"ধর্মক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্রে সমবেতা জুজুৎসভা, মামকাঃ পাণ্ডবস্চইবা কিমকুর্বতু সম্ভব"- ধৃতরাষ্টের এই জিজ্ঞাসায় শুরু হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।দিল্লী পেরিয়ে আসতে হয় আরো এক ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র পানিপথ আর পানিপথ পেরিয়েই কুরুক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়।ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক এই দুই যুদ্ধক্ষেত্র বর্তমানে হরিয়াণা রাজ্যের অংশ, কৃষি এখানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি।এই মাটিতেই লুকিয়ে রয়েছে নানান পৌরাণিক কাহিনী।আধুনিক কুরুক্ষেত্র শহর এখন বেশ ঝাঁ চকচকে।প্রসস্থ রাস্তাঘাট।মাঝেমধ্যেই পথের নানান জানান দেয় এটি শ্রীমদ্ভাগবতগীতার ভূমি।
সতীর দেহত্যাগের পর শিবের প্রলয় নাচন এবং তারপর সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ খণ্ডিত হয়ে ৫১টি তৈরী হয়।তেমনই একটি শক্তিপীঠ হলো কুরুক্ষেত্র।এখানে ভদ্রকালীর অধিষ্ঠান।পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর ডান পা পড়েছিল।মন্দিরের মূল ফটোক দিয়ে ঢুকলে সামনেই রয়েছে কুণ্ড।এই কুণ্ডেই রয়েছে সতীর শিলারূপী ডান পা।কুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে পঞ্চপাণ্ডবের মানত করা ৮টি ঘোড়া।
মূল মন্দিরের উচ্চতা ১০৮ ফুট।দুপাশে রয়েছে ৭০ফুট উঁচু আরো ২টি মন্দির।মূলমন্দিরে যেমন দেবী ভদ্রকালীর অধিষ্ঠান তেমনি তাঁর দুপাশে রয়েছেন শক্তির আরও দুই প্রকাশ মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী।এরা প্রত্যেকেই চতুর্ভুজ সমন্বিতা।প্রাচীন মন্দিরের দরজা ছাড়া বাকি অংশের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই।বছর ১৫-১৭ আগে সম্পূর্ণ নতুন করে মন্দির তৈরী করা হয়।মন্দিরের মূল ফটোক দিয়ে ঢুকলে সামনেই রয়েছে কুণ্ড।কথিত আছে এই কুণ্ডের জলেই রয়েছে সতীর শিলারূপী ডান পা।তাকে ঘিরে রয়েছে পঞ্চপাণ্ডবের দান করা ৮টি ঘোড়া।আজও বহু মানুষ মনোস্কামনার ঘোড়া রেখে যায় কুণ্ডের পাশে।এর পাশেই রয়েছে রাজা হর্ষবর্ধনের আমলের এক ত্রিশূল।এখানে মানত করে সুতো বেঁধে দিয়ে যান ভক্তরা।
মূল কুণ্ডের সামনে রয়েছে একটি বটগাছ।কথিত আছে যে এই বটগাছের নিচে মস্তকমুণ্ডন হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের।সেই কথা মনে রেখে আজও অনেকে আসেন মানত করে মস্তকমুণ্ডন করতে।
মূল মন্দিরে রুপোর সিংহাসনে ভদ্রকালীর অধিষ্ঠান।তিনি চতুর্ভুজা, লোন জিহ্বা, সবারুড়া, স্বরূপি শিবের ওপর দাঁড়িয়ে।
৫১টি সতীপীঠের অন্যতম কুরুক্ষেত্রের ভদ্রকালী।এখানে দেবীর নাম সাবিত্রী ও শিব স্থানু নামে প্রতিষ্ঠিত।দেবীর দেন পায়ের গোড়ালী পড়েছিল এখনই একটি কুঁয়োতে।দেবী এখানে জলমান অবস্থায় অবস্থান রত।কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের নিয়ে এখানে এসেছিলেন দেবীর কাছে যুদ্ধ বিজয়ের আশীর্বাদ প্রাপ্তি হয়ে।জয়লাভ করেছিলেন পাণ্ডবরা পরবর্তীকালে ঘোড়া দান করেছিলেন দেবীকে।
মা শক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সন্তানের কল্যাণ করে।জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ মৃত্যুকালে যিনি সন্তানের কল্যাণ করেন তিনি ভদ্রকালী।মৃত্যুকালে কোল পেতে তিনি সন্তানকে ধারণ করেন।তাই চিতার ওপর তার প্রকাশ।সমস্ত শক্তি মন্ত্রে ভদ্রকালীর উল্লেখ রয়েছে।"জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রকালী কপালিনী" আবার সরস্বতী মন্ত্রে পাওয়া যায় "সারাসত্বই নমঃ নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমঃ নমোহ"।
দিনভর মন্দিরে ভক্তসমাগম ও পুজোর সাথে সাথে চলে মন্দির প্রদক্ষিণ।শনিবার দেবীর পুজো ও ভান্ডারার আয়োজন করা হয়।মন্দিরের পাশেই রয়েছে দৈপায়ন কুণ্ড।বর্তমানে সেই নতুন করে তৈরী হয়েছে।এই কুণ্ডের ধরেই বসে ভান্ডারা।
এই মন্দিরকে ঘিরে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো নবরাত্রি।এই সময় শোভাযাত্রার মাধ্যমেদেবীর চলন্তা মূর্তিকে মন্দিরের বাইরে বের করে আনা হয়।সেই শোভাযাত্রায় থাকে ৫১০০টি কলস, ১১০০ ঝান্ডা, ৫২টি রুপোর ত্রিশূল এই ৫২টি ত্রিশূল ৫২টি শক্তিপীঠের প্রতীক।৫০৫টি রুপোর থালা সাজিয়ে দেবীর আরতি হয়।
এই পিঠের ভৈরব স্থানু।তার মন্দিরটি মূল মন্দিরের থেকে দূরে অবস্থান করলেও এই মন্দিরের মধ্যেও আরেক শিবের অধিষ্ঠান।স্থানীয়রা বলেন এই লিঙ্গ স্পর্শ করলে কপালে তিলক এবং বেষ্টনকারী সর্পের অনুভূতি পাওয়া যায়।এর সামনেই রয়েছে চক্রব্যূহ যে চক্রবুহ্যের কাহিনীর প্রেক্ষাপটে রচিত অভিমুন্যু বধের অধ্যায়।তারই একটি নকশা এখানে রয়েছে।
যেকোনো পীঠস্থান দর্শন করলে জন্মান্তরের পাপ-কর্মফল ক্ষয় হয়।এখানের দেবীর কাছে কোনো প্রার্থনা করলে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়।পীঠস্থান দর্শন ও স্পর্শ করলে সুখ-সমৃদ্ধি--সোভাগ্য বৃদ্ধি হয়।এটাই মায়ের পীঠস্থানের মাহাত্ম্য কথা।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নারীদের অধিকারের কথা প্রচার না করেও এক বিপ্লব ঘটিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।এটাই হয়তো ভারতের একমাত্র শক্তিপীঠ যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় যিনি আরতি করেন তিনি মহিলা।আপাত ভাবে ঘটনাটি খুব বিশেষ মনে না হলেও এর তাৎপর্য গভীর।প্রতি সন্ধ্যায় পঞ্চ প্রদীপ, উম্পুন,চন্দন, আতর, চামর, ঝান্ডা এবং জলশঙ্খ দিয়ে দেবীর আরতি করা হয়।তখন গম গম করে ওঠে গোটা মন্দির চত্বর।
0 মন্তব্যসমূহ