মুর্শিদাবাদের ৫১ সতীপীঠের একমাত্র সতীপীঠ কিরীটেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস

 


বাংলার অতি প্রাচীন জায়গাগুলোর মধ্যে মুর্শিদাবাদ অন্যতম।একসময় বাংলার রাজধানী ছিল এই অঞ্চল।অধুনা মুর্শিদাবাদের একমাত্র সতীপীঠ হলো কিরীটেশ্বরী।বহরমপুর থেকে মৌরগ্রাম যাওয়ার পথে পড়ে পরঝন্ডা সেখান থেকে কিরীটেশ্বরী মন্দিরে যেতে বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকতে হয়।কিছুটা রাস্তা পাকার হলেও বাকি রাস্তা মাটির।

    চারিদিকে গ্রাম থাকলেও মন্দিরের জায়গাটি অনেকটা প্রসস্থ, খোলামেলা এবং আশপাশের থেকে বেশ কিছুটা উঁচু।মন্দির চত্বরে পৌঁছলে চোখে পড়বে বেশ কিছু মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।তাদের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি নতুন মন্দির। গুলোর মধ্যে দুটি বড় মন্দির আছে।কিরীটেশ্বরীর মন্দির চত্বরে একদম মাঝখানে রয়েছে এই মন্দির।শোনা যায় এই মন্দির নাটোরের রানী ভবানী তৈরী করেছিলেন।মন্দিরের গর্ভ গৃহের মাঝখানে একটি বেদীর ওপরে সেই শিলামূর্তি রয়েছে এবং লক্ষণীয় যে তার ওপরে যে ধরণের নকশা রয়েছে।

    এটি হলো বৌদ্ধ-তন্ত্রের শ্রী যন্ত্র।এখানে একসময় বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের ভীষণ রমরমা ছিল।তাই নাটোরের রানী ভবানী নকশাখানি দিয়ে উনি প্রমান দিয়ে গেছেন এটা বৌদ্ধ সংস্কৃতি।বেশ কিছু জায়গায় এর মিল পাওয়া যায়।নাটোরের রানী ভবানী যখন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে যান তখন সময়টা ছিল সুলতানী সময়কাল।তাই মন্দিরের খিলানটিতে দেখা যায় মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন।মন্দিরের বাইরের দিকটি আটচালা অর্থাৎ বৌদ্ধ-ইসলাম-হিন্দু তিনটে ধর্মের সমন্বয়ে এই মন্দিরটি স্থাপিত।


    শোনা যায়, রানী ভবানীর দেওয়া একটি মূর্তি রয়েছে।পৌষ মাসের মঙ্গলবার করে সেই মূর্তি মন্দিরে আনা হয়।দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রাজ্ বেশে মায়ের পুজো হয়।সেইসময় মন্দিরকে ঘিরে হয় উৎসব।এখানে মায়ের নিত্য পুজো হয় এবং আমিষ ভোগ হয়।অনেকে বলেন এখানে রয়েছে পঞ্চমুন্ডীর আসন।রানী ভবানীর পুত্র সাধক রাজা রামকৃষ্ণ এই আসনে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন।এই মন্দিরটির চারপাশে দালান ঘেরা।মন্দিরের গায়ে পুনঃসংস্কারের যে ফলক রয়েছে তাতে ১৩৩৭ সালের উল্লেখ রয়েছে।সেইসময় যেসব কারিগর মন্দির সংস্কার করেছিলেন তাদের নাম মন্দিরের গায়ে ফলকে খোদাই করা আছে।

    কিরীটেশ্বরীর মন্দির চত্বরের আরেক মন্দিরের ফলকে লেখা আছে আদি কিরীটেশ্বরী মাতার মন্দির।তবে এই মন্দিরের যে আদি রূপ সেটা এখন আর দেখা যায় না।মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে এবং সেটা বাংলার ১৩৯৭ সালে।স্থানীয় মানুষ মনে করেন এটি আদি মন্দির।পুরোনো মন্দির ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় পুরো মন্দিরটি নতুন করে তৈরী করা হয়েছে।

    অমাবস্যার দিন সকাল ১০টার মধ্যে মা-কে স্নান করানো হয়।সেইদিনই শিলামূর্তিটির সম্পূর্ণ দর্শন পাওয়া যায়।এই মন্দিরকে গিরে রয়েছে বহু অলৌকিক কাহিনী।নবাব মীরজাফরের যখন কুষ্ঠ ব্যাধি হয়েছিল তখন মায়ের চরণামৃত ও পুস্প নিয়ে কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।সেই কারণে মন্দিরের পেছনে মায়ের পুকুর সংস্কার করে দেয়।ইসলামের পবিত্র দিক হলো পূর্ব-পশ্চিম সেই হিসেবেই নবাব এই পুকুরটি খনন করে দেন।

    সতীর মাথার করোটি পড়ায় অনেকে একে প্রথম সতীপীঠ বলে বিশ্বাস করেন।করোটি থেকে দেবীর নাম কিরীটেশ্বরী।এখানে মায়ের আসল নাম কিরীটকণা।যার থেকে অঞ্চলটির আদি নাম কিরীটকণা হয়েছে।



মূলমন্দিরের একপাশে মায়ের দীঘির ধরেই রয়েছে ভৈরবের মন্দির।বিভিন্ন সময়ে এর বাইরের অংশের সংস্কার হলেও ভেতরের অংশ এখনো প্রাচীন অবস্থায় রয়েছে।সেখানে দেওয়ালের গায়ে এখনো বেশ কিছু প্রাচীন নকশা দেখা যায়।এই মন্দির চত্বরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির হলো এটা।স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে আনুমানিক প্রায় ১০০০বছর আগে এই মন্দির তৈরী হয়েছিল।যা এখন শুধুই ধ্বংস স্তুপ।মন্দিরের ইটের যে আকার সেটা দেখলেই বোঝা যাবে একেবারে পাতলা টালির মতো ইটের তৈরী।এখনো মন্দিরের দেওয়ালের ভেতরে যে ধরণের পুলুঙী থাকতো সেই ধরণের কিছু খাঁজ রয়ে গিয়েছে।এই মন্দির চত্বরে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন ভাঙা মন্দির।যেগুলো আজ থেকে প্রায় ৩০-৪০ বছর আগেও হয়তো পুজো হতো।স্থানীয় বাসিন্দাদের মোতে এখানে ১০৭টি শিবের মন্দির ছিল।তার মধ্যে ৩০-৪০ বছর আগেও অন্তত গোটা ২০ মন্দির ছিল।এখন কিন্তু সেগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন।তবে তার মধ্যে থেকে কয়েকটি মন্দিরকে নতুন করে সারিয়ে তোলা হয়েছে।এই জায়গায় এখনো মাটি খুঁড়লে মাঝে মধ্যে উঠে আসে নানা  ধরণের শিব মূর্তি এবং সেগুলোকে এক জায়গায় রেখে পুজো করা হয়।মন্দির চত্বরে জীর্ণ মন্দির গুলো যেমন দাঁড়িয়ে রয়েছে তেমনি বহু মূর্তি ও পাথরের নানা নকশা যা নানা সময়ে পাওয়া গিয়েছে তাও পড়ে রয়েছে অবহেলায়।


    কিরীটেশ্বরী মায়ের মন্দির চত্বর আজও বেশ শান্ত।উৎসব ছাড়া এমনি সময় খুব একটা ভিড় হয়না।মন্দির চত্বর ছাড়িয়ে গ্রামের সরু পথ ধরে মিনিট পাঁচেক এর পথ পেরোলেই মায়ের গুপ্তপীঠ।এই মন্দিরটি একদমই মন্দির আকৃতির নয়।এর পেছনে রয়েছে এক মস্ত কাহিনী।মুর্শিদকুলী খাঁ যখন রাজধানী পরিবর্তন করেছিলেন মুর্শিদাবাদে তখন মুর্শিদাবাদে হিন্দু রাজাদের মনে এক আতঙ্ক জাগলো।মুর্শিদাবাদ যদি রাজধানী হয়, রাজধানীর সম্মুখে কিন্তু কিরীটেশ্বরী মায়ের মন্দির।কিরীটেশ্বরী মায়ের মন্দির মানেই হলো আমাদের গোটা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য।তাছাড়া আমাদের গোটা জেলার একটা গর্ব।যেখানে দেবীর একটা অংশ রয়েছে এবং যেখানে মায়ের নিত্য সেবা হয়।সেই মন্দিরে যেকোনো সময় বিঘ্ন ঘটতে পারে বা ঘটাতে পারে।তাই হিন্দুরা চিন্তা করলেন কিরীটেশ্বরী মায়ের মন্দির কিভাবে রক্ষা করা যাবে।শোনা যায় এই গুপ্তপীঠে মায়ের আদি মন্দির থেকে স্থানান্তরিত করা হয়।৩০০ বছর পূর্বে এখানে পান্ডা পাড়া ছিল।পান্ডা দেড় বাড়ির পেছনে মা-কে আড়াল করে রাখা হয়েছিল।

ছোট্ট পাঁচিল ঘেরা একটি মন্দির ভেতরে মা কিরীটেশ্বরীর অবস্থান।মন্দিরে মায়ের গর্ভ গৃহ ছাড়াও রান্না ঘর ও ভাঁড়ার ঘর আছে।মায়ের শিলামূর্তি কাপড় দিয়ে ঢাকা।সামনে তারের মুকুট পরানো।দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে আরো কাহিনী রয়েছে।১৭২ পান্ডার বসবাস ছিল এখানে।তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিলো শাড়ির মধ্যে কি এমন বস্তু থাকতে পারে।দেখার জন্য খুব কৌতূহল জাগে এবং ১৭২ পান্ডা সকলে একমত হয়ে মায়ের সারি খুলে মা-কে দর্শন করতে শুরু করেন।শোনা যায়, প্রথম ১-২ জন যারা দর্শন করলেন মা-কে সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।বাকি পান্ডারা থেমে যায়।মা-কে শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো কিন্তু এইক্ষেত্রে মা কিরীটেশ্বরী কোনো পান্ডাকেই ক্ষমা করলেন না।শোনা যায়, ২-৩ মাসের মধ্যেই এই কিরীটেশ্বরীর মাটি থেকে ১৭২ পান্ডা সমরেই ধ্বংস হয়ে গেলো।পান্ডা বলে কোনো বস্তু থাকলো না।


    এখানে যিনি সেবায়িত তিনিই পূজারী, তিনিই ভান্ডারী, রাঁধুনি সবকিছু।নিজেই ভোগ রান্না করে মা-কে নিবেদন করেন।তারপর সেই প্রসাদ ভক্তদের পরিবেশন করেন।

সন্ধ্যে হতে স্তব্ধতার বুক চিরে শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ