বৃন্দাবন হলো ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মথুরা জেলার অন্তর্গত একটি শহর।হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে তাঁর ছেলেবেলা কাটিয়েছিলেন।শহরটি কৃষ্ণের জন্মস্থান কথিত জেলা সদর মথুরা থেকে ১১কিলোমিটার দূরে দুইনম্বর জাতীয় সড়ক আগ্রা-দিল্লী হাইওয়ের ওপর অবস্থিত।
বৃন্দাবন শহরে রাধা-কৃষ্ণের অনেকগুলি মন্দির আছে।হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে বৃন্দাবন একটি পবিত্র তীর্থস্থান।বৃন্দাবন কথাটি এসেছে বৃন্দা অর্থাৎ তুলসী বন বা অরণ্য শব্দ দুটি থেকে।বৃন্দাবনের নিধিবন ও সেবাকুঞ্জে এখনো দুটি ছোট তুলসীবন বর্তমান।
বৃন্দাবন একটি প্রাচীন শহর।বৃন্দাবনের আদি অবস্থান কোথায় ছিল তা ষোলো শতাব্দীর আগে মানুষ ভুলে গিয়েছিলো।চৈতন্য মহাপ্রভু এই স্থানের পুনঃআবিস্কার করেন।১৫১৫ সালে কৃষ্ণের বাল্যলীলার স্থানগুলি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনে এসেছিলেন।কথিত আছে, তিনি দিব্য প্রেমের আধ্যাত্মিক ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে বিভিন্ন পবিত্র বনে ভ্রমণ করেছিলেন।হিন্দুরা বিশ্বাস করেন তিনি তাঁর দৈব আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে বৃন্দাবন ও তার চারপাশে যে সকল স্থানে কৃষ্ণ তাঁর বাল্যলীলা করেছিলেন বলে মনে করা হয় সেইগুলি আবিষ্কার করেন।
হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে বৃন্দাবন একটি পবিত্র তীর্থস্থান।এটি কৃষ্ণ উপাসনার একটি কেন্দ্র।বৃন্দাবন, গোবর্ধন ও গোকুলকৃষ্ণের জীবনের সঙ্গে যুক্ত।কৃষ্ণ ভক্তেরা প্রতি বছর এই স্থানে তীর্থযাত্রায় আসেন এবং বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।ভগবৎ পুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণ গোপীদের গ্রাম গোকুলে তাঁর পালক পিতা-মাতা নন্দ ও যশোদার গৃহে পালিত হয়েছিলেন।উক্ত পুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণ বৃন্দাবনের বনে রাসলীলা ও অন্যান বাল্যলীলা করেন।তাঁর দাদা বলরাম ও অন্যান রাখাল বালকদের সঙ্গে দুস্টুমি করে বেড়াতেন।
বৃন্দাবন বিধবার নগরী নামেও পরিচিত।এই অঞ্চলে প্রায় পনেরো হাজার থেকে কুড়িহাজার বিধবা বাস করেন।এরা ভজন আশ্রম গুলিতে গান করে সময় কাটান।অবহেলিত নারী ও শিশুদের সাহায্যার্থে বৃন্দাবনে "গিল্ড অফ সার্ভিস" নামের একটি সংস্থা গঠিত হয়েছে।একটি সমীক্ষায় জানা গেছে বৃন্দাবন সরকার ও বিভিন্ন এন. জি. ও এখানে বিধবাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করে।
বৃন্দাবনের অন্যতম একটি রহস্যময় স্থান হলো নিধিবন।কথিত আছে এই বনে এখনো প্রতি রাতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপীদের সাথে লীলা করেন।কৃষ্ণের সুমধুর বাঁশির সুর শোনা যায়।
বৃন্দাবনের কয়েকটি বিখ্যাত মন্দির হলো-
১. মদন মোহন মন্দির
মুলতানের রাজা কাপুর রামদাস কালীয়দমন ঘাটের কাছে মদন মোহন মন্দিরটি স্থাপন করেন।এটি বৃন্দাবনের অন্যতম প্রাচীন মন্দির।চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের সঙ্গে এই মন্দিরটি ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত।ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে এই মন্দিরের আদি মদন গোপাল বিগ্রহটি নিরাপত্তা জনিত কারণে রাজস্থানের কারাউলিতে স্থানান্তরিত করা হয়।বর্তমানে এই মন্দিরের মূল বিগ্রহের প্রতিমূর্তি পূজিত হয়।
২. মীরাবাঈ মন্দির
নিধিবনের কাছে শাহজি মন্দিরের দক্ষিণ দিকে মীরাবাঈ মন্দিরটি অবস্থিত।এই মন্দিরটি মিরাবাঈয়ের মন্দির। কোনো কোনো জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে ১৫৪৭ সালে দ্বারোকায় মীরাবাঈ স্বশরীরে কৃষ্ণমূর্তিতে বিলীন হয়ে যান।তবে গবেষকরা এই কিংবদন্তির ঐতিহাসিকতা বিশ্বাস করেননি।তবে একথা সত্য যে মীরাবাঈ কৃষ্ণ উপাসনা নিয়েই থাকতেন এবং তার রচিত ভজনগুলি তাঁকে ভক্তি আন্দোলন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্ত কবির স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলো।
৩. বাঁকে বিহারী মন্দির
স্বামী হরিদাস নিধিবন থেকে বাঁকে বিহারী বিগ্রহটি আবিষ্কার করার পর ১৮৬২ সালে বাঁকে বিহারী মন্দিরটি স্থাপিত হয়।
৪. প্রেম মন্দির
বৃন্দাবনের উপকণ্ঠে ৫৪ একর জমির ওপর প্রেম মন্দিরটি নির্মিত।এটি প্রতিষ্ঠা করেন কৃপালু মহারাজ।মূল মন্দিরটি শ্বেত পাথরের তৈরী এবং সেখানে কৃষ্ণের বহুমুর্তি খোদিত রয়েছে।
৫. রাধাবল্লভ মন্দির
হরিবংশ মহাপ্রভু রাধাবল্লভ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।এই মন্দিরের বেদীতে কৃষ্ণের বিগ্রহের পাশে রাধার একটি মুকুট রাখা থাকে।
৬. জয়পুর মন্দির
জয়পুরের মহারাজ দ্বিতীয় শাহ ওয়াই মাধুসিং ১৯১৭ সালে রাধামাধব মন্দির বা জয়পুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
৭. রাধারমণ মন্দির
গোপাল ভট্ট গোস্বামীর অনুরোধে রাধারমণ মন্দির স্থাপিত হয়।এই মন্দিরে কৃষ্ণের একটি শালগ্রাম বিগ্রহ রয়েছে।
৮.শাহজী মন্দির
১৮৭৬ সালে লখনৌয়ের শাহ কুন্দন লাল এই মন্দিরের নকশা করেন এবং এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।এই মন্দিরটি অনন্য স্থাপত্যশৈলী ও শ্বেত পাথরের সুন্দর ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত।
৯. রঙ্গজী মন্দির
১৮৫১ সালে নির্মিত রঙ্গজী মন্দির বিষ্ণুর অন্যতম রূপ রঙ্গনাথ বা রঙ্গজীর প্রতি উৎসর্গীকৃত।এই মন্দিরে বিষ্ণু অনন্তশাহী ভঙ্গিমায় পূজিত হন।মন্দিরটি দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত।
১০. গোবিন্দদেব মন্দির
১৫৯০ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের দান করা লাল বেলেপাথর দিয়ে রাজা মানসিংহ সাততলা উঁচু গোবিন্দদেব মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।ঔরঙ্গজেব এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন।
১১. রাধাদামোদর মন্দির
১৫৪২ সালে বৃন্দাবনের সরগোস্বামী কর্তৃক সেবাকুঞ্জের রাধাদামোদর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।
১২. কাত্যায়নী মন্দির ও ভুতেশ্বর মহাদেব মন্দির
রাঙ্গনাথ মন্দিরের কাছে রাধাবাগে কাত্যায়নী মন্দির অবস্থিত।এটি একটি সতীপীঠ।কথিত আছে এখানে দেবী সতীর আংটি পড়েছিল।
১৩. চিন্তাহরণ হনূমান মন্দির
অটলবনের কাছে অবস্থিত চিন্তাহরণ হনূমান মন্দিরটি হলো হনুমানের মন্দির।
0 মন্তব্যসমূহ