সতীপীঠ গুলো আজও পরম কৌতূহল ও অপার রহস্যের এক অমীমাংসিত যাত্রাপথ।সেই যাত্রাপথেই রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম।এই কেতুগ্রামেই অত্যন্ত সামান্য দূরত্বের মধ্যে দুটি পীঠ দেখা যায়।দুটি পীঠ ভিন্ন ভিন্ন পীঠ মাহাত্ম্যে বিরাজ করলেও আসলে পৌরাণিক ভাবে এই দুটো পীঠ যুগ্মপীঠ।পিঠ নির্ণয় তন্ত্র মতে এখানে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল।এই সতীপীঠের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসও।ঐতিহাসিকদের দাবি, পুরাকালে বহুলা মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন বৈষ্ণব পদকর্তা চন্ডীদাস।
এখানে প্রাচীন চন্ডিকা বহুলা।কেতুগ্রামের আদিনাম বহুলা ছিল বলে জানা যায়।পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে কেতুগ্রাম হিসেবে পরিচিতি হয়।সেই প্রাচীন মন্দির আজ আর নেই।নতুন করে মন্দির ও নাট মন্দির তৈরী হয়েছে।এখানেই মা বহুলার অধিষ্ঠান।
দেবী একদিকে শান্ত আরেকদিকে রুদ্র।তাই এই দেবীর মন্দির চত্বরে একদিকে যেমন দোলপূর্ণিমা উৎসব পালন হয় তেমনি দুর্গাপুজোয় মোষ বলি বা ছাগল বলির প্রচলন আছে।কথিত আছে, কবি চন্ডীদাস একসময় এই মন্দিরের পৌরোহিত্য করেছেন।এই মন্দিরের জনপ্রিয়তা, এই মন্দিরের মাহাত্ম্য এই মুহূর্তে যে জায়গায় রয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের সতীপীঠগুলির মধ্যে বহুলাক্ষী সতীপীঠের আলাদাই গুরুত্ব।
চৈতন্য পূর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা চন্ডীদাস নানুরের অধিবাসী ছিলেন।কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের একটি প্রচলিত বিশ্বাস যে চন্ডীদাস কেতুগ্রামে প্রথম জীবনে বহুলা মন্দিরের সেবায়িত ছিলেন।এই বহুলা মূর্তি দেবীর ৫১পীঠের অন্যতম।একে কেন্দ্র করে বহু জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি ছড়িয়ে রয়েছে এই পূর্ববর্ধমান জেলার আনাচে-কানাচে।
নতুন মন্দিরে কালো পাথরের এই মূর্তিটি নতুন ও পুরোনোর একমাত্র যোগসূত্র।কথিত আছে এখানেই দেবীর বাম বাহু পড়েছিল।দেবী কিরীটধারীনী চতুর্ভুজা।সম্পূর্ণ কাপড় মোড়া থাকায় দেবীর মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।তবে ধ্যান মন্ত্রে পাওয়া যায় দেবী এখানে চতুর্ভূজ।একহাতে কঙ্ক অর্থাৎ চিরুনি,অন্য দুহাতে বর ও অভয়মুদ্রা।দেবীর পশে রয়েছে কষ্টিপাথরের অষ্টভূজ গণেশ।আর গণেশ এখানে অষ্টভুজা।মায়ের নাম বহুলা।মায়ের ভৈরব ভীরুক।মায়ের প্রণাম মন্ত্র-"নমঃ বহুলায়ং চতুর্ভুজাং পতিপুত্র সমনিতাং নমস্তে ভীরুকোপত্না সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী"। এখানে ভৈরবের আলাদা কোনো মন্দির নেই।তিনি মায়ের মধ্যেই অধিষ্ঠান করছেন।একদিকে পতি-পুত্রকে নিয়ে উনি মধ্যখানে বিরাজ করছেন।দেবীর দক্ষিণ হস্ত যেদিকে আছে সেইদিকেই রয়েছে গণেশ।ভগবান বিনায়ক তিনি হলেন অষ্টভুজ।বিশেষত্ব ওনার আটটা হাত রয়েছে।যা আমাদের ভারতবর্ষে চারটি রয়েছে।উত্তরভারতে তিনটি এবং বাংলার মধ্যে একটি বহুলাক্ষী মন্দিরে।
কেতুগ্রাম থেকে ঠিক ৩কিমি দূরে বৈষ্ণব প্রধান শ্রীখণ্ড গ্রামের উত্তর দিকের ভূতনাথ লিঙ্গটিকে শ্রীখণ্ড বাসীরা বহুলার ভৈরব হিসেবে বিশ্বাস করেন।ভৈরব প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়,"নমস্তে ভীরুকায় ভূতনাথ নাম ধারিনে বহুলাক্ষী ভৈরবায় সদা ত্রিখণ্ড বাসিনে"।তন্ত্রমতে এখানে শ্রী ভূতনাথের পুজো করা হয়।গাজনের সময় হয় মহোৎসব।
জনশ্রুতি প্রাচীনকালে রাও পদবী ধারীরা এই মন্দির তৈরী করেন।বর্তমানে রায় পদবীধারী সেবায়িতরা তাদেরই বংশধর।সম্পূর্ণ ঘরোয়া মন্দির।একেবারেই আড়ম্বরহীন।এই মন্দিরের পশে ডলার দোকানের সারি বা পান্ডাদের ডাকাডাকি নেই।দিনভর বেশি লোকের আনাগোনাও নেই।
সারাবছর ধরে মায়ের পুজো লেগেই থাকে মন্দিরে।১০৮ ঘড়া গঙ্গা জল দিয়ে পুন্য স্নান গণেশকে এবং ১০৮ ঘড়া গঙ্গাজলে মা-কে পুণ্যস্নান করানো হয়।তার আগে এখানে অম্ববাচী উৎসব পালিত হয়।তার পরেই এই শান্তিসস্থান হয়।আষাঢ় মাসে বিপত্তারিণী পুজো হয়।মায়ের প্রচুর ভক্ত এখানে আসেন।মন্দিরে এখনো মহিষ বলি হয়।বলির প্রসাদকেই দৈব ওষুধ রূপে বিতরণ করেন মন্দিরের পুরোহিত।বিশেষত্ব হলো, মহিষ বলির দিন মায়ের মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে।রাতে সন্ধ্যা আরতি সীমিত ভাবে করা হয়।মহিষের মাথা সারারাত মায়ের ঘরের মধ্যে থাকে।যেটা পরেরদিন স্বপ্ন ঔষধে পরিণত হয় বলে ভক্তবৃন্দের বিশ্বাস।বিভিন্ন রজার উপশ্রম হয় ওই ওষুধে।বিনামূল্যে ওই ওষুধ সংগ্র করে নিয়ে যান ভক্তবৃন্দরা।
বহুলা মন্দির থেকে শীর্ণ পথে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গেলে পাওয়ায় যুগ্ম পীঠের আরেকটি।মরাঘাটে রয়েছে বহুলার ওপর অংশ বহুলাক্ষী রয়েছেন এখানে।শিবচরিত মতে, এখানে দেবীর ডান কনুই পড়েছিল।যদিও মতান্তর রয়েছে।তবে শিবচরিতের রণখন্ডই এখানে বহুলা।গ্রামের এক কোন মজে যাওয়া এক নদীর ধারে এই মন্দির।তবে এই মজে যাওয়া নদীও সময় বিশেষে যাতায়াতের অন্তরায় হয়ে ওঠে।
মরাঘাট থেকে স্পষ্ট এখানে আগে শ্মশান ছিল।শ্মশান প্রসঙ্গে শোনা যায়, ব্রাহ্মণ প্রধান কেতুগ্রামে ব্রাহ্মণরা নিম্ন বর্ণের মানুষের ছায়া মারতেন না।তাই এইসব নিচু জাতের মানুষের সৎকারও সম্ভব হতো না।তারা গ্রামের বাইরে এখানে এসে হয় দাহ করতেন বা নদীতে ভাসিয়ে দিতেন।তাই এই জায়গা মরাঘাট নামে পরিচিত।বহুলা মন্দির থেকে ১কিমি দূরে এই মন্দিরের অবস্থান।এখানে দেবীর কোনো মূর্তি নেই।দেবী ঘটে পূজিতা।তবে পীঠ ভৈরব মহাকাল স্বমহিমায় বিরাজমান।এভাবে আজও বহুলা ও বহুলাক্ষী যুগ্মপীঠ হিসেবে পরিচিত।
"বহুলায়ং বামবাহু বহুলাখ্যাচ দেবতা ভীরুক:ভৈরবস্তত্র:সর্ব্বসিদ্ধি প্রদায়ক"-অর্থাৎ এই দেবতার ভাণ্ডারে সমস্ত উৎসবের, সমস্ত আনন্দের, সমস্ত আতিসজ্জের চরম পর্যায়ের সমস্ত রকম অনুষ্ঠান একই সঙ্গে পালিত হয়।দোলযাত্রা থেকে শুরু করে দুর্গোৎসব, কালীপুজো-দীপাবলি থেকে লক্ষ্মীপুজো, এমনকি গণেশ চতুর্থী সবকিছুই এখানে উদযাপিত হয় মহা সাড়ম্বরে।অতি জাগ্রত এই মন্দির।তাই এলাকা বাসীর কাছে শুধুমাত্র দূর্গা-লক্ষ্মী-কালীর উপাসনার পীঠস্থান নয় আসলে এ সতীপীঠ এখানে সমস্ত ধর্মাচরণের এক আদর্শ পীঠস্থান।
সন্ধ্যেবেলা বহুলার মন্দিরে গ্রামের মহিলা ও বৃদ্ধরা এসে ভিড় জমান।শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি।
0 মন্তব্যসমূহ