সতীপীঠ জ্বালামুখী

 


    তপোভূমি ভারতে মাতৃ আরাধনা হয়ে আসছে সেই আদি কাল থেকে।রেলপথ সড়কপথ পেরিয়ে ছুটে চলা শুধুমাত্র আদ্যাশক্তির টানে।হিমাচল প্রদেশের দূর পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে কাংড়া দুর্গ।এখানেই সেই মাতৃ তীর্থ যা অনির্বান শিখায় জেগে রয়েছে দেবী জ্বালামুখীর মন্দির।

    বিশ্বাস এখানে অপার বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে।পুরান মতে, এখানেই পড়েছিল মায়ের জিহ্বা।সেই জিহ্বা এখানে হাজার হাজার বছর ধরে অগ্নিশিখা রূপে জ্বলছে।এখানেই তৈরী হয়েছে মন্দির।শ্রীশ্রী জ্বালামুখী মাতার শক্তিপীঠ।

    গুপ্তযুগের কটরি পুরি আজকের কাংড়া অঞ্চল।আদ্যন্ত পাহাড়ে সাজানো হিমাচল পাহাড়ের প্রাচীন শহর।নামের মধ্যেই লুকিয়ে তার স্থান মাহাত্ম।

    যেমন কলকাতাতে আঙ্গুল, নয়নাদেবীতে নয়ন, কামাখ্যাতে মায়ের গুপ্ত অঙ্গ পড়েছিল তেমনই এখানে মায়ের জ্বলন্ত জিহ্বা পড়েছিল।জিহ্বাই জ্বালার রূপ নিয়ে এখানে অবস্থান করছেন।এই জ্বালাকে দুধ এবং পেড়া ভোগ দেয়া হয়।এই জ্বলন্ত জ্যোতির পরীক্ষা করতে বহু রাজা ও বৈজ্ঞানিক এখানে এসেছিলেন।কিন্তু সমস্ত পরিনাম ছিল নিঃসফল।


    তন্ত্র শাস্ত্র অনুসারে অগ্নিরূপে প্রকাশিতা দেবীর নাম অম্বিকা।দেবী সতীর পুত দেহের জিহ্বা যেখানে পড়েছিল সেই স্থান দর্শন করতে দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা ছুটে আসেন।মূল মন্দিরের মধ্যে সাতটি জ্যোতি রয়েছে।এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নামও রয়েছে।যেমন, বিন্দ্যবাসিনী, হিঙ্গরাজ মাতা, অন্নপূর্ণা মাতা, মুখ্য মহাকালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী।এই জ্যোতিগুলি ১২মাস ২৪ ঘন্টা হাজার সাল থেকে ঘি,তেল ছাড়াই জ্যোতিগুলি জ্বলছে।

    বিগ্রহহীন এই মন্দিরের বৈশিষ্ট আজন্ম ভারতবাসীকে শ্রদ্ধায় নত করে, ভক্তিতে আপ্লুত করে।পূজারীদের দাবী এখানে অনুভূতিতে নয় অগ্নিশিখার উত্তাপ নিয়ে মাতা সতীকে স্পর্শ করা যায় এখানে।এখানে ভক্তরাদেবী দর্শন করেন না বরং দেবী শক্তিকে আগুনের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন তারা।

    পাহাড়ের গায়ে ৪টে স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মন্দির।কারুকার্য করা শ্বেত পাথরের দেওয়াল গোটা প্রাঙ্গন পাথরে বাঁধানো।আবুল ফজলের আইনি-আকবর থেকে তিব্বতী পরিব্রাজক স্তাক স্তসনপার লেখা ভ্রমণ কাহিনী।জ্বালামুখীর পূর্ণ ব্রহ্ম জ্যোতির উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন সাহিত্যেও।



    আজ থেকে প্রায় ৬০০০ সাল আগে পাণ্ডবদের বনবাস হয়েছিল।পাণ্ডবরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে এখানে বনবাসে এসেছিলেন।তারা যখন এখানে আসে তখন এই মন্দিরের পুরোনো ভাস্কর্য পছন্দ না হওয়ায় নতু করে মন্দির স্থাপন করেন।মূল মন্দিরের চারপাশে যে মন্দিরগুলো দেখা যায় সেগুলো পাণ্ডবরা ৬০০০ সাল পূর্বে স্থাপন করেছিল।

    ধর্মের পাশাপাশি বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই মন্দির।জ্বালামুখী দর্শনে এসেছিলেন সম্রাট আকবর।কথিত আছে প্রথমে লোহার পাত দিয়ে দেবী মন্দিরের জ্বলন্ত শিখা নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।কিন্তু সেই লোহা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে অগ্নিশিখা।সুদূর দিল্লি থেকে এসে পাহাড়ী নদীর ঝর্ণার জল ধরে তিনি অগ্নিকুণ্ড ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।সেই জলাধার এখনো পর্যন্ত এখানে রয়েছে গৌরীকুন্ড নামে।জ্যোতিকুণ্ডে জল ভরতে থাকলেন কয়েকদিন ধরে।যখন জ্যোতিকুণ্ড জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো তখন মা জ্বালামুখী হাজার জ্যোতির রূপে জলে ভেসে ওঠে এবং সম্রাট আকবরকে দর্শন দেন।


    এমন অলৌকিক মাহাত্ম দেখে শ্রদ্ধায় নত হন বাদশা।জ্বালাদেবীর জন্য সোনার ছাতা গড়িয়ে দেন তিনি।মা সম্রাটের অহংকার চূর্ণ করার জন্য ছাতাটিকে পুড়িয়ে কালো করে দেন।পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিকরা বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও বলতে পারেননি এই ছাতা কোন ধাতুর নির্মিত।সেই ছাতা এখনো দর্শনার্থীদের দর্শনের জন্য রয়েছে।পূজারীদের দাবি সোনার সমস্ত গুন্ এই ছাতা থেকে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে।

    জ্বালামুখীর অনির্বান শিক্ষা নিয়ে বহু মানুষের বহু প্রশ্ন।জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী 'তুজুকি জাহাঙ্গীর' গ্রন্থে লিখেছেন ,"পাহাড়ের ঢালু গায়ে গন্ধকের একর আছে।তার উত্তাপে অগ্নিশিখার সৃষ্টি হয় এবং অনবরত তা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে"।বিজ্ঞান যাই বলুক মানুষের বিশ্বাস ও আবেগের কাছে হার মেনেছে সব যুক্তি।বিজ্ঞানীদের তরফে জ্বালামুখী মন্দিরকে সামনে রেখে একাধিকবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে।

    কিন্তু অদ্ভুত কথা হলো এই জ্যোতি রহস্য এখনো কেউ ভেদ করতে পারেনি।বৈচিত্র্য ভরা দেশে জ্বালামুখী মন্দিরও বৈচিত্রে ভরা।এখানে 'বিষ্ণুর পাদুকা' যেমন রয়েছে একই সঙ্গে রয়েছে 'গ্রন্থসাহেব'।দশম শিখগুরু গোবিন্দ সিং প্রতিদিন চন্ডীপুজো ও গন্থসাহেব পাঠ করতেন।

    সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বদলেছে মন্দিরের ভেতর বাহিরের সাজ-সজ্জা।ইতিহাস বলছে, একসময় মন্দিরের ওপর সোনার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজা রঞ্জিত সিংহ।জ্বালামুখী মন্দিরের ভেতর আছে গোরখ-টিপ্পা।নাথ সম্প্রদায়ের সাধুদের বিশ্বাস গোরখনাথজী তপস্যা করেছিলেন এখানে।গোরখ টিপ্পার ভেতর রুদ্রকুণ্ডের জল দেখলে মনে হবে তা অনবরত ফুটছে।কিন্তু আসলে ঠান্ডা।কুণ্ডের ওপর প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরলে অদ্ভুত জ্যোতি প্রকটিত হয় জল থেকে।

    যেখানেই শক্তিপীঠ সেখানেই বিরাজ করেন ভগবান শিব।হিমালয় মানেই ভগবান ভৈরবের আলয়।যেখানেই হিমালয় রয়েছে সেখানেই নাকি বিরাজকরছেন ভগবান শিব।জ্বালামুখী মনফিরের ওপর পাহাড়ের গায়ে অম্বিকেশ্বর মন্দির।



    সন্ধ্যের অন্ধকার যত গাঢ় থেকে গাঢ়ত্বর হচ্ছে ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে দেবী মন্দির।মাতারানীর দরবারে আনন্দে আত্মহারা পুণ্যার্থীরা।মায়ের নামে যে কত আনন্দ কাছ থেকে না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না।রাট ৯:৩০ তার সময় মায়ের গর্ভগৃহ থেকে আরতির প্রদীপ যাবে শয়ন কক্ষের দিকে।তারপরে বিছানার ওপরে মণিমাণিক্যে সাজানো হবে মা-কে।মন্দিরের অন্দরমহলের খবর যে দীর্ঘদিন ধরে হিমালযে পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার হিন্দু রাজাদের কুলদেবী হয়ে ওঠেন এই মাতা এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে রাজাদের দানের বিভিন্ন মণিমাণিক্য এখানে সঞ্চিত হয়েছে।এই শয়নের সময় প্রত্যেকটি মণিমাণিক্যে সাজানো হয় মা-কে।এটাই জ্বালামুখী মন্দিরের প্রচলিত রীতি।সন্ধ্যের আরতির পর প্রদীপ নিয়ে যাওয়া হয় সেজা ভবনে।মূলমন্দিরের সামনে এই সেজা ভবন মায়ের শয়ন স্থান।


    কারুকার্য মন্ডিত খাটে দেবীকে শয়ন দেওয়া হবে তার আগে সংকল্প সারেন পূজারীরা।এরপর শুরুহয় নিরাকার দেবীকে সাজানো।মনি-মুক্ত, হিরে, জহরত কী নেই মাতারানীর রাজকোশে।পার্বত্য হিমালয়ের কোলে ঘুমোতে গেলেন দেবী।শীতে যেভাবে লেপ,কম্বল গে দেওয়া হয় সেইভাবে ঢেকে দেওয়া হয় মাতারানীকে।বাইরে রাত্রি তখন অনেক হয়।ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হয় অনুপম কারুমণ্ডিত বিশাল রুপোর দরজা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ