ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীর অজানা কিছু কথা

 


জগতের এক বিরাট প্রয়োজনে পৃথিবীর বুকে আবির্ভুত হয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পূর্নবতার মনমোহন শ্রীকৃষ্ণ।অসংখ্য অত্যাচারী রাজা ও অসুরদেরকে হত্যা করে, মহাভারতের যুদ্ধের পরিণতি দান করে, মানবজাতিকে শ্রী শ্রী গীতা দান করে এবং বিশাল দ্বারকা নগরী নির্মাণ করে পার্থিব লীলায় যখন তিনি ক্লান্ত তখন জ্বরা নামের ব্যাধের অসতর্ক তীরের আঘাতে ভবলীলা সঙ্গে করেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ।তাঁর এই অন্তর্ধানের সাথে সাথে শুরু হয় কলিকাল।সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায় তাঁর তৈরী দ্বারকানগরী।

    ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য গুরাতের একটি জেলা বর্তমানের দ্বারকা নগরী।এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চারধামের একটি।'দ্বারকা' শব্দের দ্বার কথাটির অর্থ দরজা আর 'কা' অর্থাৎ স্বর্গ বা মোক্ষ।সেই অর্থে 'দ্বারকা' শব্দের অর্থ হলো স্বর্গের দ্বার বা মোক্ষলাভের উপায়।এছাড়াও দ্বারকা ভারতের সপ্তপুরী নাম পরিচিত সাতটি প্রাচীন শহরের বিখ্যাত শহরের মধ্যে একটি।এখানে অবস্থিত ৮০০ বছরের পুরোনো ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দিরটি।তবে বর্তমানের এই দ্বারকা শহর মূলত শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন নগরীর জন্য বেশি প্রসিদ্ধ যা একসময় ডুবে গিয়েছিলো সমুদ্রের অতল গহবরে।

    অতীতে এটিকে শুধুমাত্র গল্প হিসেবে মনে করা হলেও ২০০০ সালে এই স্থানে এক প্রত্নতত্ত্বিয় অভিযানে সমুদ্রের নিচে খোঁজ মেলে প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষের যা সেই প্রাচীন দ্বারকা নগরীকেই নির্দেশ করে।


    পৌরাণিক নগর দ্বারকার কথা প্রাচীন ভারত ও হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য মহাভারত সহ ভগবৎ গীতা, স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, হরিবংশ পুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দ্বারকা হলো সেই প্রাচীন শহর যেখানে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ একসময় বসবাস করতেন।বিভিন্ন সূত্রানুসারে, শ্রীকৃষ্ণ ভারতের দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত উত্তরপ্রদেশের মথুরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।শ্রীকৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা।এই রাজাকে বধ করেছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।একথা শুনে কংসের শ্বশুর তথা মগধের রাজা জরাসন্দ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন।কিন্তু ১৭ বার মথুরা আক্রমণের পরেও জরাসন্দ মথুরা জয় করতে ব্যার্থ হন।তবে এই ১৭ বার আক্রমণে মথুরার  অধিবাসী যাদবরা দুর্বল হয়ে পড়ে।শ্রীকৃষ্ণ যখন বুঝতে পারেন জরাসন্দ আর একবার আক্রমণ করলে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যাদবদের নেই তখন তিনি তাঁর প্রজাদের নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।মথুরা ত্যাগের পর শ্রীকৃষ্ণ নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে।

    প্রথমটির মতে, শ্রীকৃষ্ণ গড়ুরে চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সৌরাষ্ট্র আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন।

    দ্বিতীয়টির মতে, নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণ নির্মাণের দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্য নেন।বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে জানান যদি সমুদ্রের দেবতা তাঁদের কিছু জমি প্রদান করেন তবেই শুধুমাত্র এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।তখন শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্র দেবের পূজা করেন এবং সমুদ্র দেব খুশি হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ১২যোজন তথা ৭৭৩ বর্গকিলোমিটার জমি প্রদান করেন।জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।

    মহাভারত অনুসারে, দ্বারকা ছিল শ্রীকৃষ্ণ তথা যদু বংশীয়দের রাজধানী।খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল।পুরো শহরটি মোট ছয়টি ভাগে বিভক্ত।আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগর চত্বর, সোনা, রুপা ও দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল প্রাসাদ জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান ও জলাশয় ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল দ্বারকা নগরী।

    প্রায় ৭ লক্ষ্ ছোট বড় প্রাসাদ ছিল নগরীতে।এখানে ছিল সুধর্ম নামের এক বিশাল বড়ঘর।যেখানে নানা ধরণের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো।গোটা নগরীটি ছিল জল বেষ্টিত।এটি ছিল মূলত দ্বীপনগর।চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতো।দ্বারকা নগরী ছিল দুইভাগে বিভক্ত।একটি মূল দ্বারকা নগরী অন্যটি দ্বীপ দ্বারকা।সূত্রানুযায়ী, এইডাই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র।শহর দুটি নানা ব্রিজ ও বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল।

    জোয়ারের সময় মূলদ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত এই দুটি নগরী।শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাকি জীবন এই দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন এবং তাঁর তিরোধানের পর গোটা দ্বারকা নগরী এক বিশাল বন্যায় সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়।

    বলা হয়ে থাকে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই দ্বারকা নগরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বহু শতাব্দী ধরে বহু সভ্যতার মানুষ ঠিক সেই স্থানেই তাদের শহর নির্মাণ করে এসেছেন।বর্তমানে সেখানে যে দ্বারকা নগরী রয়েছে সেই ওই স্থানে এমনই ভাবে নির্মিত সপ্তম শহর।দরকার মূল মন্দিরটির বর্তমান নাম দ্বারকাধীশ মন্দির।অনেকের মোতে এই পাঁচতলা মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত।বর্তমানে দ্বারকা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান।সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সহ পৃথিবীর বহুদেশ থেকে মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন।



    অনেকের মতে দ্বারোকানগরীর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে।তবে এই নগরীর ভিত্তি ছিল কিনা তা খুঁজতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হয় বর্তমান দ্বারকা মন্দিরের সামনের সমুদ্রে।কিছুকাল পূর্বে সমুদ্রের নিচের অভিযানে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন বহু প্রাচীন এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।যা আনুমানিক মহাভারতের সময়কার।এই আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে উপকূল জুড়ে গবেষকরা আরো কয়েকটি অনুসন্ধান চালান।এই অনুসন্ধানে দেখা যায় বাস্তবেই বর্তমান দ্বারোকানগরীর সামনের সমুদ্রে প্রায় ৩৬মিটার গভীরে রয়েছে প্রাচীন নগরীর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ।



    এখানে রয়েছে পাথরের নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির নোঙর, ভবন ও দুর্গ তৈরিতে ব্যবহৃত নানা ধরণের পাথরের খন্ড।গবেষণায় দেখা গেছে এইসব ধ্বংসাবশেষের সবগুলোই মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ নির্মিত সেই দ্বারকা নগরীর সাথে মাইল যায়।এটি প্রমান করে তৎকালীন সময়ে ভারতের অন্যতম ব্যস্ত নগরী ছিল।এই আবিষ্কারের ফলে পৌরাণিক দ্বারকা নগরীর অস্তিত্ব চাইলেই সেটিকে গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।বাস্তবে কোনো এক সময় সমুদ্রের কিনারায় এই নগরীটির অস্তিত্ব ছিল।হয়তো এটি একসময় মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকতো।যা এখন হারিয়ে গেছে নীল সমুদ্রের অতল গহবরে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ