পুণ্যতীর্থ কালীক্ষেত্র কালীঘাট

 


"কালীঘাটে চারটি আঙ্গুলি ডানিপার নকুলেশ ভৈরব কালীকা দেবী তার।চলিল দক্ষিণ দেশে বালি ছাড়া অবশেষে উপনীত যথা কালীঘাটে,দেখে অপূর্ব স্থান পূজা অতি বলিদান, দ্বিজগন করে চণ্ডীপাঠ"।

    কলকাতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মা কালী।সাধন রহস্যে মোড়া কালীতীর্থ কালীঘাট।মহা পবিত্র পুণ্যপীঠ ভূমিতে মহত্ব, মাহাত্ম্য, পুরাণত্ব, লোকশ্রুতি চুপি চুপি মিশে রয়েছে কালীতীর্থ কালীঘাটের শিরা-উপশিরায়।

    কেউ আসেন সব হারিয়ে আবার কেউ আসেন সব পাওয়ার কামনায়।কালীঘাট সেই বটবৃক্ষের মতো।যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে চলেছে নানা ঘটনার স্রোতমালা।কালীঘাট সম্পর্কে লোককাহিনীর যেমন অন্ত নেই তেমনই এই পুণ্যভূমি ঘিরে রয়েছে অসংখ্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দলিল।পীঠমালা অনুযায়ী সেই দক্ষিনেশ্বর থেকে বেহালা পর্যন্ত ধনুকাকৃতির এই বিশাল ভূ-খণ্ডই ছিল সে যুগের কালীঘাট।


    কিংবদন্তি কাশীর মতো পুণ্যক্ষেত্র কালীঘাটে কিট-পতঙ্গ মরলেও সঙ্গে সঙ্গে তারা মুক্তি পেয়ে যায়।দেবী ভগবৎ অনুযায়ী এই বৃহৎ অঞ্চল কাশির মতো পুণ্যভূমি পুণ্যপীঠস্থান।এই কালিপীঠ গড়ে ওঠার পেছনে নানা কাহিনীর জাল বিস্তৃত।কালীঘাট মন্দিরের স্থাপনা বা বিগ্রহের ইতিবৃত্ত জানতে শাস্ত্র পুরাণ সর্বত্রই একেবারে জটিলতা বা জনশ্রুতির অন্ত নেই।তবে বিগ্রহের প্রথম প্রকাশে যে দুজন সন্ন্যাসীর অবদান একেবারে অনস্বীকার্য তারা হলেন ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম ব্রহ্মচারী।

    বহুযুগ আগে ভাগীরথীর তীরে পর্ণকুটিরে বাস করতেন এক ব্রহ্মচারী।একদিন সন্ধ্যায় দেবী বন্দনার পরে তপস্বী দেখলেন, গঙ্গার জলে এক অদ্ভুত আলোর খেলা।সেই আলোর অনুসন্ধানে সমস্ত রাত্রি উত্তেজনায় ঘুম হয়নি তাঁর।ভোরের আলো ফুটতে দহের তীরে তিনি দেখলেন একটি বিরাট পাথর।সেই পাথরের গায়ে অঙ্কিত দেবীর মুখমণ্ডল।সেই বিরাট পাথরের পাশেই পরে আছে মানুষের আঙুলের মতো চারটে প্রস্তরীভূত পায়ের আঙুল।এই পদাঙ্গুলি থেকেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে অলৌকিক আলোক।দেব নির্মিত মনে করে ব্রহ্মচারী পুজো শুরু করলেন।পরে দেবীর প্রত্যাদেশ অনুসারে তিনি জানতে পারেন, দেবীর অঙ্গ সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে এই স্থানে পতিত হয়।

    গাছের নিচে একটি অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে রাখতেন আত্মারাম ব্রহ্মচারী।তবুও মায়ের দেখা নেই।বহু তপস্যায় তাঁর দেহ জীর্ণ হয়ে ওঠে।তবু মা দেখা দেন না।দিনের পর দিন সাধনা।হটাৎ একদিন মাঝরাতে আত্মারাম শুনতে পান দেবীর কণ্ঠস্বর।দেবী তাঁকে বলেন, আত্মারাম তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট।তোমায় আমার একটা কাজ সম্পন্ন করতে হবে।অনেককাল আগে নীলগিরি পর্বতের এক নির্জনদেশে ব্রহ্মানন্দ গিরি নাম এক সন্ন্যাসী রয়েছেন।তিনি আমাকে তপস্যায় তুষ্ট করে একটি শিলাখণ্ডের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছেন।তুমি সেই শিলাস্তম্ভটি এই স্থানে নিয়ে এসো আর প্রথমাবস্থায় তুমি যে শিলার ওপর বসে তপস্যা করেছ, সেই শিলা হলো ব্রহ্মবেদি।স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা এখানে তপস্যা করেছিলেন।তুমি সেই ব্রহ্মবেদির ওপর ব্রহ্মানন্দের শিলাস্তম্ভকে স্থাপন করবে এবং এই স্থাপিত শিলায় আমার মূর্তি ফুটিয়ে তুলে আমাকে প্রতিষ্ঠা করবে।তোমার সম্মুখে ওই পুকুরের মধ্যে রয়েছে আমার পায়ের ৪টে আঙ্গুলি। কিছুদূরে রয়েছেন পীঠাধিশ নকুলেশ্বর।তুমি সব উদ্ধার করে সেই পীঠস্থানকে জন সাধারণের মধ্যে প্রকাশ করবে।

    মায়ের আদেশ শুনে আত্মারাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।নীলগিরির নির্জনতায় ব্রহ্মানন্দ শিলাখণ্ডে মায়ের জীবন্ত অস্তিত্ব অনুভবে বিভোর।সেখানেই দেবী আবির্ভুত হয়ে আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দকে নির্দেশ দেন।দেবীর কথা অনুসারে দুজনে শিলাখণ্ডের ওপরে বসে চোখ বন্ধ করে কালীক্ষেত্রের ধ্যান করতে থাকেন।কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা অলৌকিক উপায়ে পৌঁছে যান গঙ্গাতীরের কালীক্ষেত্রে।কালী ক্ষেত্রে পৌঁছে সেই ১২ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া কালো পাথরে দুই সন্ন্যাসী দেবীর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠেন মা।ত্রিনয়নী মূর্তি তাঁর।তখন থেকেই কালীঘাট পবিত্র সতীপীঠ।

     কালীঘাট কালী মন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত।মূর্তিটির জিভ, দাঁত ও মুকুট সোনার।হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার।কালীঘাট মহাশক্তিপীঠ।সকল স্থানের শ্রেষ্ঠ।মহাশক্তিরূপিণী কালী পিঠ রক্ষক ভৈরব নকুলেশ্বর।এখানে পুজো দিলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।কালীঘাটের দেবী কালীকা সর্বসিদ্ধিকারী।


    দেবীর নির্দেশে পুকুরের জল থেকে প্রস্তরীভূত পদাঙ্গুলি তুলে এনেছিলেন আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দ।তার ওজন প্রায় ছয় সের।বিগ্রহের নিচে একটি বাক্সের মধ্যে সেই পদাঙ্গুলি আজও স্বযত্নে রক্ষিত।কালীঘাটের সেবায়িত হালদার বংশের বংশগত বিবাদের ফলে পদাঙ্গুলি হরণের চেষ্টাও হয়।এইসময় পরে ছয় সের ওজনের প্রস্তরটি দু টুকরো হয়।যেহেতু স্নানযাত্রার দিন দেবীর পদাঙ্গুলি উদ্ধার হয়েছিল সেহেতু প্রতিবছর এই দিনে এই পবিত্র অঙ্গকে স্নান করানো হয়।সেবায়িত বংশের বয়োজ্যেষ্ঠগণ চোখে কাপড় বেঁধে সেদিন গর্ভ মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং দেবীর পবিত্র অঙ্গ কুঠুরি থেকে বের করে মধু জল দিয়ে স্নান করান।স্নানের পর আবার চোখ বাঁধা অবস্থাতেই গর্ভ মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন সেবায়িত গণ।



    পুণ্যতীর্থ, ভক্তিভরে প্রার্থনা মায়ের পায়ে অর্পিত জীবন।মায়ের কাছে আবদার করলে মা নাকি ফেরান না।তাই দূর দূরান্ত থেকে পুণ্যলাভের আশায় ছুতে আসে মানুষ।মনে হয় যেন এই আমার আশ্রয়স্থল।মায়ের চরণে আমার মুক্তি।

৫১ সতীপীঠের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সতীপীঠ।ভবানীদাস চরণ নামের একজন এসেছিলেন মা-কে শাঁখা পরাতে।তখন মা এক কুমারী বেশে শাঁখা পরেছিলেন।মা বলেছিলেন আমার বাবারা ভেতরে পুজো করছেন।তখন ওই শাঁখাওয়ালা ভেতরে যায় এবং পূজারী কে বলেন উপনার মেয়ে শাঁখা পরেছে আমার টাকাটা দিন।তখন পূজারী বলেন আমাদের তো কোনো মেয়ে নেই।মা ছদ্মবেশে কুমারী রূপে শাঁখা পরেন এবং সেটার থেকেই মায়ের এই মূর্তি।

    কালীঘাটের মূল পুজো মূলত ৮টি।দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে কালীঘাটে কালীপুজো হয় না।হয় ধনলক্ষ্মীর আরাধনা।মা দক্ষিনেশ্বরী এইদিনে পূজিতা হন লক্ষ্মী রূপে।প্রাচীন শাস্ত্রীয় রীতি মেনে কালীঘাটের মন্দিরে মা-কে কালী রূপে পূজন না করে ধনলক্ষ্মী রূপে পুজো করে রীতি।প্রাচীনকাল থেকেই তা হয়ে আসছে।আজও তা বিদ্যমান।

    দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে মা-কে দুপুরে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় সাদা ভাত, পোলাও, পাঁচরকম ভাজা, শুক্তো, পাঁচরকম মাছ, পাঁঠার মাংস, চাটনি পায়েস এবং মিষ্টি।সন্ধ্যায় মেক গাওয়া ঘিয়ের ফুলকো লুচি, পাঁচরকম ভাজা ও মিষ্টি সহযোগে ভোগ দেওয়া হয়।এই শীতলভোগের সঙ্গে সংযোজন করা হয় নারকেল নাড়ু, গুড়মাখানো খই, কদমা, বাতাসা, তিলের নাড়ু।

    আত্মারাম, ব্রহ্মানন্দ যারা স্বপ্নাদেশবলে মায়ের জ্যোতিষ দেখতে পায়, পরবর্তী কালে তারা আবার স্বপ্নাদেশ পান যে,"আমার অঙ্গকে রক্ষা করার জন্য আমার ভৈরব এখানে রয়েছে তোমরা তাঁকে খুঁজে বের করো এবং প্রতিষ্ঠা করো"।তারা জিজ্ঞাসা করে আমরা চিনবো কিভাবে? তখন মা উত্তরে বলেন গরুর দুধ অনবরত পড়ছে এক জায়গায়।সেখানে গিয়ে খুঁজলেই তোমরা ভৈরবের দেখা পাবে।তখন তারা এসে সেই জায়গাটিকে চিনতে পারে এবং নকুলেশ্বর ভৈরবকে প্রতিষ্ঠা করেন।


    নকুলেশ্বর ভৈরবের মন্দির ছাড়াও কালীঘাট কালীমন্দিরের সঙ্গে শ্যামরায় রাধাকৃষ্ণ মন্দির অতোপ্রতো জড়িত।রামনবমীর সময় এই রাধাকৃষ্ণ পথভ্রমণে বাহির হন এবং পথভ্রমণের পরে এই রাধাকৃষ্ণ মা কালীর পাদপদ্মে শয়ন করানো হয়।সেই সময় কৃষ্ণ-কালী করা হয়।পাদপদ্মে সারারাত্রি শয়নের পরে এই রাধাকৃষ্ণকে পাশের দোলমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় আর সেখানে রামনবমী আবির খেলা হয়।  


    ব্রহ্মানন্দ গিরি বা আত্মারাম ব্রহ্মচারীরা তো ছিলেনই কালীঘাটের সাধন ক্ষেত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে আছেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ এমনকি ভগিনী নিবেদিতাও।কালীঘাট সম্পর্কে ঊনবিংশ শতকে সূর্য-সদৃশ আধ্যাত্মিক পুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ-এর প্রসঙ্গ এসেই যায়।এই মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে আছেন বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতাও।তখন সবে বিদেশ থেকে ফিরেছেন বিবেকানন্দ।দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে তার প্রবেশ নিষেধ রয়েছে।কিন্তু এই মহাতীর্থের দুয়ার তার জন্য খোলা।এই নাট মন্দিরেই এক বিদেশী রমণী ভারতের কালিতত্ত্ব উপস্থাপিত করেন বিগ্রহের সম্মুখে।ইতিহাসের দিক দিয়ে এ এক উল্লেখযোগ্য ক্ষণ বৈকি।

    দেবীর ত্রিনয়ন দর্শনের মধ্যে দিয়েই মানুষের মধ্যে তার শক্তি সঞ্চারিত হয়।সারদা মা এখানে এসেছেন পূজা দিয়েছেন দিয়ে নাচছেন যখন তখন তিনি সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন মেয়েদের হটাৎ একটি মেয়েকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে মেয়েটি চমকে উঠলো।মা সারদা জিজ্ঞাসা করলেন তোমার কি লাগলো মেয়েটি তাকাতেই মা সারদা দেখলেন ত্রিনয়ন।

    পৃথিবীর সমস্ত আনন্দের উৎস বোধহয় মা শব্দের মধ্যে লুকিয়ে।যে অবলম্বনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি জীব একটু একটু করে পরিপুষ্ট হয় সেই সৃষ্টির ভান্ডার, স্নেহের সাগর হলো মা।সতীর দেহছিন্ন ৫১টি পীঠ মূলত মাতৃপীঠ রূপে পূজিতা।কালীঘাটের নিকশ কালো মা কালী টানা টানা চোখ, বিশাল জিহ্বা সতী কালিকাও সেই মায়ের এক রূপ যার পায়ে মাথা ঠেকালে ধুয়ে যায় পাপ।অবারিত বর্ষিত হয় পুন্য বারি ধারা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ