সূর্যের প্রথম এল যখন পৃথিবীর বুকে লুটিয়ে পড়ে সেই মায়াবী এল গায়ে মেখেই জেগে ওঠে হিরণ-কপিলা-সরস্বতী।এই ত্রিবেণী সঙ্গমেই সোমনাথ মন্দির।সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এই সঙ্গমস্থলে স্নান করলে মোক্ষলাভ হয়।কিন্তু পুরাণে আছে এই সঙ্গমস্থল আসলে তিন পর্যায়ের রূপক অর্থাৎ হিরণ-কপিলা-সরস্বতী আসলে জন্ম-জীবন ও মৃত্যুর প্রতীক হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে যুগযুগান্তর ধরে পরিচিত হয়ে আছে।
সতীপীঠের আরো এক অন্যতম পুণ্যভূমি প্রভাসক্ষেত্র মহাতীর্থ প্রভাসক্ষেত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা জনশ্রুতি।কেউ বলেন এই পুণ্যভূমি সতীপীঠের এক পীঠ।কেউ বলেন এখানেই দাপর যুগের অবসান।নারায়ণ অবতার কৃষ্ণের মৃত্যুস্থল।শৈবদের কাছে এ আবার দেবাদিদেব মহাদেবের লীলাভূমি।এই প্রভাসক্ষেত্রেই রয়েছে সোমনাথ মন্দির।মন্দিরের মহিমা অপার।শৈব তীর্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ এই সোমনাথ মন্দির।প্রভাস পতন সোমনাথ।গুজরাটের গির নগর থেকে কয়েক কিমি দূরে সমুদ্রের পাড়ে এই জায়গা স্থান মাহাত্ম্যে সকলের কাছে প্রিয়।আর এই শক্তিপীঠের আবেদন সকলের কাছে জানা।এই শক্তিপীঠ কোথায় রয়েছে তা নিয়ে নানা বিধ মত রয়েছে।
প্রভাসক্ষেত্র, পুণ্যভূম প্রভাসক্ষেত্রের নানা মাহাত্ম রয়েছে নানান পুরাণগাঁথা।শাক্তমতে এই পুণ্যভূমিতে পড়েছিল সতীর উদর।৫১ সতীপীঠের মধ্যে প্রভাসক্ষেত্র তাই অন্যতম।
ভারতবর্ষে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ আছে।আর এই দ্বাদশ লিঙ্গের মধ্যে সোমনাথ প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ।সোমনাথ মন্দির।অপূর্ব এই মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী।শতাব্দি প্রাচীন এই মন্দিরের ওপর দিয়ে বার বার বয়ে গেছে বহু ঝড়।সম্পদ আর বৈহবের লোভে বারবার ধ্বংসের মুখে পড়েছে মন্দির।গজনির সুলতান মামুদ এই মন্দির লুঠ করে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে যান।ইতিহাসের পাতায় জানা যায় এই মন্দিরের গর্ভগৃহ হীরক ও অন্যান্য রত্নের আলোয় ঝলমল করে উঠতো।কিন্তু এতো আক্রমণের পরেও কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি এই ঐতিহাসিক মন্দির।ধ্বংসের অট্টহাসকে পরাজিত করে বন্দিত হয়েছে দেবমাহাত্ম।জয়ী হয়েছে শুভ শক্তি।
ভারত ভূখণ্ডে আধিপত্য কায়েমের জন্য একাধিকবার সোমনাথ মন্দিরকেই বেঁচে নিয়েছে লুঠেরা-রা একাধিকবার এই মন্দিরের ধনভাণ্ডার লুঠ করে নিয়ে গেছে বহিরাগতরা।ভরতবর্ষের যাত্রাভিমানে আঘাত করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এই মন্দিরকে।একাধিকবার ধ্বংসের পরেও কালের নিয়মের বাধা পেরিয়ে আবার মাথা তুলে উঠে দাঁড়িয়েছে সোমনাথ মন্দির।
সাতবার আলাদা আলাদা রাজা-মহারাজারা নির্মাণ করিয়েছিলেন।সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৩ই নভেম্বর ১৯৪৭ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন সোমনাথে এসেছিলেন পুরোনো মন্দিরের ভাবনাগুলো দেখেন এবং সংকল্প নেন তিনি এই মন্দির সংস্কার করবেন।
সুউচ্চ এই মন্দিরের সাথে কিভাবে জড়িয়ে গেছে শৈব মহিমা।কেনই বা মন্দিরের নাম হলো সোমনাথ তা নিয়েও রয়েছে নানা পুরাণকথা।কথিত আছে সমুদ্র মন্থনের সময় ১৪টি রত্ন সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসে।এর মধ্যে চন্দ্র একটি।দেবতাকূল এই চন্দ্র রূপ রত্নকে মহাদেবের হাতে সমর্পন করেন।চন্দ্র তথা শশীকে নিজের জোটে স্থান দেন মহাদেব।তাই ভোলানাথের আরেকনাম শশীভূষণ।একদিন মহাদেবজায়া পার্বতী মজা করে মহাদেবকে প্রশ্ন করেন, "যে চন্দ্র আপনার ভক্ত তার গায়ে কেন কলঙ্কের চিহ্ন"।মহাদেব তখন বলতে শুরু করলেন চন্দ্রের কলঙ্কের কাহিনী।ভগবান চন্দ্রের ২৭ পত্নী ছিলেন।এনাদের পিত ছিলেন প্রজাপতি দক্ষ।২৭ পত্নীর মধ্যে রোহিনী নামের যে পত্নী ছিল সে ব্যাতিত বাকি ২৬ জন পত্নীকে তিনি বারবার অপমান করতেন।২৬ পত্নী পিতা প্রজাপতি দক্ষের কাছে নালিশ জানায়।বারবার বোঝানোর পরও ভগবান চন্দ্র বোঝেননি।তখন প্রজাপতি শাপ দেন।এর ফলে চন্দ্রের তেজ ও কলা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং শীর্ণ হয়ে যায়।গোটা ব্রহ্মাণ্ডে অন্ধকার ছেয়ে যায়।এর ফলে গোটা ব্রহ্মান্ড ব্যাকুল হয়ে পড়ে।তখন চন্দ্রদেব প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে যান।তিনি চন্দ্রদেবকে প্রভাসের সমুদ্রপাড়ে মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে বলেন।ভগবান চন্দ্র এখানে দশহাজার কোটি মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করেন।এর ফলে মহাদেব প্রসন্ন হন এবং ভগবান চন্দ্র উদ্ধার হন।তখন মহাদেব ছোট এক শিবলিঙ্গ চন্দ্রদেবকে দিয়েছিলেন এবং সেটিকে ভূগর্ভে রেখে প্রথম মন্দির গড়ে তুলেছিলেন ভগবান চন্দ্র।মহাদেবের কৃপায় চন্দ্রের প্রভাব ফায়ার আসে।সেই থেকেই এই পূণ্যস্থান প্রভাসক্ষেত্র নামে পরিচিত।অন্যদিকে চন্দ্র বা সোম দাড়াই লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত বলে এই লিঙ্গের নাম সোমেশ্বর।
মন্দিরের স্থাপত্যকলা যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ করে আসছে দর্শনার্থীদের।স্থাপত্য-ভাস্কর্য্যে সোমনাথ মন্দির প্রতিদিনই মানুষকে অভিভূত করে আসছে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তৈরী হয়েছিল এই মন্দির।চালুক্য শৈলী অর্থাৎ চালুক্য স্থাপত্যকে অনুকরণ করেই তৈরী করা হয়েছে এই মন্দির।মন্দিরের গর্ভগৃহে ছড়িয়ে রয়েছে অপার রহস্য।সোনায় মোড়া গর্ভগৃহে ঢুকলে চোখ ধাঁদিয়ে যাবে।
মন্দিরের বাইরেই রয়েছে মহাদেবের বাহন নন্দীদেব।তাকে জড়িয়েই মনের ইচ্ছা জানান ভক্তরা।ভক্তকুলের বিশ্বাস ভক্তিভরে ডাকলে সাড়াদেন ভোলানাথ।
সোমনাথ মন্দির থেকে কিছুটা দূরেই চন্দ্রভাগ মন্দির।পূরণে যে ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলে হয়েছে যে দিক নির্ণয় করা রয়েছে তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় এই মন্দিরের অবস্থান।ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শুরু হয়ে যায় মন্দিরের পূজা।কিন্তু সেখানে বাইরের কারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ।ভোর ৪:৩০ এ শুরু হয়ে যায় আরতি।কিন্তু তা সাধারণ মানুষের জন্য নয়।এই মন্দিরের সমস্ত কাজ চালান নাগা সন্ন্যাসীরা আর তারা যতটাসম্ভব লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন।
মন্দিরের কিছুটা দূরে গৌরীকুন্ড।এরও স্থান মাহাত্ম বিশাল।পুণ্যার্থীদের বিশ্বাস এই গৌরীকুণ্ডেই পড়েছিল দেবীর উদর।মায়ের ভৈরব এখনই চক্রতুণ্ড ভৈরব নামে পরিচিত।গৌরীকুণ্ডের পাশেই তৈরী হয়েছে সপ্তঋষির আশ্রম।পুরাণমতে এখানেই দেবাদিদেব মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করে গৌরী হয়েছিলেন পার্বতী।দেবী পার্বতী এই গৌরীকুন্ডে স্নান করে নিজের গৌর বর্ণ ফিরে পান।মোট সাতটি শিবলিঙ্গ রয়েছে এই সপ্তঋষির আশ্রমে।এর মধ্যে একটি লিঙ্গে সবসময় জল ভর্তি থাকে কিন্তু এই জলের উৎস কোথায় তা এখনো রহস্যে মোড়া।
শুধু সপ্তঋষির মন্দির নয় রয়েছে মঙ্গলা, বিশালাক্ষী ও চত্বরপ্রিয়ার মন্দির।এভাবেই নানা রহস্য, নানা মাহাত্বে ভোরে রয়েছে প্রভাসক্ষেত্র।শৈব-শাক্তের মেলবন্ধনে প্রভাসক্ষেত্রের বড় মাহাত্ম।
প্রভাসক্ষেত্রের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণ মাহাত্ম।বৈষ্ণব কুলের বিশ্বাস এইখানেই দ্বাপর যুগের অবসান কলিযুগের সূচনা।কলিযুগের শুরুর দিন শ্রীকৃষ্ণ এই তীর্থেরই এক বৃক্ষশাখায় তীর বিদ্ধ হয়ে শরীর ত্যাগ করেন।এখানেই রয়েছে গোলোকধাম, কৃষ্ণের মৃত্যুস্থল।জরাসবরের হাতে তীর বিদ্ধ হওয়ার পর ৪কিলোমিটার হেটে এসে এখানে গোলোকধামে দেহত্যাগ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।এই জায়গা এখন স্থান মাহাত্বে সারা দেশের কাছে পরিচিত।এখানে তৈরি হয়েছে মন্দির এবং সোমনাথ মন্দিরের পাশাপাশি এই সোমনাথ এলাকায় এই মন্দিরের মাহাত্ম সাধারণ মানুষকে টানে প্রত্যেকদিন।তারপরে বলরামদেব ও পাতালে প্রবেশ করেন।এখানে পাতালের প্রবেশদ্বারও রয়েছে।
হিরণ-কপিলা-সরস্বতীর পাড়ে সন্ধ্যা নামলে শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি।গৌরীকুণ্ডে আলোর প্রদীপ ভাসিয়ে দেন পুণ্যার্থীরা।মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে কাঁসর-ঘন্টার শব্দ।
0 মন্তব্যসমূহ