মহিষাদল_রাজবাড়ির_রথযাত্রা

       


 কালের নিয়মে এখন আর সেই রাজত্বও নেই, ঐশ্বর্য, বৈভবও নেই । কিন্তু বহু সামাজিক উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে মহিষাদলের বুকে আজো দাড়িয়ে আাছে দুটি সুবৃহৎ রাজবাড়ি আর এই রাজপরিবারের হাত ধরে যে রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল তার আজও বহন করে চলেছে সেই ঐতিহ্য। রথযাত্রার কথা শুনবার আগে এই রাজপরিবারের সম্বন্ধে কিছু জেনে নেওয়া যাক। 

   

        বীরনারায়ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারির পত্তন করেন। তার ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন কল্যাণ রায়চৌধুরী । ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কল্যাণ রায়চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি সঠিকভাবে জমিদারি চালাতে ব্যার্থ হন । ফলস্বরূপ নবাব বাহাদুরকে প্রদত্ত কর পরিশোধ না করতে পারায় তার জমিদারি নিলামে ওঠে ।  

          এদিকে আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রীষ্টাব্দে জনার্দন উপাধ্যায় নামক এক কনৌজ ব্রাম্ভন ব্যাবসার উদ্দেশ্যে উত্তরপ্রদেশ থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালিতে এসে উপস্থিত হন । জনার্দন উপাধ্যায় মহিষাদলের জমিদারি নিলামের কথা জানতে পারলে এই সুযোগে তিনি তা কিনে নেন । পূর্বে ইনি ছিলেন মোগল সম্রাট আকবরের সৈন্য বিভাগের এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী । ফলে আকবরের কাছ থেকে মহিষাদলাধিপতি-র স্বীকৃতি পেতে তার সময় লাগেনি । স্বীকৃতিস্বরূপ  আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁর কাছ থেকে সুন্দর একটি তরবারিও উপহার পান ।  জনার্দন উপাধ্যায়-ই মহিষাদলের বর্তমান রাজবশের প্রতিষ্ঠাতা । 

        ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের পঞ্চম পুরুষ আনন্দলাল উপাধ্যায় মারা যাওয়ার পরে তাঁর সহধর্মিনী জানকী দেবী রাজত্বভার গ্রহণ করেন ও অতি দক্ষতার সাথে রাজত্ব বা জমিদারি পরিচালনা করেন । 

        আনন্দলাল উপাধ্যায় ছিলেন পুত্রহীন । আনন্দলাল ও জানকী দেবীর একমাত্র কন্যা মন্থরা দেবীর সাথে ছক্কন প্রসাদ গর্গের বিবাহ হয় । জানকী দেবী তার দৌহিত্র অর্থাৎ মন্থরা দেবী ও ছক্কন প্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ গর্গকে ধনসম্পত্তি সহ রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ উইল করে দেন । 

         গুরুপ্রসাদ গর্গের তৃতীয়  পুরুষ রামনাথ গর্গ নিঃসন্তান হওয়ায় তার দত্তক পুত্র লছমন প্রসাদ গর্গ রাজা হন। জনশ্রুতি আছে যে, মহিষাদল রাজপ্রাসাদের যে সাধুনিবাস ছিল, সেখানে ঠাঁই নিয়েছিলেন এক সাধু। সেই সাধুর সঙ্গে ছিল সুদর্শন ও সুলক্ষণযুক্ত উত্তরপ্রদেশীয় একটি বালক। রানীর চোখে পড়ে বালকটি । তার ভাগ্য খুলে যায়। রানির আশ্রয়ে সে মানুষ হয় । সেই লছমন প্রসাদ গর্গ রাজা হবার পর থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকাল পর্যন্ত তার বংশধরেরাই মহিষাদলের রাজত্ব ভোগ করেন ।

         জনকল্যানমূলক নানা কর্মকান্ডে এই  রাজবংশের বিশেষ সুখ্যাতি আছে । তার মধ্যে রানী জানকী দেবীর শাসনকাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।  ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই রাজপরিবারের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন । দেবদ্বিজে অচলা ভক্তি থাকায় তিনি তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মোট ১০৮ টি মন্দির স্থাপন করেন । এগুলির মধ্যে ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হলদিয়া মহকুমার নন্দীগ্রামে জানকী নাথ মন্দির অন্যতম, যেখানে অধিষ্ঠিত বংশীধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ । এছাড়াও  ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রানি জানকী দেবী রাজবাড়ির ঠিক সামনেই প্রায় ১০০ ফুট উঁচু মদনগোপাল জিউ মন্দির তৈরি করেন ও ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে রথযাত্রার সূচনা করেন । 


১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে রানী জানকী দেবী মহিষাদলের শাসনভার নেওয়ার পর তার নানা ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক কার্যাবলীর নিদর্শন এই রথযাত্রার । জনশ্রুতি আছে, একদল প্রজা একদিন রানী জানকী দেবীর কাছে শ্রীক্ষেত্র পুরীর মত মহিষাদলেও রথযাত্রা চালু করতে অনুরোধ করলে তিনি প্রজাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে মহিষাদলে রথযাত্রার প্রচলন করেন । এর আগে, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রানী জানকী দেবী রাজবাড়ির ঠিক সামনেই প্রায় ১০০ ফুট মন্দির তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন রাজপরিবারের কুলদেবতা মদনগোপাল জীউকে। চলতি বছরে এই রথের বয়স তাই ২৪২ বছর । 

       শুরুতে ১৭ চূড়া ও ৩৪ টি চাকা বিশিষ্ট এই কাঠ নির্মিত রথের উচ্চতা ছিল ১০০ফুট । সমগ্র রথটি বার্মা শাল ও সেগুন কাঠে তৈরী । সে সময় খরচ হয়েছিলো সাত হাজার সিক্কা। পরবর্তীতে কয়েকবার সংস্কার হলেও রথের মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয়নি । বর্তমানে পতাকার দণ্ডসহ রথের উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট। মোট পাঁচ তলার।

        রথের কোণে কোণে কাঠের তৈরি মকর, সিংহ, যুদ্ধরত সেনা, ময়ূর, ইংরেজ ইত্যাদির প্রতিমূর্তি খোদিত রয়েছে। যা সাধারনত মৃত্যুলতা ভাস্কর্য বলে পরিচিত । আর আছে কিছু তৈলচিত্র ।

       মহিষাদলের রথের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল,এই রথযাত্রায় জগন্নাথের সঙ্গী বলরাম সুভদ্রা নন, গোপাল জিউ ও রাজ রাজেশ্বরী ।

      আগে পালকি চড়ে আসতেন রাজবাড়ির সদস্যরা, কামান দেগে সূচনা হত রথযাত্রার। আবার উল্টোরথে গুণ্ডিচাবাড়ি থেকে বিগ্রহ ফিরে এলেও কামান দাগা হত। 

      এখনও রথযাত্রার পুরনো ঐতিহ্য মেনে রাজ পরিবারের একজন সদস্য পালকি চড়ে রাজবাড়ি থেকে রথের সামনে যান । সঙ্গে চলে রাজছত্র, দেহরক্ষী । পালকি থেকে নামার আগেই ডঙ্কা বাজিয়ে জানান দেওয়া হয় রাজাবাহাদুরের আগমন। তিনিই পালন করেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। তারপর টান দেন রথের রশিতে ।তবে ক্ষমতায়ন পরিবর্তনের প্রতীক স্বরূপ বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বদেরও এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে । রাজপরিবারের আর্থিক বৈভব কমে যাওয়ায় ২০০৬ সাল থেকে রথযাত্রা পরিচালনার দায়িত্বও এখন স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির হাতে ।

        মহিষাদলের রথের মেলা বাংলার সমাজ জীবনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। টানা এক মাস ধরে চলে এই মেলা। এখানে গ্রাম্য ভাবেরই প্রাধান্য । পাঁপড়ভাজা আর গরম জিলাপি তো আছেই সেই সাথে প্রচলিত ও স্থানীয় নানান খাদ্যদ্রব্য, অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্র, প্লাস্টিকের নানান জিনিস, গৃহস্থলী ও মনোহারী সামগ্রী, লোহার সাবেকি দা- কাটারি,বটি, কাস্তে, কোদাল,খুন্তি, কুড়ুল ইত্যাদি র পসরা নিয়ে দোকানিরা হাজির হয় । সবং এর মাদুর শিল্পীরা আসে তাদের সম্ভার নিয়ে । এর সঙ্গে আছে গাছ-গাছালির চারা বিক্রি ও বিদেশী পাখির দেদার বেচাকেনা । ধর্মীয় ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো জলচ্ছত্র বসায় । সব মিলিয়ে মেলার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পরে পুরো মহিষাদল এলাকা জুড়ে ।

        রথযাত্রার পথ খুব একটা দীর্ঘ নয় -মোটামুটি এক কিমির মত । বিকেল ৪ টে নাগাদ জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাত্রা শুরু হয়ে ৫ টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায় । পাকা রাস্তার পাশের প্রশস্ত কাঁচা পথ দিয়ে রথ এগিয়ে চলে । রথযাত্রা র সাথে বৃষ্টির নিবিড় সম্পর্ক । কাঁচা পথ কর্দমাক্ত হলে স্থানীয় যুবক রা কাদা মাখামাখি অবস্থায় জগন্নাথদেব ও মদনমোহন জিউর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে উৎসাহভরে রথের রশিতে হাত লাগায় ।তাদের সাথে যোগ দেয় অনেক পূনার্থীও । রেল, সড়ক ও ফেরি পথে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় এই দিন, চতুর্দিকে মানুষের কালো মাথা ছারা আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না 

        রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উত্‍সবই নয়, এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সামাজিক বন্ধনের শিক্ষা। হাজার হাজার মানুষ একসাথে মিলিতভাবে রথ টানলে তবেই রথ সচল হয় । অর্থাত্‍ মানুষের সমবেত প্রয়াসে যে কোন অসাধ্য সাধন করা সম্ভব- এই সত্যই রথযাত্রার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মহিষাদলের রথের বিশেষত্ব হল, এখানে জগন্নাথ দেব রথে থাকেন না। থাকেন রাজবাড়ির কূলদেবতা মদনগোপাল জিউ। প্রতিবছরেই বহু পর্যটক যান মহিষাদলের রথ দেখতে। তবে তাঁদের আর্জি রাজবাড়ি এবং তার ইতিহাসের সঙ্গে প্রাচীন রথের কথাও প্রচার করা হোক। এদিকে, মহিষাদলের প্রাচীন এই রথযাত্রার প্রচার তেমনভাবে হয়না বলে আক্ষেপ করেছেন মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির কর্মকর্তারা। এক সময় রাজারাই এই রথ চালনা করলেও, বর্তমানে রাজাদের আর্থিক বৈভব কমে যাওয়ায় রথ পরিচালিনায় হাত লাগান স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি। তাতে সহযোগিতা করেন এলাকার বেশকিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। রাজাদের রথ এখন তাই সাধারণই। মহিষাদলের রথের মেলা বাংলার সমাজ জীবনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সেখানে মেলাও বসে। টানা একমাস ধরে চলে সেই মেলা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ