"নগর ফিরো মনে করো, প্রদক্ষিণ শ্যামা মারে" লিখেছিলেন বাংলার সাধক কবি রামপ্রসাদ।ইতস্তত ভ্রমণকে প্রদক্ষিনে পরিণত করার পরার্মশ দিয়েছিলেন তিনি।হিন্দু ধর্মের মানসিকতার মধ্যে দুটো ক্ষেত্র দেখা যায়।প্রথমটা কাজ দ্বিতীয়টা ভাব।এই ভাবের ধারণা ভারত যেভাবে আত্মস্ত করেছে বিশ্বের আর কোনো দেশ বা সভ্যতা বোধ হয় ততটা আত্মস্ত করতে সক্ষম হয়নি।কামাখ্যার মতো মহাতীর্থে এলে ভালো করে উপলব্ধি করা যায় সেই ভাবের স্বাদ।
পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের উৎস মা শব্দের মধ্যে লুকিয়ে।মা-কে অবলম্বন করে প্রত্যেকের পরিপুষ্ট হয়ে ওঠা।মেক কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় সৃষ্টির ভান্ডার।স্নেহের সাগর হলো মা।সতীর দেহচ্ছিন্ন ৫১টি পীঠ মূলত মাতৃপীঠ রূপেই পূজিতা।মাহাত্ম্য মহত্ব ও তাৎপর্যের বিচারে কামাখ্যা অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান।এক অভিনব মহাপীঠ।
দৈত্যরাজ নরকাসুরের হাতে গড়া প্রাক জোতিষপুর আজকের এই গুহাটি শহর।দামাল ব্রহ্মপুত্রের তীরে নীলাচল পাহাড়ের চূড়ায় অভিনব সতীপীঠ মা কামাখ্যা।শক্তিপীঠ কামাখ্যা তন্ত্র সাধন ক্ষেত্র।মন্দিরের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয় তন্ত্রমতে।পন্ডিতদের পরামর্শে তন্ত্রের নিয়ম মেনেই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা।
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।দেবতাদের মধ্যে যেমন কৈলাশ আর মায়ের মধ্যে ধরা হয় যোনিপীঠ কামাখ্যা।ভক্তের কামনা যিনি পূর্ণ করেন তিনি কামাখ্যা।কালিকাপুরান অনুযায়ী এই দেবী একইসঙ্গে কামোদা, কামিনী , কামা, কান্তা, কামাঙ্গদায়িনী ও কামাঙ্গনাশিনী।পাহাড়ের চূড়ায় গুপ্ত পিঠ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃত এই কামাখ্যা মন্দির।সতীদেহের যোনি পতিত হয়েছিল বলে পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী এই পিঠের মাহাত্ম্য সবচেয়ে বেশি রহস্যময় এবং তাৎপর্যবাহী।
এখানে দেবী মূলত দর্শন দেন না।তবে দেবীকে স্পর্শ করা যায়।এই পীঠস্থানটিকে গুপ্ত পীঠ বলা হয় কারণ সতীর মূলাধার এখানে পতিত হয়েছিল অর্থাৎ মাতৃ অঙ্গ পতিত হয়েছিল।এখানে দেখার কিছু নেই একটি মুকুট দিয়ে মূল জায়গাটি ঢাকা আছে।ওই স্থানকে মহামুদ্রা বলা হয়।ওখান থেকে জল আসে।জলটা স্পর্শ করতে হয়।এহানে দেবীর কোনো মূর্তি নেই।নিরাকার রূপে মা-কে পুজো করা হয়।
বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ ছিন্নবিছিন্ন হওয়ার সময় কুব্জিকা নামক স্থানে দেবীর মূলাধার পতিত হয়।মূল মন্দিরে সোনার টোপর দিয়ে সেই স্থান আচ্ছাদিত থাকে।তার উপর দেওয়া হয় সিঁদুর আর কুন্ক।সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবের উৎস এটাই।এখন থেকেই সূত্রপাত কম-কামিনী-কামতেশ্বরী।মা কামাখ্যা এমনি এক সিদ্ধ পীঠ এখানে এসে মা-কে সাধনা করলে নিজের কামনা পূর্ণ হয়।সেই জন্যই তো মা কামাখ্যা।
যোগিনী তন্ত্র অনুযায়ী মহামুদ্রা যোনিপীঠ দর্শন ও স্পর্শ করলেই দেবঋণ-পিতৃঋণ ও মাতৃঋণ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।মায়ের মূলাধার এখানে রয়েছে।মূলাধার জাগ্রত না হওয়া অবধি কোনো সাধকের সিদ্ধি প্রাপ্তি হয় না।তাই সাধনার প্রথম স্তর ও অন্তিম স্টোরে এই স্থানের দর্শন করাটা সাধকের জন্য অতি বাঞ্চনীয়।
গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে কামরূপ মহাতীর্থ।পৌরাণিক মত অনুসারে কামাখ্যায় প্রথম মন্দির তৈরী করেছিলেন স্বয়ং কামদেব।মহাদেবের রোষে স্বামী ভস্মীভূত হওয়ার পর সাধনায় বসেন কামদেবের স্ত্রী রতি।রতির তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব কামদেবকে নীল পর্বতে যোনিমণ্ডলের ওপর পাথরের মন্দির তৈরির নির্দেশ দেন।কামদেব এই স্থানে সাধনা করে নিজের স্বরূপ ফায়ার পেয়েছিলেন তাই এই স্থান কামরূপ।ভিন্ন মতে, এখানে সবার কামনার ফলপ্রাপ্তি হয় বা বাস্তবায়িত হয় তাই এই স্থানকে কামরূপ বলা হয়।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী এই পীঠচিহ্নে মহামায়া সাধারণ নারীর মতোই ঋতুমতী হন।অম্বুবাচীর সময় মন্দির তিনদিন বন্ধ থাকে।ধরিত্রী মা সেই সময় আজস্বলা হয় বলে সবাই মনে করেন।এই সময় মায়ের গায়ে রক্তবস্ত্র দেওয়া হয়।
অম্বুবাচীর শিবরাত্রির সময় বিশাল বড় মেলা বসে।আরো এক অভিনব প্রথা চালু আছে কামরূপে।প্রতিবছর পৌষ মাসের পুষ্যা নক্ষত্র তিথিতে কামেশ্বর ও কামেশ্বরীর বিয়ে দেয়া হয়।রাজ্যের মঙ্গলের জন্য এই প্রথা চালু করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা।কালাপাহাড় কামাখ্যা মন্দির ভেঙে দেওয়ার পর কোচবিহারের রাজার উদ্যোগে আবার স্থাপিত হয়।
কিন্তু কোচবিহারের রাজবংশের সদস্যদের দেবী দর্শনের অনুমতি নেই।এর পেছনে রয়েছে এক রোমহর্ষক কাহিনী।মা সাক্ষাৎ নৃত্য করেছিলেন।সেটি গুপ্ত থাকতো পূজারী ছাড়া কেউ দেখতো না।রাজার কানে এই খবরটি যায়।রাজার মা-কে সাক্ষাৎ দেখতে ইচ্ছে হলো।এক ছিদ্র দিয়ে রাজা দেখেছিলো।মা-তো অন্তর্যামী।মা তাই রাজাকে শাপ দিয়েছিলেন।রাজা বা রাজার পরিবারের কেউ মায়ের দর্শন করতে আসতে পারবে না।
গুপ্তপীঠের সাথে জড়িয়ে এমন নানা জনশ্রুতি।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৈচিত্রে ভরা কামরূপ যথার্থ অর্থেই তীর্থচূড়ামণি।
কামাখ্যা মন্দিরের সামনেই সৌভাগ্য কুণ্ড।তীর্থযাত্রীরা স্নান, তর্পন করেন এখানেই।পাপহারিণী সৌভাগ্য কুণ্ড।কামাখ্যা মন্দিরে প্রবেশের পরে।নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখতে এই সৌভাগ্য কুণ্ডের জল স্পর্শ করতে হয়।আর এই সৌভাগ্য কুন্দের পাশেই রয়েছে দেবী কামাখ্যার নিত্যদিনের স্নানের জলের অন্যতম আরো একটি কুণ্ড।
নীলাচল পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখর যার নাম ব্রহ্ম পর্বত।পুরাণমতে এই নীলাচল পাহাড় বা শিবপাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করছেন মা কামাখ্যা।আর সেই কামাখ্যা মন্দির থেকে প্রায় ১৬৫ ফুট উঁচুতে এই ব্রহ্ম পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করছেন দশমহাবিদ্যার অন্যতম মাতা ভুবনেশ্বরী।
ছোট গোলাকার মন্দির দেখতে একেবারে সাদামাটা।দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ভুবনেশ্বরী এই মন্দির বহু প্রাচীন।কামাখ্যার মতো এখানেও মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই।ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পেছনের দিকটাই পূর্বদিক।এখন থেকে বহু দূরে বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর ও পর্বতশ্রেণী।
ব্রহ্মপুত্র দ্বীপের মধ্যে রয়েছে ঊমানন্দ ভৈরবের মন্দির।প্রতিটি সতীপীঠের সাথে জড়িয়ে আছে এক একটি ভৈরবের মন্দির।তেমনি মা কামাখ্যার ভৈরব হলেন ঊমানন্দ।ভস্যাচল পাহাড়ের চূড়ায় একেবারে ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে ভৈরব উমানন্দের মন্দির।
সারি সারি পর্বতমালা নিচে তাকালে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র।অনেক বাধা অতিক্রম করে এসেছে মানস সরোবর থেকে।তীব্র নাদে বয়ে চলেছে দেবী কামাখ্যার চরণ স্পর্শ করে।তন্ত্রের নিরিখে কামাখ্যা পীঠের গুরুত্ব অসীম।বহু সাধক এই মহাপীঠে সাধনা করে সাধন বস্তু লাভ করেন।যুক্তিবাদের যুগে আজও কামাখ্যা এক অলৌকিক জগতের স্বাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে জাগ্রত থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ