৫১ সতীপীঠের অন্যতম বাংলাদেশের যশোরেশ্বরী মন্দিরের অজানা কথা

 


সতীর ৫১ সতীপীঠের বেশ কয়েকটি রয়েছে বাংলাদেশে।যার মধ্যে অন্যতম মা যশোরেশ্বরী।বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ঈশ্বরীপুরে মা যশোরেশ্বরীর মন্দির।এখানে পীঠ ভৈরবের নাম চন্ড।কথিত আছে সুদর্শন চক্রে খণ্ডিত সতীর কোরকমল বা তালুদ্বয় পড়েছিল এখানে।অনেকে আবার বলেন দেবীর দুটি পা এখানে পড়েছিল।সতীদেহের কোন অংশ এখানে পড়েছিল তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বাংলাদেশের অন্যতম এই যশোরেশ্বরী মন্দির।

    এখানে পুরাণ বর্ণিত যে ৫১টি শক্তিপীঠ সেই পীঠের এক পীঠ এখানে অবস্থিত।সতীর পাণিপদ্ম এখানে পড়েছিল বলে কথিত।সেখানে বর্তমানে যে মন্দিরটি আছে সেটি যশোরেশ্বরী কালী মন্দির।মন্দিরের নির্মাণ নিয়েও রয়েছে একাধিক মত।

    কথিত আছে, অনোড়ি নামের এক ব্রাহ্মণ প্রথম মন্দিরটি তৈরী করেন।কিন্তু সময়কাল জানা যায়নি।শোনা যায় বহুকাল পর বেনুকর্ণ নামের এক ক্ষত্রিয় মন্দিরটি সংস্কার করান।তবে মূল মন্দিরটি নতুন রূপ পায় রাজা প্রতাপাদিত্যের হাতে।কথিত আছে, গৌর থেকে এসে এই অঞ্চলে ইছামতী ও যমুনার সঙ্গমস্থলে রাজধানী স্থাপন করতে চান রাজা প্রতাপাদিত্য।রাজধানী নির্মাণের জন্য বন জঙ্গল সাফ করেছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্য।এমন সময় এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হন কামালউদ্দিন নামে তার এক কর্মচারী।কামালউদ্দিন দেখেন ঝোপের আড়ালে জ্যোতির্ময় আলোক ছটা, সেখান থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া।ঘটনার কথা রাজাকে জানান তিনি।জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে রাজা দেখেন এক পরিত্যক্ত মন্দির ও এক প্রস্তর খন্ড।পাথরের খণ্ডটি দেখতে অনেকটা হাতের তালুর মতো।পাশেই পড়ে রয়েছে টাটকা জবাফুল।তখনি সেই স্থানে দেব মাহাত্ম্য অনুভব করেন তিনি।তারই উদ্যোগে নতুন করে তৈরী হয় মন্দির।জায়গার নাম রাখে যশোরেশ্বরী পুরী।আর সেই নাম থেকেই দেবীর নাম হয় যশোরেশ্বরী।


    শুধু মন্দির নির্মাণ নয়, তৎকালীন সময়ে সৌহার্দ্যের বার্তা দেন রাজা প্রতাপাদিত্য।মন্দিরের অদূরেই নির্মাণ করেন একটি মসজিদ ও একটি  গির্জা।মসজিদটির নাম টেঙ্গা মসজিদ এবং এই মসজিদ তিনি উৎসর্গ করেন তার কর্মচারী কামালউদ্দিনের উদ্দেশ্যে।যিনি প্রথম দেবীস্থানে অলৌকিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।মসজিদ থেকে কিছুটা দূরেই গির্জা তৈরী করান তিনি নাম ঈশ্বরীপুর চার্চ।১৫৯৯ সালে নির্মিত এই গির্জা বাংলাদেশের প্রথম বলে দাবি।মন্দির, মসজিদ, গির্জা অদ্ভুত কৌণিক বিন্দুতে মিলিত।তিনটির অবস্থান যেন একটি অদৃশ্য ত্রিভুজ নির্মাণ করেছে।যশোরেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে ত্রিকোণের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।মন্দিরের অনেক কিছুই ত্রিকোণাকৃতি।যেমন ভৈরবের মন্দির ত্রিকোণ।ভৈরবর বেদীটিও ত্রিকোণাকৃতি।দেবীর সমস্ত কাজ যে  পুকুরে হয় সেটিও ত্রিকোণাকৃতির।পুজো হয়ে যাওয়া ফুল যেখানে ফেলা হয় সেই জায়গাটিও ত্রিকোণ।রাজা প্রতাপাদিত্যের পতাকা ও মুদ্রাও ছিল ত্রিকোণ।

    এই মা প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি হিসেবে কাজ করতো।একদিন মা রাজা প্রতাপের সঙ্গে বিশেষ একটা আলোচনার মাধ্যমে ক্ষুব্ধ হয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়েছিলেন।আগে ছিলেন দক্ষিণবাহিনী তার পরে রাজার সাথে সামান্য বিতর্কিত হওয়ায় মা ওনার ওপর রাগান্নিত ভাব নিয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়েছিলেন।তাই যশোরেশ্বরী মা পশ্চিমবাহিনী।

    শোনা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মন্দিরের সংস্কারের কাজ করিয়েছিলেন রাজা লক্ষণ সেন।ভৈরবের ত্রিকোণ মূর্তিটি তিনি তৈরী করিয়েছিলেন বলে কথিত।এমন ত্রিকোণ মন্দির বাংলাদেশের আর কোথাও নেই।সময় রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারেনি এই মন্দিরও।মুঘলরা রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে এই রাজ্যের দখল নেয়ার পর ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলে এই মন্দিরে।রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।জনবসতিহীন হয়ে পরে এই এলাকা।প্রায় ১৫০বছর পর এই মন্দিরের পুরোহিত সেবায়েতদের বংশধরেরাই নতুনভাবে মন্দিরের সংস্কার করেন।একটা সময় তুর্কিরা এই এলাকার যখন নিলে তারও প্রভাব পরে যশোরেশ্বরী মন্দিরে।তুর্কি স্নানাগার সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজের জায়গা কামান বসানোর বেদী শিকার করে আনা হাতির কঙ্কাল এখনো সেই সাক্ষর বহন করে চলেছে।

    যশোরেশ্বরী মন্দিরের কথা আমরা পাই ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও।একটা সময় কালীপুজোর দিনগুলিতে গম গম করতো যশোরেশ্বরী মন্দির।অবিভক্ত বাংলাদেশের দূর দূরান্ত থেকে জমিদাররা আসতেন পুজো দেখতে।পুজোর কটাদিন কাটাতেন এখানেই কিন্তু এখন র সেই জাঁকজমক নেই।নিত্যপুজোও বন্ধ।শুধু শনি মঙ্গলবার পুজো হয়।তবে কেউ অন্যদিনে উপাচার নিয়ে এলে সেক্ষেত্রে সেদিন পুজো হয়।তবে এখনো কালীপুজোয় ভক্ত সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মন্দির চত্বর।খিচুড়ি, রাবড়া ভোগ হয়।

    পূজার একদিন আগে মায়ের সামনে যে নহবৎ আছে ওখানে ঢাকি, ঢুলি ও বাঁশিবাদক রা খুব ভোর থেকে সেখানে সানাই বজায়।পুজোর দিন সকাল, দুপুর, সন্ধ্যাতে পুষ্পাঞ্জলি ও আরতির সময় ঢাক বাজে।পুজোর দিন সাড়ম্বরের সাথে গোটা মন্দির প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়।রাট ১০:০০ থেকে পুজো আরম্ভ হয় এবং রাত ১:০০-১:৩০ এর দিকে পুজো শেষান্তে পাঁঠাবলি হয়।

    রাজা প্রতাপাদিত্য তার সময়কালে অপূর্ব ধর্ম সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন এখানে।মন্দিরের ভগ্ন দশা হলেও সেই মানব বন্ধন আজও অটুট।হিন্দুদের পাশাপাশি যশোরেশ্বরী মায়ের পূজায় সমানভাবে অংশ নেন এখানকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও।নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে মন্দির সাজানো হাতে হাত মিলিয়ে সামিল হন সবাই।শুধু তাই নয় মনোস্কামনা পূরণে দেবীর কাছে মানতও করেন অংশ নেন ভোগ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও।

    বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে মন্দির চত্বর।একসময় একশোটি দরজা ছিল মন্দিরটির।মূল মন্দিরের সামনে ছিল বিশাল নাট মন্দির।এখানে বসলে সরাসরি দেখা যেত দেবীর মুখ।মন্দিরের তিনদিকে ছিল তিনটি তোরণ।তিনতলা বাস ভবন।মূল ফটকের দুইদিকে দুটি নহবৎ খানা বিশাল মণ্ডপ, দক্ষিণে ভোগ রান্নার ঘর এছাড়াও দৃষ্টিনন্দন বহু স্থাপত্য।গোটা মন্দিরেই মধ্যযুগীয় বহু স্থাপত্য লক্ষ্য করা যায়।একসময় প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছিল যশোরেশ্বরীর মন্দির।ইটের স্তম্ভ ও দেয়ালের গায়ে বেড়ে উঠেছিল মস্ত সব গাছ।

    কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে মন্দিরের সংস্কার হয়েছে।এই মন্দির বাংলাদেশের একটি পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ।এখনো কালীপুজোর সময় স্বধর্মের মানুষ এক হয়।যশোরেশ্বরী মা-কে ঘিরে প্রাণ পায় মন্দির চত্বর।নতুন করে জেগে ওঠে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ