয়া যায় কালিকাপুরাণ বা চন্দ্রবীজচূড়া এই সমস্ত পুরাণ থেকে।
মূল মন্দির নির্মাণ করান নাটোরের রানী ভবাণী।মন্দিরের উত্তর দিকে রয়েছে পঞ্চমুন্ডীর আসন।১২৯৬ সালে জনৈক্য স্বামী কুশলানন্দ ব্রহ্মচারী কাশী থেকে প্রথম তারাপীঠে আসেন।সেখান থেকে নলহাটি তে এসে পঞ্চমুন্ডীর আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন।
পূরাণে যে তন্ত্রচূড়ামণি তাতে বলা হয় কামদেব ২৫৭ বঙ্গাব্দে এখানে মায়ের মন্দির শিলার দর্শন পেয়েছিলেন।মতান্তরে কেউ কেউ বলেন রামশরণ শর্মা মায়ের মন্দির নির্মাণের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।মা যেন তাকে বলছেন এই পীত ভূমিতে আমি শিলা রূপে আছি তোমরা আমার পূজার্চনা করো।তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।পুত্র লাভের আসায় তিনি হোম-যজ্ঞ করেন।পরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হয় এবং সেই পুত্র কে এখানে রাখে সেই নিয়মিত ভাবে এখানে পুজো করতো।এখানে ভৈরব হলেন যোগীশ মা হচ্ছেন শেফালিকা অর্থাৎ কালী।যোগীশ ভৈরবের সঙ্গে এখানে মা আছেন তার সঙ্গে এই পীঠে আরেকটি বিশেষত্ব সেটি হলো যে শাক্ত ও বৈষ্ণবের যে মেলবন্ধন সেটা এই পীঠে দেখা যায়।বলা হয়, যোগিস ভৈরবের মন্দিরে ভিত্তিপত্র স্থাপনের জন্য মাটি খনন করা হচ্ছিলো সেই সময় বিষ্ণু পাদপদ্ম এখানে পাওয়া যায়।সেই বিষ্ণু পাদপদ্মে রোজ এখানে পুজো করা হয়।
ষোড়শ শতকে আকবরের সময়ে যে আবুল ফজল তাঁর সভাকবি ছিলেন।সে যে বই লিখেছিলো সেই বই-এ এই তীর্থের নাম আছে এখানে প্রস্তর খন্ডের মধ্যে সতীমা, দেবী কালীকা, পার্বতী বিভিন্ন নামে ছিলেন।এই স্থানে একটি বড়ো বট গাছ ছিল।সেই গাছে একটি মৌচাক ছিল।সেখান থেকে সবসময় মধু পড়তো।এই জিনিসটি আবিষ্কার করেন রামশরণ শর্মা।তারপর থেকেই এই মন্দিরে পুজো হতো।
প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর প্রস্তর বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়।ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই মন্দির ভক্তদের জন্য খোলা থাকে।মায়ের জন্য প্রতিদিন অন্নভোগ হয়।নলাটেশ্বরী মন্দিরের অতীত ইতিহাস বর্তমান সবকিছুর সঙ্গে পঞ্চমকার সাধনা ও তন্ত্রের গুচ্ছযোগ রয়েছে।আজও বিশেষ বিশেষ তিথিতে মন্দির প্রাঙ্গনে হোম-যজ্ঞ, বলির ধুম লাগে।অসময়ের আধার ঘোচাতে মন্দির প্রাঙ্গনে জ্বলে ওঠে হোমের অগ্নিশিখা।
বর্তমান মন্দিরে আধুনিকতার ছাপ লক্ষণীয়।সন্ধ্যে হলেই মন্দির সেজে ওঠে রঙিন led আলোয়।মাতৃনামে মুখোর নলাটেশ্বরী মন্দির।
0 মন্তব্যসমূহ