দেওঘরের বৈদ্যনাথধাম ৫১ সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ

 


দেওঘর অর্থাৎ দেবতার ঘর।দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম দেওঘরের এই বৈদ্যনাথধাম বিশেষ পরিচিত হয়ে আছে শৈব তীর্থ হিসেবে।বাবা বৈদ্যনাথ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের এক অসামান্য রূপ।এই রূপ প্রত্যক্ষ্য করতে সারা বছর দেওঘরে পুণ্যার্থীর ভিড় লেগে থাকে।ভগবান শঙ্করের জ্যোতির্লিঙ্গে গঙ্গাজল ও ফুল অর্পণ করলে মনোস্কামনা পূর্ণ হয়।এই বিশ্বাস নিয়ে একবার নয় বারবার ছুটে আসে অনেকেই।দেওঘরের বৈদ্যনাথ অনেক নামে পরিচিত।কমোদুলিঙ্গ, কামনালিঙ্গ, রাবনেশ্বর মহাদেব, মার্গলিঙ্গ, বামদেব, বৈজনাথ আরো কত কী।

    হাওড়া দিল্লী ভায়া পাটনা রেলপথে প্রথমে জোসিডি সেখান থেকে সড়কপথে আধঘন্টা গেলেই বাবাধাম দেওঘর।তবে দেওঘর শুধু বাবার জায়গা নয়।

    এখানেই বিষ্ণু চক্রে খণ্ডিত সতীদেহের হৃদয় পড়েছিল।সতী আর শিবের সহাবস্থানে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপীঠ এই দেওঘর।দেবী পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, বিষ্ণু কর্তৃক খণ্ডিত সতীর হৃদয় এই দেওঘরেই পড়েছিল।শুধু তাই নয় দেওঘরের মাটিতেই সতীর শেষকৃত্য করেছিলেন ভগবান শ্রী বিষ্ণু।

    বাবা বৈদ্যনাথধাম একটি মহাপীঠ।যার পৌরাণিক নাম ছিল চিতাভুমি।সতীর হৃদয় পড়ার পরে যুগ যুগ ধরে সতীর হৃদয় এখানে ছিল।আর চিতাভুমি বলা হয় কারণ ভগবান বিষ্ণু সতীর দাহ সংস্কার এখানে করেছিলেন।এই পুরো ক্ষেত্র শ্মশান ছিল।

    দেবী এখানে জয়দুর্গা।মাত্র ৫ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত কালো পাথরের শিবলিঙ্গ তাঁর ভৈরব বৈদ্যনাথ।সতীর হৃদয় পড়েছিল বলে দেওঘরের আরেক নাম হৃদয়পীঠ বা হার্দপীঠ।এটি জ্যোতির্লিঙ্গের সাথে সাথে শক্তিপীঠও।আর এই শক্তিপীঠ জ্যোতির্লিঙ্গের আগে।৫১ সতীপীঠের মধ্যে মূল যে অঙ্গটি হয় হৃদয় তা এখানে পতিত হয়েছিল।

    দেওঘরে বৈদ্যনাথ মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে দেবী জয়দূর্গার মন্দির।কথিত আছে, রাবনের হাত থেকে শ্রীবিষ্ণু শিবলিঙ্গ নিয়ে এসে সতীর হৃদয়পীঠে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তাই এই স্থান হরিহরের মিলনক্ষেত্র।



    "বৈধ্যনাথে হৃদয়, ভৈরব বৈদ্যনাথ দেবীদাহে জয়দুর্গা সর্বসিদ্ধি সার"- অন্নদামঙ্গলের এই ধারাতে স্পষ্ট দেওঘরের সতীপীঠের মাহাত্ম্য।দেবী এখানে জয়দুর্গা নাম পরিচিতা।

হৃদয়ের উপরেই শিবলিঙ্গের স্থাপনা হয়েছিল।তাই এখানে শিব এবং শক্তির একসাথে পুজো হয়।তন্ত্র পুজোও হয় এখানে।তন্ত্র পুজোর যত নিয়ম রয়েছে সব এখানে পালন করা হয়।মায়ের সমস্ত পূজা মায়ের গর্ভগৃহে হয়।সাধক বামাখ্যাপাও এখানে এসে সাধনা করেছিলেন।


    এখানে দেখা যায়, বৈদ্যনাথ ও পার্বতী মন্দিরের মাথায় গাঁটজোড়া বাঁধা আছে।পুরাণমতে ফাল্গুনমাসে কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশী তিথিতে শিব সতীর বিয়ে হয়েছিল।সতীর দেহত্যাগে শিব উদাসী হন।কিন্তু শ্রী বিষ্ণু সতীর হৃদয়ে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করায় আবার দুজনের মিলন হয়।সেকারণেই বৈদ্যনাথ ও পার্বতী মন্দিরের শিখর লালডোরি দিয়ে বাঁধা।এ হলো শিব পার্বতীর বৈবাহিক বন্ধনের স্মৃতিচিহ্ন।এখানে শিব ও পার্বতীর মধ্যে যে গাঁটবন্ধন রয়েছে তা ভারতবর্ষের কোনো শক্তিপীঠে নেই।


    অন্যান্য সতীপীঠে দেবীর প্রাধান্য বেশি হলেও বৈদ্যনাথে ব্যতিক্রম।এখনই ভৈরব-ই প্রধান।শিব পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, সতীর হৃদয় যে চিতায় দগ্ধ হয়েছিল তার ওপর তপস্যায় বসেন মহাদেব।তপোবলে জাগিয়ে তোলেন সতীর প্রেম এবং নিজে হন উন্মত্ত।ভৈরবের মাধ্যমে সতীপীঠ জাগরিত হয়েছিল বলেই বৈদ্যনাথে বাবার প্রাধান্য বেশী।

    শুধু শিবপুরাণ বা দেবীপুরাণ নয় দেওঘরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণের আখ্যান।যে জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনের জন্য অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে ছুটে আসেন কথিত আছে তার প্রতিষ্ঠা রাবনের হাতে।স্ত্রী মন্দোদরীর আব্দার মেনে স্বর্ণলঙ্কায় ভগবান মহাদেবকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শৈব রাবন।সেইমতো শিব তাঁর অঙ্গ নিঃসৃত কামদুলিঙ্গ রাবনকে দেন করেন।শর্ত ছিল কৈলাশ থেকে লঙ্কা যাওয়ার পথে কোথাও সেই লিঙ্গ নামানো চলবে না।অহংকারী রাবনের শিবলিঙ্গ প্রাপ্তিতে প্রমাদ গোনেন পার্বতী।রাবন যখন শিবলিঙ্গ গ্রহণের জন্য মানস সরোবরে স্নান করতে যান দেবীর মায়ায় বারুণদেব রাবনের কান দিয়ে পিঠে প্রবেশ করেন।যাত্রাপথে রাবনের প্রস্রাবের বেগ তীব্র হয় আর তখনি ব্রাহ্মণের বেসে আসেন বিষ্ণু।

    ভগবান বিষ্ণুর হাতে শিবলিঙ্গ দিয়ে রাবন নিবৃত্তির জন্য যায় হরলাজোড়ি নামক স্থানে।অনেকের মতে এখনো সেই স্থানে রাবনের প্রস্রাব বাহিত হয়।ওখানে যাওয়ার পর রাবন অনেক সময় ধরে প্রস্রাব করতে থাকেন।সেই সুযোগে ভগবান বিষ্ণু নিজের স্বরূপে এসে এই বৈদ্যনাথকে এখানে স্থাপনা করে প্রথম পুজো করেন।

    জয়দুর্গা সতীপীঠের একেবারে উত্তরে রয়েছে ক্ষীরগঙ্গা।স্থানীয় নাম শিব-গঙ্গা।এই জলে দেবতার স্নান হয়।এই স্নান অভিষেক দর্শনে সহস্র জপের ফল মেলে এমনই বিশ্বাস।আর এই ক্ষীরগঙ্গার সন্ধ্যা আরতি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন এই দেওঘরের বুকে।



    দেওঘরের স্থান ভারতের ভৌগোলিক মানচিত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনার জলবায়ু মানুষকে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য এখানে নিয়ে এসেছে এবং এখনো নিয়ে আসে।মজার কথা হলো জ্যোতির্লিঙ্গ বৈদ্যনাথও বৈদ্যের বৈদ্য হিসেবে সমাদৃত।শিবপুরাণ মতে দেবতাদের বৈদ্য অশ্বিনীকুমারকে কঠিন ব্যাধি থেকে উদ্ধার করেছিলেন বলেই তিনি বৈদ্যনাথ।

    দেওঘর যদি দেবতার ঘর হয় যেখানে একই সঙ্গে অবস্থান করছেন শিব ও শক্তি সেইরকমই মাটি থেকে প্রায় ২৫০০ ফুট উঁচুতে ত্রিকূট পর্বতে অবস্থান করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর।ত্রিকূট অতি প্রাচীন পর্বত।রামায়ণের টুকরো টুকরো কাহিনী জুড়ে রয়েছে এই গিরিশিখরের সঙ্গে।


    আনন্দরামায়ণের থেকে জানা যায়, শ্রীরামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ বিহারের সুলতানগঞ্জে গঙ্গা থেকে কাহরে জল নেন।হেঁটে বৈদ্যনাথ মন্দিরে গিয়ে বাবার মাথায় জল অর্পণ করে তাঁরা ধর্ম-পুরাণ-মহাকাব্য সব একাকার এ গিয়েছে শিব সতীর শক্তিক্ষেত্রে দেওঘরে।৭২ ফুট উঁচু বৈদ্যনাথ মন্দিরের শীর্ষে স্বর্ণকলস।ত্রিশুলাকার পঞ্চসূলের মাঝে চন্দ্রকান্ত মণি।লোকশ্রুতি কুবেরের রাজধানী আলোকপুরী থেকে চন্দ্রকান্ত মণি এনে বৈদ্যনাথ মন্দিরের মাথায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাবন।

    মন্দিরের গর্ভদ্বারের ওপর শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫১৭ সালে রাজা পুরাণমল সর্বকামনা পূরণের জন্য শিব মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।দ্বাদশ শতকে জয়দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রত্নপানি ওঝা।বৈদ্যনাথ মন্দিরের চারটি দ্বার।পূর্বদ্বার ও উত্তর দ্বার সবচেয়ে ব্যস্ত আর পশ্চিমদ্বারটি বিখ্যাত প্যাড়া গলির দিকে।

    ভক্তি, ভালোবাসা, সংকল্প, নিবেদন এইসব নিয়েই হলো দেওঘর।সমস্ত দেবদেবীকে হৃদয়ে ধারণ করে সতীর হৃদয়েস্বর বৈদ্যনাথ এখানে বিরাজ করছেন।সেই ভৈরবের চির জাগরূপ শক্তি হলেন দেবী জয়দুর্গা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ